নাবিকের সমুদ্র কথন (পর্ব-৪৮) : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
507

ছবি: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ : নাতিদীর্ঘ সমুদ্র ভ্রমণের পর কাল এসে নোঙর করেছিলাম। এরপর দিনের বাকি অংশ টুকু কেটেছে ব্যস্ততায়। রাতে কোন কাজ না থাকলেও একধরনের উদ্বিগ্ন ছিলাম। জাহাজ এসেছে কিন্তু কেউ কোন খবর নিচ্ছেনা। আইনানুগ ভাবে এতে আমাদের কোন দোষ নেই, তার পরেও যখন একটি দাপ্তরিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়, ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এরকম কিছু এখনও নেই। এজেন্ট একটি মেইল করেছে, যে আমাদের জাহাজ আজকে সন্ধ্যায় বন্দরে ভিড়তে পারে। আরও বিস্তারিত জানার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে যেন ভি-এইচ-এফ চ্যানেল ১৬ বা ৮ এ যোগাযোগ করি। আরে ভাই সেটা তো অবশ্যই করব কিন্তু একা একা তো কথা বলা যায় না! আমি ডাকলাম আরেক পক্ষ চুপ থাকবে তাহলে কথা হবে কিভাবে। হ্যাঁ এটাই সত্যি, যে কালকে দুপুর থেকে আজকে পর্যন্ত কত বার ডাকা হয়েছে ইয়ত্তা নেই কিন্তু তারা কোন কথাই বলবে না। আমাদের এই ভিএইচএফ হল একটি রেডিও, যা দিয়ে আমরা যোগাযোগ রক্ষা করি, অনেকটা পুলিশের ওয়াকি-টাকি’র মত।

পুলিশের কন্ট্রোল রুমের মত বন্দর গুলির কন্ট্রোল রুম থাকে, পুলিসের গাড়িতে গাড়িতে যেমন একটি রেডিও থাকে আমাদের জাহাজেও তাই। আমরা দূরে কোন জাহাজ দেখলাম, হয়তো কোন কারণে যোগাযোগ করা প্রয়োজন, এই রেডিও তে ডাক দেব। কোন বন্দরে যাওয়ার অনেক আগেই এদের ডেকে অনুমতি নিতে হয়, তাও এই রেডিওর মাধ্যমে। প্রত্যেক বন্দরের নিজস্ব নিয়ম আছে। যেমন সৌদি আরবের দাম্মাম বন্দরে যাওয়ার ১৮০ কিমি আগেই রেডিও তে তাদের ডাকতে হবে। তখন তারা শুধু শিপের নাম ও কল-সাইন নিয়ে নেবে। কল-সাইন হল সমস্ত আন্তর্জাতিক পরিবহনের একটি আলাদা কোড-নেম থাকে, অনেকটা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের মত। যেমন সেই বহুল প্রচারিত ও রহস্যজনক মালায়সিয়ান এয়ারলাইন্স এর হারিয়ে যাওয়া বিমানটির কল-সাইন ছিল- এমএইচ৩৭০। এরকমই বন্দর থেকে কল-সাইন টি জেনে নেবে, তারপর আবার বলবে যে পৌঁছানোর তিন ঘণ্টা আগে আবার কল করবে। অত নাম্বার বয়া অতিক্রম করার সময় কল করবে, এর পর বলবে পাইলট যেখানে উঠবে সেখান পৌঁছানোর ১ ঘণ্টা আগে আবার জানাবে। এর ফাকে ফাকে আবার বিভিন্ন তথ্য যেনে নেবে, কি পরিমাণ কার্গো আমরা লোড করব, কার্গো কোথায় যাবে, জাহাজে আগের কার্গো আছে কিনা, থাকলে কি পরিমাণ এবং সেটা কোথা থেকে লোড করেছি। জাহাজের ট্যাঙ্কে অক্সিজেন কত পারসেন্ট, ট্যাংকে হাইড্রোজেন-সালফাইড গ্যাস আছে কিনা, এরকম হাজারো প্রশ্ন। আবার এই আরুবার মত বন্দরও অনেক সময় পাওয়া যায় যারা জিগ্যেস করা তো দুরের কথা, ডাকলেও উত্তর দেবেনা।

পোর্টে গেলে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন হতে পারে, সেই আশঙ্কায় সকাল সাড়ে দশটা থেকে বারটা পর্যন্ত জাহাজের সবাই কে কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া হল। এসব প্রশিক্ষণ নিয়মিত দেয়া হয়, তারপরও আবার একটু ঝালাই করে নেয়া। অতঃপর বিরিয়ানি দিবসের বিরিয়ানি খেয়ে আবার গেলাম ব্রিজে। সেকেন্ড অফিসার কে জিগ্যেস করলাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে রেডিওতে কল করেছিলে কিনা। সে জানালো করে নাই, কেন করে নাই জিগ্যেস করার আগেই বলল আরেকটি জাহাজ এসেছে এবং তারাও অনেকক্ষণ যাবত ওদের কল করছে, কিন্তু জবাব পাচ্ছে না, তাই আমিও আর কল করিনি। এদিকে মেইল এসেছে এজেন্ট থেকে, যে জাহাজটি আমাদের জেটিতে আছে, তাদের কার্গো শেষ হবে সন্ধ্যা ছটায়, এর পর আমাদের ক্রমিক নাম্বার। সুতরাং রাত দশটার দিকে আমাদের পাইলট আসতে পারে এজেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী। এজেন্টকে ফোন করে বললাম এসব তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার কথামত আমি চ্যানেল ১৬ ও ০৮ এ টার্মিনাল কে ডেকে যাচ্ছি, কেউ উত্তর দিচ্ছে না। সে উত্তরে বলল ‘ক্যাপ্টেন চিন্তিত হয়ো না, টার্মিনালে এখন মনে হয় কেউ নেই, সন্ধ্যার দিকে যখন আগের জাহাজটির কার্গো শেষ হবার সময় হবে, তখন টার্মিনালে লোক পাবে। এরকম কথা শুনে অবাক হবারও ভাষা হারিয়ে ফেললাম। সে আবারো আমাকে বলল, ঘাবড়াবার কিছু নেই, রেডিও তে না পেলেও টার্মিনালের সাথে আমাদের টেলিফোনে যোগাযোগ আছে। থাকলেই ভাল। ডিউটি অফিসার কে বলে আসলাম, ছটায় আবার যোগাযোগ করতে। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিলাম কারণ রাতে কি হবে জানিনা।

আবার চারটার দিকে ব্রিজে গিয়ে শুনলাম এখনও টার্মিনাল নীরব। বিদায়ি চীফ অফিসার আর চীফ ইঞ্জিনিয়ারের বিমান টিকেটের জন্য মেইল করে দিলাম ট্রাভেল এজেন্টদের। পরশুদিন ফ্লাইট হবে সুতরাং আজকেই কাজ এগিয়ে রাখা ভালো। গারবেজ বা বর্জ্য খালি করতে হবে কিছু। এমেরিকাতে অনেক খালি করেছিলাম, কিন্তু ওদের ওখানে অনেক নখরা, শুধু প্লাস্টিক বাদে আর কিছু নেবে না। এদিকে আমাদের অনেক বিভিন্ন বর্জ্য আছে সেগুলি জমে যাচ্ছে। আমরা যখন কোন বন্দরে এরকম বর্জ্য খালি করি, যারা এসব নিয়ে যায় তারা আবার একটি সার্টিফিকেত দেয় যাতে লিখা থাকে কি কি বর্জ্য তারা নিয়ে গেছে। জাহাজে বর্জ্যের অনেক প্রকার ভেদ আছে যেগুলি আলাদা আলাদা ভাবে খালাস করতে হবে। এর মধ্যে টিউব লাইট, প্রিন্টার কার্টিজ, ব্যাটারি, কোকের ক্যান, সিগারেট এর অবশিষ্টাংশ, এমনকি রান্না করার বা ভাজার পর যে অতিরিক্ত তেল বেচে যায় সেগুলোও আছে তালিকায়। এসবকে আলাদা আলাদা ভাবে রাখতে হবে। এমেরিকা তে যে প্রাপ্তি রসিদ দিয়ে গেছে তাতে লিখা আছে তারা ২০ ব্যাগ প্লাস্টিক নিয়ে গেছে। এখন কোন বন্দরে গেলাম, সেখানকার পরিদর্শক আমাদের বর্জ্য নিষ্কাশনের বই টি পরীক্ষা করবে যে কি কি বর্জ্য আমরা কবে কোথায় খালাস করেছি, সাথে তারা নিষ্কাশনের রসিদও দেখবে। নিষ্কাশনের রসিদে আছে আমরা শুধু প্লাস্টিক নিষ্কাশন করেছি, তখন তারা জানতে চাবে তাহলে তোমরা যে টর্চে ব্যাটারি ব্যাবহার করেছ সগুলি কই, বা এতদিন যে রান্না করছ, যেসব পোড়া তেল বেচে গেছে সেগুলি কোথায়। এখন যদি তাদের আমারা দেখাতে না পাড়ি যে এগুলি এসব ড্রামে জমিয়ে রেখেছি, তাহলে ধরে নেবে আমরা অবৈধ ভাবে এসব সমুদ্রে ফেলে দিয়েছি এবং এটা মারাত্মক একটি অপরাধ এবং এতে শুধু কোম্পানি জরিমানাই হবে না, প্রমাণ সাপেক্ষে ক্যাপ্টেনের জেলও হতে পারে। তাই হয় আমাদের নিষ্কাশনের রসিদে দেখাতে হবে সব ধরনের গারবেজ আমরা নিষ্কাশন করেছি, অথবা দেখাতে হবে আমরা জমিয়ে রেখেছি।

কিন্তু বেশীদিন তো আর জমিয়ে রাখা যায় না, এসব খালি করতে হয়। এজেন্ট জানিয়েছে এ বন্দরে সব ধরনের গারবেজ নিষ্কাশন করা যাবে। সুতরাং আবার অফিসে বিস্তারিত জানালাম, এই পরিমাণ এসব বিভিন্ন গারবেজ আমরা খালাস করতে চাই। অফিস থেকে অনুমতি আসলে এসব কালকে নিষ্কাশন করতে হবে। এরপর এজেন্টকে ফোন করে জানালাম আমাদের বর্জ্যের সম্ভাব্য পরিমাণ জানানোর জন্য। এজেন্ট তখন জানতে চাইল চীফ অফিসার আজকে রাত আটটার দিকে পৌঁছবে, জাহাজ যদি রাতেই বন্দরে ভীরে, চীফ অফিসার কে কি সরাসরি জাহাজে নিয়ে আসব নাকি হোটেলে রাখব। অনেক কোম্পানি সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে জাহাজে পাঠায়। এ ব্যাপারে আমাদের কোম্পানি বেশ নমনীয়। বলে দিলাম তুমি তাকে জিগ্যেস করবে, যদি সে আসতে চায় নিয়ে আসবে, বিশ্রাম নিতে চাইলে হোটেলে রাখবে, আগামীকাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার এলে একসাথে নিয়ে আসবে।

সন্ধ্যায় রেডিও তে কল করে ঠিকই পাওয়া গেল, সে সাথে আমার উদ্বেগও শেষ হল। টার্মিনাল জানিয়েছে রাত্র ৩ টার দিকে পাইলট হতে পারে, কিন্তু তারা আবার নিশ্চিত করবে। ৩টা হোক আর চারটা হোক, তারা যে জীবিত এতেই আমি খুশী। আসলেই এরা ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করে। যদিও প্রায় হাজার কিমি জুরে এই ছোট ছোট দ্বীপ গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু তাদের চাল চলন, জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি সবই একরকম। এখানকার সবাই বাস্তবেও ওয়েস্ট-ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের মত। তারা হেরেও হাসতে পারে আবার জিতেও গান গাইতে পারে। ডোয়াইন ব্রাভো বা ক্রিস গেইল শুধু ক্রিকেট মাঠে বা টিভির পর্দার প্রতিচ্ছবি না, তারা এই দ্বীপাঞ্চলের প্রতিচ্ছবি। এই এলাকায় আরেকটি দ্বীপ আছে তার নাম সেইন্ট-ইউস্টাসিয়াস, এই দ্বীপ টিতে আমার কয়েকবার যাওয়া হয়েছে। দ্বিপটি মাত্র ৫ কিমি লম্বায় আর ৪ কিমি প্রস্থে। বলা চলে ধানমন্ডির মত একটি এলাকা। দ্বীপ বলতে উঁচু ঢিবির মত মাথা ভাঙা একটি পাহাড়, যেটি হল একটি মৃত আগ্নেয়গিরি। পাহারের চার দিকে সামান্য কিছু বসতি, সব মিলিয়ে হাজার তিনেক লোকের বসবাস। এমেরিকা থেকে পশ্চিম আফ্রিকার বন্দর গুলিতে গেলে এই দ্বিপটিতে আমরা থামি জ্বালানী তেল নেয়ার জন্য। জাহাজ এর পরে যাবে নাইজেরিয়া, সেখানে সাইন-অফ করার ইচ্ছে নেই আর কোম্পানিও এসব যায়গায় সাইন অফ করায় না। নাইজেরিয়া থেকে এমেরিকা ফিরতে অনেক দেরী হবে এবং আর আমি সাইন-অফ এত বিলম্বিত করতে চাচ্ছিনা, তাই এখানেই নামানো হল আমাকে। আমি নামছি দেখে এক ফিলিপিনো ক্যাডেট ‘জন পিটার লিম’ কেও আমার সাথে সাইন-অফ করানো হল। আমাদের যাত্রা পথ হল সেইন্ট-ইউস্টাসিয়াস থেকে সেইন্ট-মারটিন দ্বীপ, সেইন্ট মার্টিন থেকে প্যারিস।

তারপর প্যারিস থেকে আমি দুবাই হয়ে ঢাকা আর পিটার দুবাই হয়ে ম্যানিলা। সন্ধ্যায় এজেন্ট আমাদের বোটে করে নিয়ে গেল দ্বিপে। রাতে হোটেলে থাকবো, সকালে আমাদের ফ্লাইট। বোট ঘাট হল একটি একতলা সুন্দর বাংলো বাড়ির পাশে দুতিনটা স্পিড বোট বাধার মত যায়গা। বোট ঘাট থেকে নেমে দেখলাম গাড়ি দাড়িয়ে, আমরা ব্যাগ নিয়ে গাড়ির দিকে আগাতেই এজেন্ট চীৎকার করে মানা করল। এগিয়ে এসে বলল গাড়িতে উঠার দরকার নেই, এই বাড়িটাই আমাদের হোটেল। বাড়ি মানে কয়েকটা রুম হবে, সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাদের রুম দেখিয়ে সে বলে গেল সকাল সাড়ে সাতটায় যাতে আমরা প্রস্তুত থাকি সাড়ে আটটায় আমাদের ফ্লাইট। মানে ফ্লাইটের একঘণ্টা আগে এখান থেকে রওনা হয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ফ্লাইট ধরতে পারবো। আমরা ব্যাগ রেখেই দুজনে বেরলাম দ্বীপ ভ্রমণে। দ্বীপ বলতে একটি পাহাড়ি এলাকা, একটিই রোড সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে বানানো হয়েছে। আমরা রোড ধরে হাটা শুরু করলাম। একপাশে খাড়া পাহাড় ও একটু জংলা এলাকা, সমুদ্রের পাশে কিছু দূর পর পর ছোট ছোট বাড়ি। বাড়ি বলতে অনেকটা এক দুই রুমের বাংলো বাড়ির মত, কোন বাসিন্দা আছে বলে মনে হল না। বুঝা যাচ্ছে এসব সৌখিন বাড়ি, সত্যিকারের আবাসিক এলাকা নয়। রাস্তায় জনমানবের কোন চিহ্ন নেই, এমন কি কিলোমিটার দুয়েক হাটা পথে একটি গাড়িও চোখে পড়লো না। ২ কিলোমিটার যাওয়ার পর একটি রাস্তা পেলাম যেটা সমুদ্রের পাড় ঘেঁষা রাস্তা থেকে ভেতর দিকে গেছে।

আমরা সমুদ্র পারের রাস্তা ছেড়ে ভেতর দিকে ঢুকলাম। বাংলাদেশের একদম মফস্বল এলাকার কোন গ্রামের মত, কোন জনমানুষের যাতায়াত বা সাড়াশব্দ নেই। দু পাশে একটু পর পর বাড়ি। কোন দোকান পাটের দেখা পেলাম না। একটু আগাতেই দেখি আলো ঝলমলে একটি যায়গা, বাইরে সাইনবোর্ড দেয়া ‘অমুক নাইটক্লাব’। আবার একটু আগালাম এক দু বাড়ি পরেই আবার এরকম আরেকটি ক্লাবের সাইনবোর্ড। আমরা হেটে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এছাড়া কোথায় যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছিনা। ক্লাবগুলি আলো ঝলমলে কিন্তু কোন মানুষ নেই। এরকম একটি তে ঢুকে পরলাম। দেখি এক ভদ্রমহিলা ও আরেকজন যুবক কিছু মালপত্র গুছাচ্ছে। এক কোনায় একটি ছোট স্টেজও আছে সেখানে কিছু সাউন্ডবক্স, মাইক্রোফোন, ড্রাম সেট এসব রাখা।

আমরা ঢুকতে মহিলা তার কথা থামিয়ে আমাদের দিকে নজর দিল। জিগ্যেস করলো কিছু খাব কিনা, দ্রুত একটু মেন্যুও ধরিয়ে দিল। কিন্তু আমাদের এত তাড়াতাড়ি খাবার কোন ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল সংবাদ সংগ্রহ, যে নগর কেন্দ্র টি কোথায়, বা শপিং সেন্টারগুলি কোথায়। এরকম নির্জন এলাকার ক্লাবে বসে সময় নষ্ট করার কোন উদ্দেশ আমাদের নেই। পিটারো আমার সাথে একমত। বললাম আমরা খাবো না কিন্তু দুটো ড্রিঙ্কস নিতে পাড়ি। এমন সময় দেখলাম অন্য কোনায় বসে দুজন ব্যক্তি কথা বলছিল, তারা আমাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো এবং অনুমতি না নিয়েই বসে পড়লো। নিজেরাই তাদের পরিচয় দিল, একজন এই নাইট ক্লাব বা রেস্টুরেন্টের মালিক আর সাথের জন তার প্রতিবেশী বন্ধু আর ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। জিগ্যেস করলাম নাইটক্লাব খুলে কখন, পরেই সংশোধন করে নিলাম যে আসলে এটার ব্যস্ত সময়টি কখন। বলল এরকম সময়েই এটা চলে। এরপর জানাল তেমন কোন খদ্দের আসেনা, মহল্লার লোকজনই আসে, একটু খাওয়াদাওয়া করে। অনেক সময় তারা নিজেরাই গান বাজনা করে। আরও জানালো এটাই তার বাড়ি, এবং আসে পাশের আরও যে দু একটা ক্লাব দেখেছি সেগুলিও তাদের বাড়ি, এমনি শখে নাইট-ক্লাব নাম দেয়া হয়েছে। তারপর জানতে চাইলাম সিটি সেন্টার কোথায়? তাদের অবাক দৃষ্টি দেখে বুঝে গেলাম সিটি সেন্টার বলতে তাদের কাছে কিছু নেই।

এরপর ঘুড়িয়ে জানতে চাইলাম শপিং মল বা কেনাকাটার কোন মার্কেট আছে কিনা। বলল এই রাস্তা দিয়ে সোজা আগালে অপর প্রান্তে শপিং মল আছে। জানতে চাইলাম কীরকম শপিং মল, উত্তরে যা বলল তাতে বুঝলাম সেটি একটি বড় মনোহারী দোকান যেখানে অনেক জিনিশপত্র পাওয়া যায়, তাদেরর কাছে সেটাই শপিং মল। এপর্যন্ত শুনে আমরা আর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ড্রিঙ্কস শেষ করে উল্টো পথে রওনা দিলাম। আবার এসে পৌঁছলাম সমুদ্র তীর ঘেঁষা রাস্তায় আর হাটা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। দ্বিপের ভেতর থেকে এই তীর ঘেঁষা রাস্তার সন্ধিক্ষণেই একটি রেস্টুরেন্ট দেখে গিয়েছিলাম, সমুদ্রের পাড় ঘেঁসে, অনেকটা টং ঘরের মত। অর্ধেক অংশ রাস্তার পাশে মাটিতে, বাকি অংশ সাগরে ঝুলন্ত। দুজনে সেখানে গেলাম রাতের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে। যাবার সময় একদম খালি দেখে গেছি, কিন্তু তখন দেখলাম অল্প কিছু খদ্দের আছে। আমরা সমুদ্রের দিকে খোলা বারান্দার মতন একটি যায়গা বেছে নিয়ে বসলাম।

খাবার অনেকটা স্ন্যাক্স এর মত। এরকম টুকি টাকি কিছু নিলাম সাথে দুজনের জন্য ড্রিঙ্কস দিয়ে গেল না চাইতেই। দুজনেই ক্ষুদারত ছিলাম এবং খাবারও বেশ সুস্বাদুও ছিল। ধীরে সুস্থে খাচ্ছিলাম কারণ যাবার কোন তারা ছিলনা কারণ মিনিট বিশেক হাঁটলেই হোটেল পেয়ে যাব। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম রেস্টুরেন্ট জমে উঠেছে। সাদা কালো মিলিয়ে অনেক লোকজন। সবাই সবাইকে হাই হ্যালো বলছে, সবাই হাসিমুখ। খদ্দেরদের অবস্থা দেখে মনে হলোনা এটা কোন রেস্টুর‍্যান্ট, মনে হল আত্মীয় স্বজনদের কোন অনুষ্ঠান। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের সাথেও তারা একই রকম ব্যাবহার করছে যেন আমরাও তাদের গ্রামের লোক। পিটার চলে গেল, কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছা হল না। এরকম পৃথিবীর অপর প্রান্তে, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লোকজনের এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আসলে কোথাও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তাদের আড্ডায় মিশে গেলাম, একবারও কেউ জিগ্যেস করলো না আমি কোন দেশের, এবং এখানে কেন এসেছি। প্রায় বারটার দিকে এদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলাম।

ঘুমাতে ঘুমাতে রাত একটা। এলার্ম দিয়েই ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু এলার্ম বাজার আগেই দরজায় তীব্র কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। পিটার আর আমি দুজনেই চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে বেড়িয়ে দেখি এজেন্ট। তার সাড়ে সাতটায় আসার কথা থাকলেও তখন ঘড়িতে মাত্র ৬টা। সে জানালো একটি ঝামেলা হয়ে গেছে, তাই তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্ট যেতে হবে। আরও দুঃসংবাদ হল ঝামেলাটি আমাকে নিয়ে। এখান থেকে সেইন্ট-মার্টিন পর্যন্ত যে ফ্লাইট টিতে আমার আসন টি ছিল অপেক্ষমাণের তালিকায়, এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে রাতে তার কাছে ফ্যাক্স এসেছে যে আমার টিকেট টি বাতিল হয়ে গেছে। আমাকে পরবর্তী এভেইলএব্‌ল বিমানে যেতে হবে, এবং সেটা কখন হতে পারে সেটা এজেন্টের জানা নেই। তাই সে আমাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরে যাচ্ছে যদি কিছু করা সম্ভব হয়। বিমান বন্দরে পৌঁছানোর পর জানলাম কিছুই করা সম্ভব না, আমাকে ওয়েট করতে হবে, পরের ফ্লাইট এর জন্যে আর সেটা কখন হবে এটাও তারা বলতে পারছে না। বিমান বন্দর মানে ধানমন্ডি লেক সার্কাস মাঠ আর তার পাশের ক্লাব-ঘর টি। মাঠ হল রানওয়ে আর ক্লাব ঘরটি হল টার্মিনাল।

মফস্বলের রেল-স্টেশনের টিকেট কাউন্টারের মত একটি কাউন্টার আছে। সে খানে একজন মহিলা আছেন যার দায়িত্ব টিকেট দেখে বোর্ডিং কার্ড দেয়া ও পাসপোর্ট চেক করা, আর বাইরে একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ যার দায়িত্ব নিরাপত্তা রক্ষা করা কিন্তু তাকে কারো নিরাপত্তা তল্লাসি করতে দেখা গেল না, সে ব্যস্ত যাত্রীদের ব্যাগ গুলি লাইন মত যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে। আমার যাওয়া হচ্ছেনা শুনে আমার চেয়ে বেশী ভয় পেল পিটার। এটাই তার জাহাজে প্রথম ভয়েজ। এতদূর থেকে বাড়ি যাচ্ছে, এতক্ষণ সে জানতো আমি তার সাথে আছি দুবাই পর্যন্ত, আর এখন সে যাত্রার শুরুতেই একা হয়ে যাবে। আমি তাকে ভরসা দিয়ে বললাম তুমি যাও, আমি কিছুক্ষণ পরেই আসছি। এটা মাত্র ৪০ মিনিটের বিমান যাত্রা, সেইন্ট মারটিনে গিয়ে আমাদের দেখা হবে।

পিটার খুব বিজ্ঞের মত বলল ‘বুঝলাম তুমি সেইন্ট মারটিন আসবে, কিন্তু আমাকে তুমি পাবো কোথায়’। আসলেই তো, তাকে আমি গিয়ে কোথায় খুঁজবো, দুজনের কেউই সেইন্ট মারটিন বিমানবন্দরে কখনো যাই নি। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম তুমি এয়ার ফ্রান্সের কাউন্টারে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। ওকে পাঠিয়ে বসে পরলাম টিকেট কাউন্টারের বাইরে রাখা এক মাত্র বেঞ্চে। এজেন্ট আমাকে বলল সে আসে পাশেই থাকবে, সে কিছু ফোন করে দেখার চেষ্টা করছে কিছু করতে পারে কিনা। রাতে ঘুম হয় নি, তাই আমি বেঞ্চে ঢলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। হটাত কাউন্টারের মহিলার ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। সে কাউন্টারের ভেতর থেকে মুখ বের করে আমাকে ডাকছে, আমি তার দিকে তাকাতে সে জানতে চাইলো আমার এজেন্ট কোথায়। আমি বললাম তাতো আমি জানিনা কিন্তু সে আসে পাশেই থাকবে এটা বলেছিল। মহিলা বলল তুমি জলদি ওকে খুঁজে নিয়ে আসো, তোমার জন্য একটি ব্যবস্থা করছি। ভাবলাম অনলাইনে হয়তো কোন টিকেট খালি দেখেছে। বিমান বন্দরের প্যাকিং এ এজেন্টের গাড়ি পেলাম, কিন্তু এজেন্ট কে কোথায় পেলাম না। আমি এদিক ওদিক খুঁজছি, কিন্তু এজেন্ট কে পাওয়ার আগে সেই আমাকে খুঁজে পেলো। আমাকে এদিক ওদিক হাটা হাটি করতে দেখ সে বুঝেছে আমি তাকে খুঁজছি। তাকে বললাম মহিলার কথা। সেও দ্রুত রওনা হল টিকেট কাউন্টারের দিকে। গিয়ে যা শুনলাম সেটা হল একটি চার্টার্ড বিমান এসেছে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এবং সেটা কিছুক্ষণ পরই খালি অবস্থায় সেইন্টমার্টিন রওনা হবে। এজেন্ট যদি পাইলট এর সাথে ভাড়ার ব্যাপারটা সুরাহা করতে পারে, তাহলে আমাকে এই বিমানে পাঠাতে পারে।

নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করে এজেন্ট মাঠ বা রানওয়ে যা বলি সেই এলাকায় চলে গেল। পাইলট সেখানেই দাড়িয়ে ছিল। এজেন্ট গিয়ে অর সাথে কিছু আলাপ করল, তারপর আবার আমার দিকে এগিয়ে এসে একটি ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল যে সে চুক্তি করে ফেলেছে, আমি চার্টার্ড ফ্লাইটে সেইন্ট মার্টিন যাচ্ছি। দৌড়ে ব্যাগ নিয়ে উঠলাম বিমানে। মুখোমুখি দুটো করে মোট চারটি আসন, এবং এই চারটির মালিকই আমি। আমাই বাদে বিমানে একজন পাইলট ও একজন মহিলা কোপাইলট যে একই সাথে বিমানবালার কাজটিও করে। তাদের কথা বার্তা শুনে বুঝলাম দুজনেই পূর্ব ইয়োরোপীয় দেশের নাগরিক। মহিলা কোপাইলট কাম বিমানবালা আমার সিট বেল্ট চেক করে নিরাপত্তা বিষয়ক এক মিনিটের নিয়ম মাফিক ভাষণটি দিয়ে পাইলটের পাশে গিয়ে বসলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা আকাশে। ছোট বিমান তাই অনেক নিচ দিয়ে উড়ছে, আর আমি অবাক হয়ে দেখছি ক্যরাবিয়ান দীপপুঞ্জের অপরূপ সৌন্দর্য। ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেন্টমারটিন আর তারসাথে শেষ হল আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম বিমান ভ্রমণ। এবং এটাই আমার জীবনের প্রথম এবং হয়তো বা শেষ চার্টার্ড ফ্লাইট।

সর্বশেষ খবর জাহাজ বন্দরে ভিড়বে সকালে, রাতের ঘুম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। সবাইকে এই সুখবর জানিয়ে আজকের মত ছুটি, শুভ রাত্রি। রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ (ভাসমান ৪৮ দিন):

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে