নদের নাম আড়িয়াল খাঁ : সুমন শামস

0
34
দৈনিক নোঙর | একটি সংবাদ পোর্টাল

আড়িয়াল খাঁ! মাদারীপুরের কালকিনি ও খাশেরহাট অঞ্চলের পাশ দিয়ে বহমান এই নদ আমার কাছে কেবলই এক জলধারা নয়; এটি আমার সত্তার গভীরে প্রবহমান এক নস্টালজিক নদী। আজকের পাকা সেতু আর শহরের ছোঁয়া লাগা আড়িয়াল খাঁ-কে দেখে বিশ্বাস হয় না যে এই নদের বুকেই আমার শৈশবের এক বিশাল জগৎ লুকিয়ে আছে।

আমার ছেলেবেলার আড়িয়াল খাঁ ছিল জীবন ও জীবিকার মূলস্রোত। বন্দর আর গুদাম ঘরগুলো ছিল নদের পাড়ের অলঙ্কার। মাদারীপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যখন বিশাল লঞ্চগুলো জেটিতে ভিড়তো, তার গম্ভীর বাঁশির শব্দে যেন পুরো খাশেরহাট সচকিত হয়ে উঠতো। আবার, নদীর ঘাটে সারি সারি পাটের নৌকা ভিড়তো—সোনালী আঁশ বোঝাই করে। বন্দরের বিপরীতে নদীর পাড়ে ছিল সারিবদ্ধ গুদাম ঘর ও খাদ্য মজুতের গোডাউন, যা আমাদের অঞ্চলের সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। যন্ত্রচালিত নৌকার দাপট তখন কম। মাঝিরা গুন টেনে টেনে নৌকা পার করতেন। সেই গুনটানা নৌকার শ্রমের সুর আর পালতোলা পানশি নৌকার দ্রুত ছুটে যাওয়া আজও কানে বাজে।

ভোরবেলায় নদীর পাড়ে জেলেদের জাল টানার দৃশ্য ছিল আরও এক নাট্যমঞ্চ। সূর্যের প্রথম আলোয় ভেসে উঠত ইলিশের ঝিলিক, আর সেই তাজা মাছ নিয়ে তারা আসত খাশের হাট বন্দরে। বাজারের বাতাসে ভেসে আসত ইলিশের গন্ধ, মানুষের হাঁকডাক, জীবনের আনন্দ।

খেয়া পার হয়ে ওপাড়ে যাওয়া ছিল প্রতিদিনের অভ্যাস। বৃষ্টির দিনে নদীর গর্জন শুনে ভয় মিশ্রিত উত্তেজনা, আর পূর্ণিমার রাতে নদীর জলে চাঁদের নাচন—সবই আজ স্মৃতির ভেলায় বেঁচে আছে।

প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য, নদীর স্রোত, আর মানুষের সহজ-সরল জীবন আমাকে আজও টানে। সময় অনেক দূর গড়িয়ে গেছে, আমি বড় হয়েছি, কিন্তু মনে হয়—আড়িয়াল খা নদীর সেই জোয়ার-ভাটাই এখনো আমার হৃদয়ে খেলে যায়।

আড়িয়াল খাঁর পাড় শুধু ব্যবসার কেন্দ্র ছিল না, এটি ছিল আমাদের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। নদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের সারি থেকে রস সংগ্রহ হতো। দিগন্তজোড়া সরিষার ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন ছিল এক অসাধারণ দৃশ্য। বৈশাখী মেলা আর পূজার পর প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা ছিল বার্ষিক উৎসব। যাত্রাপালা ও নদীর পারের খোলা মাঠে বসতো পালাগানের আসর এবং জমজমাট যাত্রাপালা। রাতভর জেগে গান শোনা ছিল বিনোদনের মূল মাধ্যম। আদি কাল থেকেই বেদের বহর তাদের নৌকা আড়িয়াল খাঁ নদের বন্ধরে বসবাস করছে। সেই দিনগুলিতে এক মালাই নৌকায় চরে বিয়ের বরযাত্রী যাওয়ার দৃশ্য ছিল এক মিষ্টি ঐতিহ্য। নদের বুকেই ছিল আমাদের অবাধ বিচরণ। নির্ভয়ে নদীতে সাঁতার কাটা এবং ঘন্টার পর ঘন্টা দাপাদাপি করাই ছিল আমাদের কৈশোর।

একদিন সেই আড়িয়াল খাঁ পেরিয়েই আমরা বড় মেঘনার দিকে যাত্রা করেছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। মেঘনা নদীতে সেই ভয়াবহ ঝড়ের কবলে পড়ে এমভি তরীকা লঞ্চের সেই ভয়ঙ্কর দোল খাওয়া আজও হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। সামান্যর জন্য আমরা তিন ভাই সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম—মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেছিলাম বলেই হয়তো জীবনের মূল্যটা গভীরভাবে বুঝতে শিখেছিলাম।

কিন্তু জীবন সব সময় এতো উদার হয় না। ২০০৪ সালের ২৩ মে তারিখটি আমাদের জীবনে এক কালো অধ্যায় রচনা করে। ঠিক একই নৌ-পথ ধরে মাদারীপুর থেকে আমার ভাই এমদাদুল হক কে সাথে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন আমার মা আছিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন এমভি লাইটিং সান লঞ্চের যাত্রী।

বিধাতার কী নির্মম পরিহাস, যে নদী থেকে আমরা বেঁচে ফিরেছিলাম, সেই মেঘনাতেই সেদিন আঘাত হানে এক প্রলয়ংকরী ঝড়। চলাচলের অযোগ্য সেই ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি ডুবে যায়, আর মেঘনার উত্তাল জলে নিভে যায় শত শত মানুষের জীবন প্রদীপ। সেই ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনায় আমার মা আছিয়া খাতুন আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরতরে।

মৃত্যুর সেই কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি জননীর কর্তব্য ভুলেননি—তিনি চেষ্টা করেছিলেন তার সন্তানকে বাঁচানোর, যদিও সেদিনের সেই যাত্রী আমার বড় ভাই ছিলেন। কিন্তু মেঘনার জলের প্রতিটি ঢেউ যেন আজও সেই মায়ের আত্মত্যাগ বহন করে। তিনি হারিয়ে গেলেন নদীর জলে, কিন্তু রেখে গেলেন এক গভীর ক্ষত, যা কোনো দিনই পূরণ হবার নয়।

সেই ট্র্যাজেডির পর মায়ের নিথর দেহ মেঘনা নদীর অতলে ডুবে থাকা জলে যখন খুঁজে পাওয়া গেল ৭২ ঘন্টা পরে, তখন তাঁর শেষ যাত্রা হলো সেই চিরচেনা পথে। আছিয়া খাতুনের লাশ যখন আড়িয়াল খাঁ নদের শান্ত জলরাশি পার হয়ে আমাদের পরিপত্তর গ্রামে দাফন করা হয়, তখন আড়িয়াল খাঁর নীরবতা যেন মেঘনার সকল কান্নাকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিল। যে নদী ছিল প্রাণের উৎসব, সেই নদীই হয়ে গেল আমার মায়ের শেষ বিদায়ের নীরব পথ। সেই থেকে নদী আমার মা।

বলছিলাম, আজকের আড়িয়াল খাঁ আর আমার ছেলেবেলার নদ এক নয়। সময়ের স্রোত আর উন্নয়নের ঢেউয়ে এর পুরাতন চিত্র বদলে গেছে, তবে এসেছে নতুন চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়ে নদের ওপর আড়িয়াল খাঁ সেতু নির্মাণ হওয়ায় আমাদের জীবনযাত্রা আমূল পাল্টে গেছে। এই সেতুর কারণে এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এক সময় যা ছিল দূরত্বের প্রতীক, আজ তা সংযোগের বন্ধন। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে, জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত উপজেলা সদরে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। সেতুটি নিঃসন্দেহে আমাদের অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ, কিন্তু এর কারণে নদীর সেই শান্ত, নিরবচ্ছিন্ন স্রোত আর লঞ্চ-নৌকার নিরন্তর আনাগোনা আজ শুধুই ইতিহাস।

উন্নয়নের এই সুসময়ের বিপরীতে আড়িয়াল খাঁ যেন আজ রূঢ় রাক্ষসীর বেশ ধরেছে। বিশেষ করে সূর্যমনি এলাকায় নদীভাঙন এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। বর্ষা এলেই ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে, আর একের পর এক গ্রামের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে। ভিটেমাটি হারিয়ে মানুষজন আজ নিঃস্ব, তাদের চোখে মুখে কেবলই অনিশ্চয়তা আর প্রিয়জনকে হারানোর ভয়। এই ভাঙন আমাদের শৈশবের সেই শান্ত নদের করুণ পরিণতিকেই মনে করিয়ে দেয়।

নদের পাড়ের সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতা আজ হুমকির মুখে। বন্দরের উল্টো দিকে যে ইটের ভাটাগুলো গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে নির্গত ধোঁয়া আর দূষণ কেবল বাতাসকেই নয়, নদের জলকেও কলুষিত করছে। এক সময় এই নদের জল পান করা যেত, আর আজ সেখানে দূষণের কালো ছায়া। ইটের ভাটার দূষণ আমাদের ছেলেবেলার নির্মল পরিবেশের সম্পূর্ণ বিপরীত এক চিত্র। এটি নদের পাড়ের মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর এক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে।

আড়িয়াল খাঁ নদ—তুমি একাধারে আমার সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী এবং বর্তমানের বেদনা বহনকারী এক জলধারা। তোমার বুকেই আমার শৈশব ছিল নির্ভয়, আর আজ তুমি নিজেই যেন সংকটের প্রতীক। তবুও, তোমার প্রতি আমার সেই শৈশবের টান আজও অমলিন; সেকারণেই তোমার আনন্দ-বেদনা—সবটাই আমার হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।

লেখক: নদী গবেষক ও চেয়ারম্যান, নোঙর ট্রাস্ট। Email: shumanshams@yahoo.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে