উন্নয়নের নামে অনিয়ম, দুর্নীতিতে সক্ষমতা হারাচ্ছে চাঁদনীঘাট পানি শোধনাগার

0
796
রাজধানীর পানির মোট চাহিদার ৫ ভাগ আসে বুড়িগঙ্গা থেকে। বুড়িগঙ্গার পানি প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে। ছবি : নোঙরনিউজ

ঢাকা, ৩০ নভেম্বর, ২০১৭ (নোঙরনিউজ) : মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতির ব্যবহার, সংস্কারহীনতা, দুর্নীতি- অনিয়ম, অযত্ন আর অবহেলার কারণে চাঁদনীঘাট পানি শোধনাগার ক্রমশ সক্ষমতা হারাচ্ছে। এক সময় এ শোধনাগারটির মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে আড়াই কোটি লিটার পানি শোধন করে তা ঢাকাবাসীর মাঝে সরবরাহ করা হতো। এখন এই সরবরাহ দেড় কোটি লিটারে নেমে এসেছে। তবে ওয়াসার লক্ষ্য ছিলো এই শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন চার কোটি লিটার পানি শোধনের। সেই লক্ষ্য পূরণ ব্যর্থ হয়েছে।

চাঁদনীঘাট পানি শোধন কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত একাধিক টেকনিশিয়ান বলেন, ১৯৯৭ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে এই পানি শোধনাগারটি আধুনিকায়ন করা হয়। এর পর থেকে এই শোধনাগারটি সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে।

চাঁদনীঘাট পানি শোধন কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায়, যথাযথ কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে শোধনাগারের সক্ষমতা না বাড়িয়ে এর উন্নয়নের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোপাট করছে। অথচ উন্নয়ন কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ছাড়া পুরান ঢাকায় ওয়াসা দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ ব্যাপারেও প্রতি বছর মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ থাকলেও রহস্যজনক কারণে পানি থেকে দুর্গন্ধ দূর হচ্ছে না কিছুতেই। পানি শোধনাগার হাউজটি দীর্ঘদিনেও পরিষ্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় তাতে শ্যাওলা ধরেছে বহু আগেই। জমা হয়েছে তলানিতে। যা রীতিমত অস্বাস্থ্যকর।

তবে ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কস’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুজাবত আলী তালুকদার বলেন, শোধনাগারের সক্ষমতা কমেনি। বর্ষা মৌসুমে সরবরাহ বাড়ে। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর নাব্যতা হ্রাস আর বিদ্যুত্ সংকটের কারণে এর সরবরাহ কমে যায়। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে দেড় কোটি লিটার পানি শোধনের মাধ্যমে পুরান ঢাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

চাঁদনীঘাট পানি শোধন কেন্দ্রে। ফাইল ফটো

লালবাগ ও চাঁদনীঘাটে সরেজমিনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর পচা পানির দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে। নদীর দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত দূষিত পানি বিশাল আকৃতির পাইপের মাধ্যমে উত্তোলন করে তা পরিশোধন করে নগরবাসীকে খাওয়াচ্ছে ওয়াসা। পুরান ঢাকার সিংহভাগ এলাকায় সরবরাহকৃত ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। উন্মুক্ত শোধনাগারের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক ও কাক গোসল করছে। একই সঙ্গে তারা পানিতে মল-মূত্র ত্যাগ করছে।

বিশেষ করে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট, চকবাজার, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, শেখ সাহেব বাজার রোড, নাজিমউদ্দিন রোড, সিক্কাটুলী, সুরিটোলা, আগামাসি লেন, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড, বাংলাবাজার, সদরঘাট, শাঁখারীবাজার, বংশাল, ফরাশগঞ্জ, কাগজিটোলা, কলুটোলা, লক্ষ্মীবাজার, উর্দুরোড, ওয়ারী, নারিন্দা, যোগীনগর, বনগ্রাম, লালবাগ, হাজারীবাগ, চম্পাটুলি লেন, গেন্ডারিয়া, ফরিদাবাদ, সামসাবাদ লেন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ধলপুর, মানিকনগর, শ্যামবাজার, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, নবাবপুরসহ পুরান ঢাকার সিংহভাগ এলাকায় ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, রাজধানীর পানির মোট চাহিদার ৫ ভাগ আসে বুড়িগঙ্গা থেকে। বুড়িগঙ্গার পানি প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নানা প্রক্রিয়ায় এ পানি শোধন করছে। তবে ওয়াসার এ শোধন প্রক্রিয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। তিনি নগরবাসীর পানি সমস্যা সমাধানে ওয়াসার মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ওয়াসা এমন একটি সংস্থা যেখানে উন্নয়নের চেয়ে দুর্নীতি হয় বেশি। ওয়াসার কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী পানি সরবরাহের চেয়ে পানি বাণিজ্য নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এসব বন্ধ হলে নগরবাসীর নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ অসম্ভব কিছু না।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা বর্তমানে চারটি পানি শোধনাগার ও ৭৩৮টি গভীর নলকূপের সাহায্যে নগরীতে পানি সরবরাহ করছে।

প্রতি বছর বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে পানি শোধনে অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে হয়। ফলে এ সময় শোধনাগারের পানির স্বাদ ও গন্ধে কিছুটা পরিবর্তন আসে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার দৈনিক ২১২ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে উত্পাদন ছিল ১৮৮ কোটি লিটার। আর বর্তমানে দৈনিক ২৩৫-২৪০ কোটি লিটার চাহিদার স্থলে পানির উত্পাদন সক্ষমতা ২৪৫ কোটি লিটার। পানির সিস্টেম লস ৪০ ভাগ থেকে ২২ ভাগে নেমেছে। রাজস্ব আয় ৩০০ কোটি থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা হয়েছে। তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে