৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭টি খাল খনন এবং ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার অব্যাহত থাকলেও কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ মিলছে না বরিশাল নগরীর বাসিন্দাদের। এজন্য খাল ভরাট করে সড়ক ও মার্কেট নির্মাণকে দায়ী করছেন নগরবাসী।
সাগরে নিম্নচাপের কারণে গতকাল শনিবার থেকে আজ রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত থেমে থেমে আবার কখনও মুষলধারে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নগরীর বটতলার মোড় থেকে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ পর্যন্ত হাঁটুসমান পানি। এ সড়কের সঙ্গে থাকা ২০টির বেশি শাখা সড়কও পানিতে ডুবে আছে। একইভাবে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন জায়গায় এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
নগরীর বটতলাবাসী বিদ্রুপ করে বলেন, ‘আকাশে মেঘ আসলেই সেখানকার সড়কে হাঁটুসমান পানি জমে যায়। নগরীর কোথাও পানি না থাকলে বৃষ্টি হলে সেখানে পানি জমবেই। এ অবস্থা চলে আসছে খাল ভরাটের পর থেকে। বটতলা মসজিদ মোড় এলাকায় খাল ভরাট করে জেলা পরিষদ গড়ে তুলেছে বহুতল মার্কেট। এরপর খাল ভরাট করে সরু ড্রেন করা হয়েছে। এতে করে বৃষ্টির পানিতে ড্রেন ভরে তা সড়কে সয়লাব হয়।’
প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘কীর্তনখোলা নদীর সঙ্গে সংযোগ ভাটার খালটি জিলা স্কুলের সামনে থেকে হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে বটতলা ও চৌমাথা হয়ে সাগরদী খালের সঙ্গে মিশেছে। ওই সময় ভারী বর্ষণে কোনোদিন ওই এলাকায় পানি জমেনি। কিন্তু খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার পর থেকে তাদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ওই সড়কের পানির চলে যায় ১৫ থেকে ২০টি শাখা সড়কে। যার ফলে বাসা থেকে বের হওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি থাকে না। এজন্য সিটি করপোরেশন থেকে ড্রেন পরিষ্কার করানো হলেও তাতেও মিলছে না সমাধান। বৃষ্টিতে কোথাও পানি না জমলে আমাদের এলাকায় পানি থাকবেই। আর এ কারণে জলাবদ্ধতার খবর নিতে সাংবাদিকরাও ভিড় করেন এ এলাকায়।’
নগরীর কাউনিয়া সাবান ফ্যাক্টরি এলাকার বাসিন্দা মো. অলি বলেন, ‘বোঝার পর থেকেই আমি আমাদের এলাকার সড়ক বছরের বেশির ভাগ সময় পানির নিচে দেখে আসছি। ভারী বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না, সামান্য বৃষ্টি হলেও সড়কটি পানির নিচে চলে যায়। বর্তমানে একই অবস্থা বিরাজ করছে। সড়কে থাকা পানির সঙ্গে ড্রেনের ময়লা পানি মিশে দুর্গন্ধময় পরিবেশ বিরাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই পানি পেরিয়ে মসজিদে যাওয়ার পর কারও অজু থাকে না। আবারও অজু করে নামাজে দাঁড়াতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে এক যুগের বেশি সময় ধরে সিটি করপোরেশনের দ্বারস্থ হলেও আজ না কাল এভাবে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা এলাকাবাসী ওই পানিতে চলাচল করতে করতে এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’ একই কথা জানালেন সেখানকার বাসিন্দারা।
সার্কুলার রোডের বাসিন্দা মো. তুহিন জানান, তাদের এলাকায় একসময় খাল ছিল। সেই খাল ভরাট করে সড়ক নির্মাণের পর থেকে সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তা থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকায় পানিতে সয়লাব থাকে। একই অবস্থা কালুশাহ সড়কেরও। সেখানে তৃতীয় এবং পঞ্চম পরিষদের দুই মেয়রের বাসভবন হওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টি হলে ওই সড়ক দিয়েও চলাচল কষ্টকর হয়ে যায়। একইভাবে পানিতে তলিয়ে থাকে পলিটেকনিক সড়কও। এ জলাবদ্ধতা নিয়ে বহু নিউজ হয়েছে। কিন্তু তাদের দুর্ভোগ আজও কমেনি বলে জানালেন তুহিন।
নগরীর বাসিন্দা আলফাজ উদ্দিন বলেন, ‘ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে খাল খননে কিছু সমস্যা কেটেছে। তবে কীর্তনখোলা নদীতে জোয়ারের পানিতে বেশির ভাগ সময় নগরীতে পানি ওঠে যায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় জোয়ার ও বৃষ্টি একসঙ্গে হলে। তখন হাঁটুসমান পানি পেরিয়ে আমাদের চলাচল করতে হয়। অবশ্য বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলায় এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’ এ পানি থেকে কবে নিস্তার মিলবে তার সদুত্তরও কেউ দিতে পারছে না বলে জানালেন আলফাজ।
বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের পাশে নগরীর কালুখা বাড়ির বাসিন্দা মো. মিরাজ বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই আমতলার মোড় থেকে শুরু করে কালুখার বাড়ি এবং সিকদাপাড়া সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। আগে স্বাধীনতা পার্কটি একটি ধানি জমি ছিল। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল নিচু জমি। এরসঙ্গে বেশ কিছু বড় বড় পুকুর ছিল। তা ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণের কারনে সামান্য থেকে ভারী বৃষ্টি, যা হোক না কেন সড়ক থাকে পানির নিচে। আর এ অবস্থা শুরু হয় সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর ভবন বৃদ্ধির কারণে।’
২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রুস্তুম আলী বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে বেড়েছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ। ভারী বর্ষণ এবং কীর্তনখোলায় জোয়ারের পানি এলাকা সয়লাব হয়ে যায়। আর সেই পানি সরতে অনেকদিন সময় লাগে। বছরের বেশির ভাগ সময় ওই পানি দিয়েই চলাচল করতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের একই অবস্থা।’
এদিকে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খাল ভরাট করে নগরীতে নির্মাণ করেছে বহুতল মার্কেট ও সড়ক। আর এতেই নগরে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সমন্বয়ক রফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অপরিকল্পিত ড্রেনেজ-ব্যবস্থা, খাল খনন না করা, জলাশয় ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১০ সালের মাস্টারপ্ল্যানে নগরীতে ৪৬টি খালের নাম পাওয়া গেলেও এখন কোনোমতে অস্তিত্ব টিকে আছে মাত্র ৭টির। আর নগরীতে বর্তমানে জলাশয় টিকে আছে মাত্র ১০ শতাংশ। ফলে পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহের জায়গা না থাকায় এ দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন। সেখানে ৩০টি ওয়ার্ড রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমবেশি পানি থাকে। দীর্ঘদিন পর এ বছরের শুরুর দিকে ৭টি খাল খনন করা হয়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ড্রেন পরিষ্কারের কাজ চলমান রয়েছে। তাতেও জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই মিলছে না নগরবাসীর।’
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইসরাইল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে ৭টি খান খনন করা হয়েছে। এ ছাড়া ড্রেনে যাতে পানি আটকে না যায় এ জন্য ড্রেন পরিষ্কারের কাজ চলমান রয়েছে।’
শহর রক্ষা বাঁধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া এ ব্যাপারে কেউ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে না। তবে বিষয়টি সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনায় রয়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন ওয়ালিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কীর্তনখোলা নদীর পানি বাড়েনি। বিভিন্ন সময় সমীক্ষা চালিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে নগরীর খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর ভরাট করে বহুতল বাড়ি থেকে শুরু করে সড়ক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ কারণে নদী ও বৃষ্টির পানি জায়গা না পেয়ে সড়ক প্লাবিত করছে। নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় ইতোমধ্যে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৭টি খাল খনন করা হয়েছে। এতে করে জলাবদ্ধতা অনেক কমে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কীর্তনখোলা নদীর নগরীর প্রান্তে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ। বাঁধটি দেওয়া গেলে বিভিন্ন সময় বৃষ্টির সঙ্গে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নগরী প্লাবিত হয়। সে থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব ছিল। এর সঙ্গে ড্রেন পরিষ্কার রাখা এবং প্রতিবছর নগরীর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পুনঃখনন অব্যাহত রাখতে হবে। সেজন্য সিটি করপোরেশনকেও এগিয়ে আসতে হবে।’ তারা সাহায্য চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সাহায্য করতে প্রস্তত বলে জানান তিনি।