ভাসমান সংসারে প্রথমদিন: ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ মাহমুদ

0
8
রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবং কোন এলার্ম না দিয়েই। ভালো করেই জানি, যতই ক্লান্ত হই না কেন, জেট ল্যাগ একটানা ঘুমাতে দেবে না, এবং বাস্তবেও তা দেয় নি। ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে আটম্যাটিক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষন মেসেজ দেখা, আর ছয়টার অপেক্ষা। রাতে হোটেলে এসে কোন খাবার খাইনি, সুতরাং পেটে ক্ষুধা আছে মোটামুটি। এর বাইরে অনিশ্চয়তা হল রাতে এজেন্টের সাথে কোন কথা হয় নি, পিক আপ-ড্রাইভাররা কখনোই তেমন কিছু জানেনা।
আজকে কখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে, কখন বোট, কোন তথ্য আমার কাছে নেই। শুধু জানি হোটেলে ল্যাব-টেকনিসিয়ান আসবে আমার এন্টিজেন টেস্ট করার জন্য। এসব হিসাব নিকাশ করতে করতে ৬ টা বেজে গেল, রওনা হলাম ব্রেকফাস্ট করার জন্য।
নীচ তলার ফ্লোরের সিংহভাগ এলাকা জুড়েই রেস্টুরেন্ট, এল শেপ এর মতো সাগরমুখী উত্তরের অংশ, এবং পুর্বমুখী রাস্তার পাশের অংশ জুড়ে খাবার জায়গা। সাগরমুখী অংশের বাইরে বিশাল অংশ উন্মুক্ত সাথে সুইমিং পুল। কিন্তু নানাবিধ অনিশ্চয়তার কারণে এসব সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মানসিকতা এ মুহুর্তে নেই। তবে ব্রেকফাস্টের মেন্যু দেখে পেট ভরার আগে মন ভরে গেল। যদিও হটেল দেখে মনে হয় না এটা পাঁচ তারকা মানের, কিন্তু খাবার সন্দেহ নেই তাকে অতিক্রম করবে। অধিকাংশ আইটেম অচেনা বা সঠিক নাম জানিনা, কিন্তু রান্নার শৈলী প্রশংসনীয়। সকাল ছয়টা, উচিৎ হালকা নাস্তা করা। রাতে ডিনার করিনি, সুতরাং নিজে নিজেকে উপদেশ দিলাম, মনে কর এটাই ডিনার, সুতরাং খেয়ে নে বাবা মন মত। আমাদের দেশী তেহেরির আলু বা জামালপুরের ছোট গোল গোল আলু সুন্দর করে ভাজা হয়েছে, দেখতে চীজ বলের মত, বেশ কয়েকটা নিলাম। খেতে বসে দেখি এসব আলু না, কোয়েলের ডিম বেসন দিয়ে মাখিয়ে ডীপ ফ্রাই করেছে।
এমন বহুবিধ চমকের বেশ কিছু বুভুক্ষের মত ট্রাই করে রিশেপসনে আসলাম। সেখানে বেশ কয়েকজন মহিলা এপ্রন পরে ঘুরাঘুরি করছে, তাদের তালিকায় আমি আছি কিনা জিগ্যেস করাতে বলল তারা অন্য কোন গ্রুপের জন্য এসেছে। সালভাদর বেশ বড় বন্দর, অনেক শিপের আনাগোনা, ফলে অনেক নাবিকরা উঠা নামা করে, খুব সম্ভবত হোটেলটি জয়েনিং ক্রুদের জন্য বহুল ব্যাবহৃত হয়। উপরে গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দেবার সময় মেসেজ আসল এজেন্ট থেকে, বেশ আগেই নাকি কোন মেডিক্যাল টিমকে এসাইন করা হয়েছে, চলে আসাবে দ্রুত। সাথে সাথে লবী থেকে ফোন এল, আমি যাতে রুমেই থাকি, টীম আসছে স্যাম্পল নেবার জন্য। কিছুক্ষন পর নক করে যে দুজন মহিলা ঢুকলেন, কিছুক্ষন আগে তারাই আমাদের মানা করেছিলেন যে ওনারা অন্য কারও জন্য এসেছে। এসেই দুঃখ প্রকাশ করল, বলল রুম নাম্বার নাকি ভুল শুনেছে, এটা তাদের দোষ, এবং তারা লজ্জ্বিত। স্যাম্পল নিয়ে চলে গেল, এবার অপেক্ষার পালা।
আজকাল হোটেলের রুমে বারান্দা বা ব্যালকনি প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু কিছু কিছু শহরে দেখেছি এখনও হোটেল রুমে ব্যালকনি থাকে। গতবার জাহাজে যোগ দিয়েছিলাম হাওয়াই তে, সেখানে দেখেছি অনেক হোটেলে ব্যালকনি রাখা হয়। এ হোটেলেও সুন্দর একটি ব্যালকনি রয়েছে, শুধু তাই নয়, সেখানে দুটো চেয়ার এবং একটি টি-টেবিলও রয়েছে, বসলে উন্মুক্ত সৈকত চোখে পরে। সৈকতের কোল ধরে মেরিন ড্রাইভ, কেউ জগিং করছে, অনেকে এমনি হাঁটছে, বেশ সুন্দর একটা ছুটিরদিনের আমেজ। ঘন্টা খানেক পর এজেন্ট হোয়াটসএপে মেসেজ পাঠাল, টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ এবং ড্রাইভার আমাকে পিক আপ করার জন্য আসছে। এর মানে হল আজকেই যোগ দিতে হবে, সাইটসিইং এর সময় নেই, বারান্দায় বসে বসে সাইট সিয়িং আর গাড়ির অপেক্ষা। ব্রাজিলের সব শহরগুলোর সাথে ঢাকা এবং মুম্বাই এর বেশ মিল রয়েছে। একই জায়গায় স্কাইস্ক্যাপার আর বস্তি বা স্ল্যাম। রিও তে খুব সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তি এলাকা রয়েছে, আবার একই সাথে রিও খুবই সুন্দর শহর। হোটেল যে এলাকায়, সেটা অনেকটা আবাসিক এলাকা, সমুদ্র সৈকত এবং বানিজ্যিক এলাকার সন্ধিস্থল। হোটেলের সুন্দর রেস্টুরেন্টের একটি অংশের সিলিং এ ৬” বাই ৬” ইঞ্চি সাইজের কিছু কাগজের পতাকা লাগানো, আর বারান্দায় যাবার সুইং ডোরে “হোলা হেক্সা” লিখা, এছাড়া বিশ্বকাপের তেমন কোন সাইনবোর্ড নজর পরল না। পরে এজেন্ট কে জিগ্যেস করে জানতে পেরেছি, তাদের উন্মাদনাটা হয় খেলার সময়, রাতে বার, পাব বা কমিউনিটি সেন্টারে উল্লাস হয়, খেলা জিতলে উৎসব বা কার্নিভাল হয়, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত খেলা উপলক্ষে কোন তিয়েনামান স্কয়ারের কথা তারা শুনেনি। বারান্দা থেকে আসে পাশের প্রচুর বিল্ডিং নজরে আসে, অনেক খুটিয়ে খুটিয়ে তাকিয়ে একটি ভবনে একটি পতাকার দেখা মিলল। ভালোই লাগল, আমরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার চেয়েও ভাল ফুটবল খেলি, তবে পা দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে।
সাড়ে দশটার দিকে এজেন্ট আসল, ব্যাগ রেডি ছিল, শুধু নীচে নেমে গাড়িতে চড়া। মিনিট দশেকের মধ্যে বন্দরের গেটে চলে এলাম। গাড়ি আমাকে বাইরে নামিয়ে ভেতরে চলে গেল, আমাকে হেটে ঢুকতে হবে ইমিগ্রেশন কাঊন্টার দিয়ে। ওরা শুধু পাসপোর্ট আর অন এরাইভ্যাল ভিসার পাতাটা দেখল, আর কিছুনা। অফিস পার হয়ে ভেতরের দিকের গেটে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠার কয়েক মিনিটের মধ্যে জেটিতে পৌঁছে গেলাম, যেখানে বোট আসবে। মিনিট পাচেকের মধ্যে বোটও চলে আসল, ব্যাগ উঠিয়ে রওনা হলাম জাহাজের দিকে। বোট মানে ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকা, তবে একেবারে খোলা শ্যালো নৌকা না, একটা ক্যাবিন বানানো, যেখানে বসার সোফাও রয়েছে। অনেকদিন পরে সাগরে নেমে এক ধরনের ভিন্ন অনুভূতি, মনে হচ্ছে বহুদিন প্রবাসে থেকে বাড়ি ফিরছি, চেনা বাতাস, চেনা আকাশ, আর দূরে দেখা যাচ্ছে আমার চেনা বাড়ি।
আসলে এধরনের কথা কোন নাবিক বিশ্বাস করবে না যে কেউ জাহাজে যোগ দেবার অনুভূতি বাড়ি ফেয়ার সাথে মেলাতে পারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে বিষয়টা কিছুটা ভিন্ন। আমি সেই আগের জাহাজে ফেরত এসেছি, এটা পর পর চতুর্থ বার, “Eagle San Antonio”। আমার হাতের তালুর মত চেনা, জাহাজে এমন কেউ নেই যে এ জাহাজকে আমার চেয়ে ভাল চেনে। যে কোন নাবিক জাহাজে যোগ দেবার জন্য যখন বোটে উঠে, কিংবা গাড়ি দিয়ে গিয়ে যখন জাহাজের সিঁড়িতে পা দেয়, তখনই একটা নাড়ি ছেড়ার অনুভূতি হয়, মনে হয় এ মুহুর্তে আমি পৃথিবী নামক গ্রহ বা হোম-প্ল্যানেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। জীবনে যতবার জাহাজে যোগ দিয়েছে, সব সময় তাই মনে হয়েছে। শুধু আমার না, প্রত্যেকটি নাবিকের তাই মনে হয়। কিন্তু এবার সত্যি সম্পুর্ন ভিন্ন একটা অনুভূতি হলো, হয়ত দুটো কারণে, অনেকদিন দেশে ছিলাম, আর আমার প্রিয় জাহাজটিতেই আমাকে পাঠানো হয়েছে। বোটের বাইরে দাড়িয়েই উন্মুক্ত বাতাসে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। বোট ড্রাইভার আমাকে ইশারায় দেখালো, দূরে আমার জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়ত ভেবেছে জাহাজে যোগ দিতে আসা অন্যান সব নাবিকের মতই জাহাজটি আমার অচেনা। দূর থেকে এগুতে এগুতে জাহাজের ছবি তুললাম, ড্রাইডক করে এসেছে গত মে মাসে। বিউটি পার্লার থেকে বের হয়ে আসা ময়দা মাখা সুন্দরী না হলেও সৌন্দর্য্যে এখনও ভাটা পরেনি। জেটি থেকে মাত্র ১০ মিনিট দুরত্বে জাহাজ, এক পাশে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, আরেক পাশে ওই দেখা যায় তালগাছ, মাই ফেয়ার লেডি।
বোট জাহাজের গায়ে ভিড়তেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠা মানে নীচ থেকে উপরে প্রায় ৭০ ফিট, ৭ তলা বিল্ডিং এর সিঁড়ি বেয়ে উঠা, তারপরেও নিজের বাড়ি, লিফট আছে কি নেই কেউ মাথা ঘামায় না। সিঁড়ি বা যাকে আমরা গ্যাংওয়ে বলি, তার মুখে সারেং দাঁড়িয়ে আছে, হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শেক করলাম। সাথে যে দুজন ক্রু রয়েছে তাদের সাথেও হাই-হ্যালো, কেমন আছে জানতে চাওয়া। বেশ বিনম্র ভদ্রলোক, কিন্তু কথা বলল খুব রক্ষণশীলতার সাথে। কারণ যে ব্যাক্তিটি এ মাত্র উঠে এল, সে হল জাহাজের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল চরিত্র, এর ভাল মন্দের উপর নির্ভর করবে জাহাজের পরিবেশ এবং আবহাওয়া। তাই প্রথমে সবাই ক্যাপ্টেনকে একটু মাপার চেষ্টা করে, বুঝার চেষ্টা করে জিনিষটা কেমন, কে জানে কোন চিড়িয়া এল! আমি ব্যাকপেক নিয়ে সোজা ব্রিজে চলে গেলাম, লাগেজ ক্রেন দিয়ে উঠানো হবে, কেউ ক্যাবিনে নিয়ে আসবে। ব্রিজে এসে ক্যাপ্টেন কে পেলাম না, শুধু ব্রাজিলিয়ান থার্ড অফিসার আছে ডিউটিতে। ক্যাবিনে ফোন করেও পাওয়া গেল না, পরে ওয়াকি টকিতে তাকে পাওয়া গেল, সে একটু তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খাচ্ছে।
আমিও চলে গেলাম মেস রুমে, সামান্য খাওয়া ও হবে, সাথে চীফ কুকের কোয়ালিটি যাচাই করা হয়ে যাবে। অফিসার্স সেলুনে বসে ক্যাপ্টেনের সাথে খেতে খেতে কমান্ড হ্যান্ড-ওভারের কাজ শুরু হয়ে গেল। এ জাহাজের সব কিছুই আমার চেনা, জাহাজ সম্বন্ধে জানার কিছুই নেই। জানতে হবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে, কি কি ইকুইপমেন্ট কাজ করছে না, কি কি রিপেয়ার করতে হবে, জাহাজের ভয়েজ কি, কার্গো কি, কবে কোথায় লোড করবে, ইত্যাদি। সব কিছুই ঠিক ঠাক আছে, টেনশনের কিছুই নেই, কমার্শিয়াল বিষয় মানে জাহাজের রুট এবং যারা ভাড়া করেছে, তাদের ব্যাপারে শুনে আরও স্বস্তি পেলাম। জাহাজ ব্রাজিলেই চার্টার করা, মানে ব্রাজিলের এক রিফাইনারি ভাড়া নিয়েছে এক বছরের জন্য। বাইরে থেকে একই সাইজের আরেকটি জাহাজ আসে, যে জাহাজ গুলি সরাসরি পোর্টে ঢুকতে পারে না। সুতরাং গভীর সমুদ্রে গিয়ে দুই জাহাজ কার্গো ভাগাভাগি করে নেয়, এর পর দুজনে বন্দরে আসে ডিসচার্জ করার জন্য। মাসে ৩-৪ টা এমন অপারেশন, হয়ত ১২-১৪ দিন ব্যায় হয়, বাকি সময় নোঙরে বসে থাকে। একজন ক্যাপ্টেনের দৃষ্টিতে এর চেয়ে আরামের কিছু নেই।
এসব আলাপ করতে করতে খাওয়া শেষ, চলে এলাম ব্রিজে। সমস্যা অন্য ক্ষেত্রে, জাহাজে ৫ জন ব্রাজিলীয় নাবিক রাখতে হয়, এটা সরকারী নিয়ম। একজন অফিসার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডেক-ক্রু, আরেকজন ইঞ্জিন ক্রু, আর পঞ্চম জন স্টুয়ার্ড। এদের কোয়ালিটি ভগবানের উপর নির্ভরশীল, কখনও ভালো কখনও খারাপ, সবচেয়ে বড় সমস্যা এরা ইংরেজির জাহাজ। এর সাথে দুঃসংবাদ হলো, আমাদের কোম্পানিতে অন্য জাহাজে একজন এডমিন এসিস্ট্যান্ট থাকে, যারা পেপার ওয়ার্ক, মেইল যোগাযোগ, একাউন্টিং দেখাশুনা করে। এ জাহাজে এমন কেউ নেই, সব অফিসার ভাগ করে এটা করে, যেমন থার্ড অফিসার কিছু কাজ করবে, সেকেন্ড অফিসার বেতন ভাতা টাকা পয়সার হিসাব করবে, চীফ অফিসার বন্ডেড স্টোরের হিসাব করবে, আর ক্যাপ্টেন তাদের হিসাব করবে। সব কোম্পানিতেই এরকম ব্যাবস্থা, তবে আমাদের কোম্পানিতে এসিট্যান্ট নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। তবে ক্যাপ্টেন আশ্বাস দিল যে টেনশনের কিছু নেই, এখানে বেশ সহজ সরল জীবন, খারাপ লাগবে না। এখন দায়িত্ব হস্তান্তর মানে কম্পিউটার নিয়ে বসা, মেইল যোগাযোগ দেখা, কি কি রুটিন মেইল হবে, কার কার সাথে যোগাযোগ হবে, বন্দরে কোন এজেন্ট কি কাজ করে, টারমিনালের সাথে কি যোগাযোগ হয়, আগামী ভয়েজ কবে, এসব বুঝে নেয়া। সব শেষে টাকা পয়সার হিসাব। সেকেন্ড অফিসার টাকা পয়সার হিসাব করে নিয়ে এল, জাহাজে এ মুহুর্তে এত ডলার রয়েছে, দুজনে সেটা স্বাক্ষর করলাম। তারপর ক্যাপ্টেন ক্যাবিনের আয়রন সেফ খুলে টাকা গুনে মিলিয়ে নিয়ে একাউন্টস থেকে তাকে অব্যাহতি দিলাম। ক্যাপ্টেন বলল যে তার যাবার তাড়া নেই, আমি চাইলে সে কালকে যেতে পারে। আরে ভাই জাহাজে তোমার সাথে একদিন থেকে আমার কি লাভ? এই সময়টা ঢাকায় পেলে উপকার হত।
আসলে ঘটনা হয়েছে অন্য, আরেকজন ক্যাপ্টেনকে এখানে পাঠানো হয়েছিল, তাকে রিও এয়ারপোর্ট থেকে রিডাইরেক্ট করা হয়েছে হিউস্টন, আমার যে জাহাজে যোগ দেবার কথা ছিল সেখানে। বললাম অসুবিধা নেই, আমি সামলে নেব, তুমি যেতে পারো, আমি কমান্ড বুঝে নিলাম। অফিসিয়াল লগবুক খোলা হল, সেখানে রেকর্ড করা হল, আমি ক্যাপ্টেন দবির, ঈগল সান এন্টনিয়র মাষ্টার, ব্রাজিলের সালভাদর বন্দরের নোঙরে অবস্থান রত অবস্থায় জাহাজের কমান্ড ক্যাপ্টেন সবিরের কাছে হস্তান্তর করলাম। নীচে দুজনে স্বাক্ষর দিলাম, জাহাজ যে দেশের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করা, তাদের আইন অনুযায়ী অফিসিয়ালি কমান্ড পরিবর্তন হয়ে গেল। এবার একই কথা ইমেইলে লেখা হল, সে মেইল কোম্পানির সমস্ত ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হলো, আউটলুকে সিগনেচার চ্যাঞ্জ হয়ে গেল, অতপর হ্যান্ড শেক, শিপ ইজ ইউরস, আমি বিদায়। জাহাজে মাষ্টার চীফ ইঞ্জিনিয়ার দের দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য সাধারণত ১-২ দিন সময় দেয়া হয়, আমি পেলাম দেড় ঘন্টা।
তাকে বিদায় দিয়ে বসলাম আমার ডকুমেন্টেশন নিয়ে। আরেকটি খারাপ খবর হলো ব্রাজিলিয়ান থার্ড অফিসার সাইন-অফ করে গেছে, কিন্তু কোন রিলিভার পাঠানো হয় নি, সুতরাং একজন অফিসার কম। ফয়সাল নামে একজন ভারতীয় থার্ড অফিসার রয়েছে, সে অধিকাংশ ডকুমেন্টেশন করে, একদম অল্প বয়স্ক, কিন্তু কাজে কর্মে স্মার্ট। ওকে নিয়ে বসে দেখে নিলাম কি কি ফাইল আছে কোন কোন ফোল্ডারে, রুটিন কি কি মেসেজ কোথায় পাঠাতে হয়। সেকেন্ড অফিসার চার্লস বিশাল হাসি দিয়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করল, এবং জানান দিল যে আমার আসার খবর সে সবাইকে বলেছে। ওর সাথে ৬ বছর আগে তিন সপ্তাহ এক জাহাজে ছিলাম, মানে আমার সম্বন্ধে মোটামুটি জানে। আরও জানান দিল, জাহাজে যে ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার আছে, সে ও আমাকে চেনে, আগে সেইল করেছি। আরও আছে বাংলাদেশী সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার ও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার। সেকেন্ড ইনিজিনিয়ারের সাথে সেইল করিনি, কিন্তু খুবই পরিচিত, এক সাথে মালায়সিয়াতে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, তখন থেকে যোগাযোগ, এবারেই প্রথম এক জাহাজে। সুতরাং বলা চলে জাহাজে আমি অপরিচিত নই। এর পর ক্যাবিনে এসে লাগেজ খুলে আমার কাপড় চোপড় সহ সবকিছু সাজিয়ে রাখলাম, শুরু হল আমার আগামী কয়েক মাসের নূতন সংসার। সন্ধ্যায় ডিনারে কয়েকজনের সাথে পরিচিত হলাম। রাশিয়ান চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর ইউক্রেইনের চীফ অফিসার, দুজন জাহাজের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন ব্যাক্তি, বলতে গেলে এরাই জাহাজ চালায়, আমি নাম-কা-ওয়াস্তে মাষ্টার বা ক্যাপ্টেন।
জাহাজ নোঙরে আছে, আমাদের পরবর্তি ভয়েজ ৬ তারিখে, সুতরাং কয়েকদিন সময় পাব গুছিয়ে নেবার জন্য। রাতে ডিউটি অফিসারদের বলে ঘুমাতে গেলাম, বললাম কোন ফোন আসলে, বলবে আমি দীর্ঘ ভ্রমন করে এসেছি, ইমারজেন্সি ইস্যু না হলে যাতে পরে ফোন করে বা ক্যাপ্টেন উঠলে আপনাকে ফোন করবে। এভাবেই শেষ হলো প্রথম দিন, কিংবা শুরু হলো ভাসমান সংসার। শুভ রাত্রি। ৩০ নভেম্বর, ২০২২
লেথক: ক্যাপ্টেন আবদুল্লাহ মাহমুদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে