‘নোঙর’ কোথায় নোঙর ফেলছে’ : মনির জামান

0
1201

মনির জামান : আমরা প্রতি বছর ২৩ মে উদযাপন করি একারনে যে, ঐ দিনটিতে মেঘনা বক্ষে সংগঠিত হয়েছিল স্বরণকালের ভয়াবহ নৌ-দুর্ঘটনা। ঐ রাতে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গিয়ে ছিল এমভি লাইটিং সান। শলিল সমাধি হয়ে ছিল দুই শতাধিক জনের। যাদের মধে ছিল তরুণ সংস্কৃতি কর্মী সুমন শামসের মা আছিয়া বেগম (৫০)। শামসের মায়ের মৃত্যুকে স্বরণ করে আমরা নৌ নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসি এবং কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা রোধ করতে পারি না। তথাপি নদী তীওে বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সাইক্লোন মেসন্টার নির্মাণ করে উপকূলীয় ঝড়Ñজলোচ্ছাসজনিত মৃত্যু কমাতে সক্ষম। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নৌ, সড়ক ও বিমান দুর্ঘটনার মত দুঃখজনক বাস্তবতা নিয়ন্ত্র্রণে আমরা কতটা সচেতন Ñ এ ব্যাপরে প্রশ্ন রাখা যায়।

২০০৪ সালে মেঘনা গর্র্ভে এমভি লাইটং সান নামের লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার আগে পরে বাংলার নদ-নদীতে আরো বহু নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৪ সাল থেকে নৌ দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় দশ হাজার জন যাত্র্রী। এসব দুর্ঘটনা কবলিত নাগরিকের জন্য কর্তৃপক্ষ তেম কোনো প্রনোদনা রাখেনি। এখনো নৌপথে যাত্রী সাধারণের বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত নয়। প্রতি বছরের এতো সব দুর্ঘটনার সত্বেও নৌযানগুলো চলছে যথাযথ ফিটনেস ছাড়া এবং মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে। নৌযানের কর্মীরা অদক্ষ এবং কর্র্তব্য অবহেলার অভিযোগে দুষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ হলো, দুর্ঘটনা কবলিত নৌযান নদীগর্ভ থেকে তুলে আনার মতো কারিগরি সক্ষমতা আমাদের কর্তৃপক্ষের এখনো তৈরী হয়নি। তদুপরি যথাযথ কর্তৃপক্ষের রয়েছে মানসিক দীনতা। লঞ্চ মালিক এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ দুর্যোগ কবলিত যাত্রীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতেও কার্পণ্য করে। এক কথায়, ঐতিহাসিক অবহেলার শিকার এই দেশের নৌযাত্রীগণ এবং আমাদের নদীগুলোও দীর্ঘ দিন ধরে দখল-দুষণের মত অযাচিত বাস্তবতা অতিক্রম করছে। এসব নানান কারনে আমরা নোঙর’র ব্যানারে ২৩ মে কে জাতীয় নৌ নিরাপত্তা দিবস গণ্য করে ২০০৪ সাল থেকে জনসাধারণের মধ্যে গণসচেতনতামূলক প্রচারÑ প্রচারণার কাজ শুরু করি।

বলা দরকার, নদীর গতীপথ ও নব্যতার সঙ্গে যাত্রী নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভর শীল আমাদেও নদ-নদী খাল-বিল বহুলাংশে নব্যতা হারিয়ে জল প্রবাহে বিঘœ সৃষ্টি করছে বহুযুগ ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুষণ, দখলের মতো অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা। যা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে না পারলে দুর্ঘটনা, মৃত্যু, বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তা জনজীবনকে আরো ভীতিকর অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে। এতে করে বাঙালীর জাতিগত অগ্রযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়বে। এ কারনে আমরা সীমিত সাধ্য নিয়ে নোঙর’র ব্যানারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যে সব শ্লোগান ব্য্যবহার করছি সেগুলো হচ্ছে Ñ নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, করতে হবে। নদী বাঁচান, দেশ বাঁচান। ঝুঁকিপূর্ণ নৌযাত্রা বন্ধ করুন। ত্রুটিপূর্ণ নৌযান উঠিয়ে নিন। নদীতে বর্জ্য নিস্কাষণ বন্ধ করুন। নদীর পাড়ে বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করুন। যৌথ নদীপ্রবাহে ন্যয্য হিস্যা চাই। নদী দখল, নদী ভরাট গুরুতর অপরাধ। উজানে বাঁধ নির্মাণ চলবে না, বন্ধ কর। ইত্যাদি।

নদীর জন্ম মৃত্যু আছে। সেটা প্রকৃতিক। কিন্তু দুষণ, দখল এবং নৌ দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের। নৌ-মন্ত্রণালয়, নদী কমিশন, নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা অকার্যকর ও ভূল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলে আমারা তাদেরকে আরো কার্যকরী করে তুলতে চাই। কারণ, এ সব সরকারী দফতরের মালিক জনগণ। আমরা কাজ করতে চাই নৌযান মালিকদের মধ্যে। কারণ, তারা মুনাফাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যাত্রী অধিকারকে পদ দলিত করছে বার বার। একই সঙ্গে আমরা নদীর পাড়ের কল কারখানার মালিকদের সচেতন করে দিতে চাই। তারা যেন রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে নিক্ষেপ করে মারাত্বক ভাবে জলদুষণ তৈরী করে। এ জন্য নদীর পাড়ের কারখানাগুলোর উপর কার্যকরী নজরদারী করা দরকার। দুর্নীতি ও সেচ্ছাচারীতার এই যুগে দখলদারদের কবলে পড়েছে নদী ও নদীর পাড়। এদের বিরুদ্ধে সরকারের দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। এ জন্যই ‘নোঙর’ নদী বাঁচান, দেশ বাঁচান সেøাগানটিকে উর্দ্ধে তুলে ধরতে চায়।

নৌ-দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ইতোমধ্যে আমরা অনেকগুলো প্রচারাভিযান, পরিচালনা করছি। গত কয়েক বছরে দেশের প্রধান লঞ্চঘাট, বন্দর, ফেরিঘাটে সমাবেশ, মানববন্ধন করছি। এতে অংশ নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ। আমরা পোষ্টার, ফেস্টুন, ব্যনার প্রদর্শনী এবং লিফলেট বিতরণ করছি। আমাদের নদী বিষয়ক মুখপত্র নোঙর প্রকাশনার মাধ্যমে এ বিষয়ে দেমের প্রধান ও বিশেষজ্ঞ লেখকগণ তাঁদের মূল্যবান লেখা প্রকাশ করেছেন।
সুমন শামস এর পরিকল্পনা, গবেষণা ও সঞ্চলানায় আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনে নদী নিরাপত্তার ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্র নোঙর নিয়মিত সম্প্রচার করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় এবং থানা পর্যয়ে নোঙর এর কমিটি গঠনের মাধ্যমে নদী বাাঁচান, দেশ বাঁচান শ্লোগানটিকে আরো জোরালোভাবে বেগবান করার কাজ করছি। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে আর কখনো নৌ-দুর্ঘটনা ঘটবে না; নদী দুষণ এবং নদী দখল চিরতওে বন্ধ হবে। আমরা আরো চাই যে, বিশ্বের যে কোনো রাষ্ট্রিয় সীমানার এপারÑওপার কোথাও জলপ্রবাহ অন্যয্যভাবে বাঁধাগ্রস্থ হবে না।

স্বরণ করিয়ে দিতে চাই Ñ বাংলাদেশ একটি পলি বাহিত বদ্বীপ। এর স্থলভাগকে ঘিওে আছে মিঠা পানির শত শত জল প্রবাহ। এসব নদ-নদী, খাল-বিলইÑ এ অঞ্চলে মানুষের জীবন প্রবাহের প্রধান উপায়। আর এসব জল প্রবাহের উৎস হিমালয় পর্বতমালা। উত্তর হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত মিঠা পানির যে ধারা প্রবাহিত হচ্ছে নানান নদ-নদী দিয়ে তার উপর অধিকার নেপালী থেকে ভারতীয় সাগর পাড়ের প্রান্তিয় বাঙালী Ñ সবার। এসব জল প্রবাহে রাজনৈতিক কর্তৃত্বারোপ ঘোরতর অন্যায়। আমরা এই আর্ন্তজাতিক অপরাধের প্রতিবাদ জানাই। এতে করে আমাদের এই ভাটি অঞ্চলের নদী মরে গিয়ে মরূ প্রকৃয়া দেখা দিচ্ছে। নদ-নদী, খাল-বিলের জল প্রবাহকে বাঁধা প্রদান করে শতশত বছর ধরে যেসব রেল ও সড়কপথ নিমার্ণ করা হচ্ছে, যার ফলে ভাটির দেশে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যা, মৌসুমি ঢল যেখানে আটকে গিয়ে মানুষের বাস্তুভিটা ও ফসলি জমিকে তলিয়ে দিচ্ছে প্রতি বছর। এসব দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সমাধানের কথ্ াবলতে চায় ‘নোঙর’। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা কিন্তু নদী প্রবাহ প্রাকৃতিক।

নদী বাঁচিয়ে রেখেই আমাদের নগরায়নেরন কথা ভাবতে হবে। যেসব নদী নগরের ইটপাথরের নিচে চাঁপা পড়ে গেছে আমরা সেগুলোর পুনরুদ্ধার দাবী করছি। আমরা সেখানেই ‘নোঙর’ করতে চাই যেখানে সংকট ঘনিভূত। আমরা অবমুক্ত করতে চাই জল প্রবাহের বাঁধা। ভাসতে চাই নিরাপদ পালতোলা নৌকায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে