দূষণের কারণে তিতাস পারের শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুকি বেড়ে গেছে।

0
555
শহরের পৌরবর্জ্যসহ বিভিন্ন ধরণের ক্যামিকেল মিশ্রিত দুষিত পানি, বাজারের আবর্জনা, গৃহস্থালি বর্জ্যসহ সকল পয়োবর্জ্য এই নদীতে ছেড়ে দেয়ার কারণে দুষিত প্লাবণ ভূমিতে এই শহরের শিশুরা নিয়মিত খেলাধুলা করতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি : নোঙর নিউজ

বাংলাদেশের নাম জানা-অজানা, ছোট-বড়, বিভিন্ন আকৃতি-প্রকৃতির নদীর মধ্যে তিতাস একটি নদীর নাম। তিতাস একটি ছোট্ট নদী। ঠিক নদীও নয়; ভূগোলতত্ত্বের ভাষায় এটি একটি উপনদী বা শাখানদী। আকৃতিতে বক্র এই নদীটি আঞ্চলিক ইতিহাসের আলোকে সে কেবলই মেঘনার দুহিতা।

তিতাস ও মেঘনা নদীকে ঘিরে অনেক উপকথা প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে একটি উপকথায় বলা হয়েছে যে, তিতাস নদী মেঘনার কন্যা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত বিখ্যাত উপন্যাস “তিতাস একটি নদীর নাম” এর কারনে এই নদীটি সুনামের শিখর স্পর্শ করেছে, পেয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি।

বর্তমান তিতাস নদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগর থানার অধীনে অবস্থিত চাতলপাড় নামক স্থানের নিকট মেঘনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বমুখে প্রবাহিত হয়ে চান্দোরা গ্রামের উত্তরে পশ্চিম-দক্ষিণমুখে অগ্রসর হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিকট পূর্ব-দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়ে আখাউড়া রেল জংশনের দক্ষিণে পশ্চিম-উত্তর মুখে গিয়ে নবীনগরের পশ্চিমে লালপুরের নিকট মেঘনা নদীতে পতিত হয়।

নদীটি একটি ইংরেজী ‘এম’ আকারে বর্তমানে প্রবাহিত হচ্ছে এবং চাতলপাড় থেকে লালপুরের দূরত্ব মাত্র ১৬ মাইল হলেও সমগ্র নদীটি বর্তমানে প্রায় ১২৫ মাইল দীর্ঘ।

এটিই বর্তমানে সরকারীভাবে তিতাস নদী নামে পরিচিত।(কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, জেলা পরিষদ, কুমিল্লা, পৃ ৯) তিতাস আগে জলময়ও ছিলো, এখন তা নেই।

প্রাকৃতিক কারণে নয়, মানুষের কারণে এমনটা হয়েছে। নদীর অনেক ধারা বা জলা কেবল বর্ষাকালে জেগে ওঠে। অথচ শত শত বছর ধরে এই বাঙ্গালীর জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে নদী প্রধান ভূমিকা পালন করে গেছে। মেঘনা ও তিতাস ও এর বেতিক্রম নয়। অতীতে এই জনপদের মানুষের জীবন কেটেছে নদীর জলে স্নান করে-সাঁতার কেটে, নদী নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্য করে।

কিন্তু এখন পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।যেখানে বড় বড় মালবাহী কার্গো, পণ্যবাহী পালতোলা ও দড়িটানা (গুনটানা) নৌকা যাতায়াত করতো সেখানে এখন চলে ভটভটি।

মেঘনা ও তিতাস নদীর আজ এই দূরাবস্থার পেছনে রয়েছে তিনটি প্রধান কারণ, যথা ১) ভরাট ২) দখল ৩) দূষণ। জল সম্পদের অতি উত্তোলন ও নিস্কাশনের কারনে ও নদীর এই দুরাবস্থা।এসব কারনে তিতাস রূপ-লাবণ্য হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় চর জেগেছে। নদীকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহকারীরা তাদের জৌলুস হারিয়েছেন অনেক আগেই। খরস্রোতা তিতাসের বিশালতা এখন শুধুই সোনালি অতীত।

নদীতে আগের মতো মাছ নেই। যা আছে তা-ও কারেন্ট জাল এবং ঘের বানিয়ে আহরণ করছেন প্রভাবশালীরা। এতে মালোপাড়া অনেকে জেলে তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। স্থানীয় জেলেদের মতে নব্বই এর দশকে ও কাঁচকি, রিটা, হালনি, পাবদা, অন্তত ২০০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত তিতাসে যা এখন দাড়িয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতিতে। তাও বর্ষা মৌসুমে। শুষ্ক মৌসুমে পাওয়া যায় বোয়াল, লাটি, পুঁটি, টেংরা, মেনিসহ কয়েক প্রজাতির মাছ।

ইতোমধ্যে ১১০ কিলোমিটার নদীর ১০৩ কিলোমিটারের বিভিন্ন অংশে পলি জমে ও ভরাট হয়ে চর জেগেছে। পৌরবাসির আবর্জনার স্তূপ ও অনেকটা দায়ী নদী সংকুচিত হওয়ার পিছনে। নদীর বিভিন্ন অংশে তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনসহ শতাধিক স্থাপনা।

নদীর পানি দূষণের কারনে কমে গেছে শাপলা, শালুক, মাছ, পোকামাকড় ও শামুক। ফলে নদীকে কেন্দ্র করে পাখির প্রাকৃতিক খাবারের উৎস অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে যার ফলে হ্রাস পাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাশদিয়ে বয়ে চলা তিতাস নদীর দুই পাড়ের জেলে, মাঝি, কৃষক এবং সাধারণ পরিবারগুলো এক দূষিত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে। শহরের পৌরবর্জ্যসহ বিভিন্ন ধরণের ক্যামিকেল মিশ্রিত দুষিত পানি, বাজারের আবর্জনা, গৃহস্থালি বর্জ্যসহ সকল পয়োবর্জ্য এই নদীতে ছেড়ে দেয়ার কারণে দুষিত প্লাবণ ভূমিতে এই শহরের শিশুরা নিয়মিত খেলাধুলা করতে বাধ্য হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়ায়া শহরের উভয় দিক থেকে সুয়ারের পাইপের মাধ্যমে কয়েক ধরণের বিষাক্ত আবর্জ্যনা নিক্ষেপ চলমান আছে এখনো যা সরাসরি তিতাস নদীকে দূষণ করছে। কান্দিরপাড় খাল এবং শহরের টাউন খাল দূষণের কারনে তিতাস নদী পারের শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুকি বেড়ে গেছে ৯০%। তিতাস নদীর জলজ প্রাণি কমে গেছে বহুগুণ। এ ছাড়াও নারী, যুবক, যুবতী, বয়স্ক নারী-পুরুষ, গবাদিপশু, পাখিদের জন্য এখানকার প্রকৃতি পরিবেশ, প্রতিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

যে তিতাসের সৌন্দর্য্য ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়; যে নদী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আত্মপরিচিতির প্রতীক সেই নদীর প্রাণ ও সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনতে দরকার খনন-কাজ। দখল-দূষণ বন্ধেও নিতে হবে পদক্ষেপ।

তাই নদী নিরাপত্তার সামাজিক সগঠন নোঙর এর আহবানে শুধু তিতাস নদী নয়, দেশের সব নদ-নদী সুরক্ষায় জাতিকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

কেননা নদী বাঁচলেই বাঁচবে দেশ, দেশের মানুষ। সুন্দর আগামীর জন্যই তাই আমাদের সবার আহবান নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও।

লেখক: ফেবিন রহমান, সম্মানিত সদস্য, নোঙর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে