রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও তথ্যবিভ্রান্তি

0
1553


বুধবার ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ (নোঙরনিউজ ডটকম): দেশটা আমাদের সবার। তাই দেশের প্রতি সবার কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। সরকার দেশ পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের দেশ পরিচালনার জন্য পাঁচ-দশ বছরের ক্ষমতার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয় নয়। তবে রাজনীতিবিদদের ভালো-মন্দ কাজের সাথে দেশের উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব জড়িত। দেশে বসবাসের পরিবেশ এবং উন্নয়ন নিয়ে সচেতন নাগরিকেরা যে মতামত দেবেন, সরকার তা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক কাজটি করবে, সেটাই সবার প্রত্যাশা। সত্যিকারের উন্নয়ন কখনো মানুষকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে না। কিন্তু রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। পক্ষে কথা বলছেন শুধু প্রকল্পের সাথে জড়িত সুবিধাভোগী, সরকারদলীয় নেতা বা আস্থাভাজন ব্যক্তিরা। পক্ষান্তরে ইউনেস্কো, কয়লা বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সুশীলসমাজের সদস্য, সচেতন নাগরিকসমাজ, রাজনীতিক, দেশী-বিদেশী পরিবেশকর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ সবাই বলছেন রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হুমকির মুখে পড়বে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। রামপাল কয়লা বিদ্যুতের বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সরকার রামপালবিরোধীদের যৌক্তিক মতামত অগ্রাহ্য করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অনড় ও একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে জনমত সৃষ্টি এবং সরকারদলীয় স্থানীয় রাজনীতিকদের ব্যবহার করে যেকোনো উপায়ে এটা বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) একটি প্রতিনিধিদল গত বছর মার্চ মাসে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও সুন্দরবন পরিদর্শন করেছে।

বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রতিবেদনে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির কারণে বাংলাদেশ সরকারকে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার রামপাল প্রকল্পে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেইÑ এটা ইউনেস্কো ও বিশ্ব ঐতিহ্য কর্মকর্তাদের জানানোর জন্য গত অক্টোবর মাসে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সফরের পরও ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। ২০১৭ সালের ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভায় সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইউনেস্কো রামপাল নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেটা জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অনুমোদন করেছেন। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের অনুমোদনের পর সরকার যদি রামপাল প্রকল্প থেকে সরে না আসে তবে আগামীতে বাংলাদেশের অবস্থান ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলের (জিসিএফ) নীতিনির্ধারণী ফোরামের স্থায়ী সদস্যপদ হারিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮Ñ এ তিন বছরের জন্য জিসিএফ স্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল বাংলাদেশ; কিন্তু দায়িত্ব শেষ করার দুই বছর আগেই স্থায়ী সদস্যপদ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন করে স্থায়ী সদস্যপদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আফ্রিকার দেশ মালাবিকে। এরই মধ্যে এ তহবিল থেকে বাংলাদেশের জন্য আট কোটি ডলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং আরো আট কোটি ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থায়ী সদস্যপদ হারানোয় ভবিষ্যতে এ তহবিল থেকে টাকা পাওয়া বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬)।
প্রধানমন্ত্রী ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আইইবি’র অনুষ্ঠানে বলেছেন, রামপালে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে সেটি ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ পাওয়ার প্লান্ট। পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আমরা তৈরি করছি।’ প্রধানমন্ত্রী ২৭ আগস্ট ২০১৬ সংবাদ সম্মেলনেও রামপালে ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ পাওয়ার প্লান্টের কথা বলেছিলেন। দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, তাকে সঠিক তথ্য থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। এখানে দুটো বিষয় বলা খুবই জরুরি। প্রথমত, সর্বশেষ আধুনিক কয়লা বিদ্যুৎ প্রযুক্তি হচ্ছে ‘অ্যাডভান্সড আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’, দ্বিতীয়ত, রামপাল প্রকল্প তৈরি হচ্ছে ‘সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে’।

রামপাল প্রকল্পের প্রযুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারতীয় নাগরিক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য ২৭ অক্টোবর ২০১৬ টেলিফোনে দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীতে নেই। মূলত সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণকে কেউ কেউ আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে থাকে।’ তাহলে প্রশ্ন জাগে, আপনারা কেন আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের কথা এত দিন বলে এসেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘আপনাদের এখানে এত পণ্ডিত, এটি জানতাম না।
রামপাল বিরোধিতাকারীরা না জেনেই এর বিরোধিতা করেছে। আমাদের এত নাটক করার দরকার নেই। আপনাদের এখানে নাটকবাজি হয় বলে প্রথমে বলেছিলাম, আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মাণ করা হবে।’ আলটা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বিশ্বে নেই বলে বিআইপিসিএলের এমডি দাবি করলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাতা ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল) এনটিপিসির সঙ্গে যৌথভাবে একটি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে চুক্তি করেছে। গত ১৬ আগস্ট ভেলের ওয়েবসাইটে এ তথ্য দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ১০ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অ্যাডভান্সড আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য ভেলকে ২৩০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। অ্যাডভান্সড আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা গেলে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির তুলনায় ৫ শতাংশ কয়লা কম পুড়িয়ে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। তথ্য গোপন বা প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে রামপাল দরপত্রের বি-১, তাপীয় জেনারেটর কেন্দ্র চ্যাপ্টারের বি-১-১ পাতায়, সেখানে পাওয়া গেছে কেন্দ্রটি কোন প্রযুক্তির হবে। দরপত্রের ওই অংশে বলা হয়েছে, জেনারেটরটি হতে হবে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। দরপত্রে যখন উল্লেখ রয়েছে কেন্দ্রটি হবে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির, সেখানে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ নেই। (সূত্র : কালের কণ্ঠ ২৯ অক্টোবর ২০১৬)। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ভেল তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৬০টি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে; তার মধ্যে ভারতেও ৯টি আলট্র্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।

১২ এপ্রিল ২০১৩ রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্রের ‘পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ)’ বিষয় জনমত পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে পিডিবি। সেখানেও সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত সুন্দরবন সুরক্ষা আন্দোলনকে প্রভাবিত করতে প্রকল্পকে আলট্রা সুপার রূপ দেয়া হয়েছে। বিআইপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্যের উপরিউক্ত বিরূপ মন্তব্যের পর সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি তার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সরকার প্রযুক্তি বা উজ্জ্বল বাবুর বক্তব্য নিয়ে আর কোনো ব্যাখা দেয়নি। গত ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ বিরোধীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মানুষের জন্য তাদের কোনো দুঃখ নেই, কোনো কান্না নেই, মানুষের ভালোমন্দ দেখার দরকার নেই, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য তারা কাঁদছেন’ ইত্যাদি…। অথচ তিনিই ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বাঘ রক্ষা সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। আর সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আসুন আমরা সবাই মিলে বাঘ বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই।’ আমরা তার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুন্দরবন বাঁচানোর জন্য রামপালবিরোধিতা করছি। রামপাল প্রকল্পের জন্য এখনো কোনো দেশের সাথে কয়লা আমদানি চুক্তি করা হয়নি। সুতরাং রামপালে ভারতের নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই!

ভারতীয় কয়লা সচিব অনিল স্বরূপ গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বলেছেন, ‘আমাদের আট কোটি টনেরও বেশি কয়লা মজুদ রয়েছে। জুলাই মাসে বাংলাদেশের সাথে ১৩২০ মেগা বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি হয়েছে, তাই কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড আলোচনা করছে, আমরা যদি বাংলাদেশে কিছু কয়লা রফতানি করতে পারি। আমরা কয়লা এখন আর কোথায় জমা করব?’ বিশ্ব যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক শক্তি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আমরা নতুন করে ধাবিত হচ্ছি কয়লার মতো দূষিত জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে। সরকার দাবি করছে, দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। সেটা বলতে গেলে, অর্জন হয়েছে কয়লা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই। তাহলে প্রশ্ন আসছে, আমাদের প্রজন্মকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে নোংরা জ্বালানি কয়লা নিয়ে এত আগ্রহ কেন? দীর্ঘকাল থেকে আমরা ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আসছি। যেহেতু তেলের দাম আমাদের ক্রয়সীমার মধ্যে আছে, তাই আপাতত আমরা তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারি।
কয়লাদূষণ থেকে মুক্তি পেতে ভারত নিজেই এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। দূষণের কারণে গত বছর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারত চারটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প (১৬,০০০ মেগাওয়াট) বাতিল করেছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি থেকে এক লাখ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি ভারতের আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেড’ তামিলনাড়– রাজ্যে বিশ্বের অন্যতম বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে সংস্থাটির ধারণা। আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির মতে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতবাসী যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি বিশ্বের জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব রোধে অনুকরণীয় হবে ভারত। এখানে উল্লেখ্য, নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। সৌর জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২০২২ সালের মধ্যে ১০০ গিগাওয়াটে উন্নীত করার ঘোষণা দেন তিনি। শ্রীলঙ্কা ভারতের এনটিপিসির সাথে ২০০৬ সালে ৫০০ ইউনিটের দু’টি, অর্থাৎ ১০০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তি করেছিল। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ শ্রীলঙ্কার সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ ও আপত্তি আমলে নিয়ে তা বাতিল করে দেন। এভাবে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সবাই কয়লা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

সর্বোপরি, রামপাল হলো প্রাকৃতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ১৮৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে যত মানুষ মারা গেছে, তার ৪৯ শতাংশই বাংলাদেশে। ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে যথাক্রমে প্রায় পাঁচ লাখ এবং এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায় (সূত্র : বাংলাদেশ রিসার্চ পাবলিকেশনস জার্নাল, আইএসএন : ১৯৯৮-২০০৩, ভলিউম: ৪, ইসু: ৩, পাতা ২২০)। ২০১৩ সালের ১৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে ভয়াবহ সিডরের আঘাতে প্রায় ৩৫ লাখ বাড়িঘরে পানি উঠে গিয়েছিল। ২০৫০ সালের মধ্যে এ ধরনের কমপক্ষে ৫০টি ভয়াবহ ঝড় হতে পারে এবং প্রায় ৯৭ লাখ মানুষের বাড়িঘর ও কৃষিজমি তিন মিটারের বেশি পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো আগলে রাখে। সিডর বা আইলার মতো ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হলে পশুর নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোতে হাজার হাজার টন ছাই বা কয়লা বর্জ্য সুন্দরবনসহ উপকূলের সব জনপদে ছড়িয়ে পড়বে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ছাইপুকুর বা কয়লা গুদাম রক্ষা করবে কে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়লা পোড়ালে বায়বীয়, কঠিন ও তরল এই তিন ধরনের দূষণ ঘটে। কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সালফার ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। সৃষ্ট ছাইয়ের ভেতরে পারদ, সিসা ও আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতব থেকে যায়, যা মাটি ও পানি দূষিত করে। দুঃখজনক হচ্ছে, রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে ছাড়পত্রদাতা প্রতিষ্ঠান হলো সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘সিইজিআইএস’। এদের জরিপ-গবেষণা, অতঃপর এ ধরনের সংবেদনশীল স্থানে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ছাড়পত্রে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা সরকারকে বিনীত অনুরোধ করব, রামপাল বিরোধীদের তথ্য যাচাই করার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) পুনরায় করুন এবং প্রকৃত লাভ-লোকসানের চিত্র দেখুন। ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারে না। অথবা গণভোট দিয়ে এ বিষয়ে দেশের মানুষের মতামত নিন।

পরিশেষে সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, ‘বাংলাদেশের ফুসফুস’ হিসেবে খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকার উৎস এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রামপাল কয়লা প্রকল্প বাতিল করুন অথবা সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিন।

লেখক: চেয়ারম্যান, সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন
Email : farid.dac@gmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে