জাহাজে ডেক আর ইঞ্জিন স্টাফদের কাজ কর্মে এরকম কিছু পার্থক্য রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারদের রাত-দিন নেই, যে কোন সময়ে কাজ করতে পারে। শীত গ্রীষ্ম নেই, ঠাণ্ডা গরম নেই, ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি বাদল, কোন কিছুতেই ইঞ্জিনিয়ারদের কিছু আসে যায় না। ইঞ্জিনরুমে পরিস্থিতি প্রায় একই রকম, কাজ বন্ধ করার কিছু নেই। কিন্তু আবহাওয়া ডেক ক্রুদের জন্য অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করে। প্রচণ্ড শীত, বরফ পরছে, তার মধ্যেও তাদের কাজে নামতে হয়। আবার ঝড়ো হাওয়া, সাথে বৃষ্টি, এর মধ্যেও রেইনকোট পরে কাজে নামতে হয়।
ইঞ্জিনিয়ারদের বড় সমস্যা গরম এলাকা, যেমন রেড-সি। পুরো ইঞ্জিনরুম তন্দুরের পরিণত হয়, তখন হয়ত ডেক ক্রুরা খোলা বাতাসে কাজ করছে।
আজকের তাজা খবর হল পোর্ট নেচেসে আমাদের ইন্সপেকশনের জন্য কোন বুকিং পাওয়া যায় নি। সুতরাং জরুরী ভিত্তিতে জাহাজের জন্য গ্যাল্ভেস্টনে ইন্সপেকশন করানোর চেষ্টা চলছে। শুধু ইন্সপেকশনের জন্যই জাহাজ পোর্টে যাবে, কোন লোডিং ডিসচার্জিং নয়। ইন্সপেকশন জরুরী কারণ এটা ছাড়া এমেরিকান জলসীমায় কোন ব্যবসা করা যাবেনা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করা ছাড়া যেমন গাড়ি চালানো যাবেনা। আবার অন্য দিকে আমরা কান্নাকাটি করছি আমার টেস্ট নাও, বিআরটিএ থেকে সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ওরা একটা ওয়েভার ইস্যু করে, যে এত দিনের জন্য বিশেষ অনুমতি দেয়া হচ্ছে। ১৯ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমরা সেভাবেই চলব। সকাল থেকে গ্যাল্ভেস্টনে বুকিং এর জন্য তোড়জোড় চলছে। একজন এজেন্ট এপয়েন্ট করা হয়েছে, সে এসব কাজ করবে। কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্ন ডকুমেন্ট লিস্ট পাঠাচ্ছে, সেসব পূরণ করে পাঠানো হচ্ছে। দুপুরের দিকে কনফার্ম করা হল যে আমাদের জন্য একটা সিট খালি পাওয়া গেছে, তবে একটা ইটা রাখতে হবে, অন্য কেউ এসে যাতে দাঁড়িয়ে না যায়। ইটা মানে হল আমাদের দ্রুত একটা এরাইভ্যাল রিপোর্ট সাবমিট করতে হল, আমরা ২০ তারিখ সকালে গ্যাল্ভেস্টন এর এত নাম্বার জেটিতে জাহাজ ভেড়াব, সেখানে যেতে পারি আর না পারি। এখন মোটামুটি কনফার্ম ইন্সপেকশন হবে।
দুপুরে লাঞ্চের পর সব ক্রুদের মিটিং ডাকা হল, আমরা বলি সেফটি মোমেন্ট। এটা প্রতিদিনই করতে হয়, কিন্তু আমাদের পক্ষে সময় বের করা কঠিন হয়ে যায় অপারেশনের জন্য। ১২-১ টা লাঞ্চ টাইম। ১ টা বাজে কাজে না গিয়ে সবাই জড়ো হয় ব্রিজে, তারপর মিনিট পনের সেফটি নিয়ে ভালোচনা চলে, এটাই আমাদের সেফটি মোমেন্ট। আজকের ভালোচনা সেই ইন্সপেকশন নিয়ে। আর একই সাথে আরেকটি বিষফোঁড়া চলে এসেছে, তা হল আমাদের ভেটিং ইন্সপেকশন। জানানো হয়েছে পরের ভয়েজেই আমাদের ভেটিং হবে। এটা হয় প্রতি চার মাসে একবার, তবে এর জন্য বুকিং এর প্রয়োজন নেই। কোম্পানি কোন থার্ড পার্টি ইনস্পেক্টরকে ডাকে, এসে জাহাজ পরীক্ষা করে যাবে। কোস্ট-গার্ড ইন্সপেকশন যদি ডিগ্রী পরীক্ষা হয়, ভেটিং হল বিসিএস। পুংখানুপুংখানু ভাবে সব কিছু পরীক্ষা করা হবে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এটা অনেকটা চাকরির ইন্টার্ভিউর মত। এসব ইন্সপেকশনের উপর আমাদের ব্যবসা নির্ভর করে। আমাদের যারা ভাড়া করে তারা এসব ইন্সপেকশন পরীক্ষা করে দেখে যে আমরা কেমন রেজাল্ট করেছি। পরীক্ষক হল শেল, মবিল, বিপি’র মত বড় বড় তেল কোম্পানি। কোস্টগার্ড হল শুধু দেখবে আমার উত্তর সঠিক হয়েছে কিনা, আর ভেটিং হল আমার ‘ক’ লেখা টা ঠিক হয়েছে কিনা, মাত্রা অর্ধেক না পুরা দিয়েছি, হাতের লেখা কত সুন্দর, একেক পরীক্ষকের একেক নখরা।
সবাইকে বলে দেয়া হল কামে লেগে যাও, প্রতিদিন দুই পাতা লেখ ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’।
মেসেজ চলে এসেছে আমাদের পাইলট আসবে আগামীকাল সকাল এগারটায়, খুবই মধুর সময়। সকাল সকাল উঠে নোঙর তুলতে হবে না, দশটার দিকে তুললেই চলবে। ঠিক সময় পাইলট উঠলে বিকেল পাঁচটায় বন্দরে পৌঁছে যাব, এবং সন্ধ্যায় হয়ত বাইরে ঘুরতেও যাওয়া যাবে। দুপুরের পর পাইলট আসলে জাহাজ বাঁধতে বাঁধতে ৭-৮টা বেজে যায়, বাইরের যাবার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ১১টা পারফেক্ট টাইম।
[caption id="attachment_51618" align="alignnone" width="208"] ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ[/caption]
সন্ধ্যা বেলা আবহাওয়া হটাত উত্তপ্ত হতেয় শুরু করল, বাতাসের গতিবেগ উঠে গেল ৫০-৬০ কিমি। মোটেও ভালো কিছু না, সাবিন নোঙর এমনিতেই খুব সঙ্কীর্ণ, নোঙর তুলে বের হবার পথও চিপা গলি, তাই টেনশন কাজ করে বেশী। তবে রাতের দিকে আস্তে আস্তে নেমে আসতে শুরু করল বাতাসের বেগ।
সকালে তাড়াহুড়ার কিছু নেই, তারপরেও ডিউটি অফিসারদের বলে রাখলাম সকালে একবার রেডিওতে কল করে জেনে নিতে কটা বাজে পাইলট। এ বন্দরে পাইলট পিছাতে থাকে অবিরাম। নাইট অর্ডার লিখে রাতের জন্য ছুটি। ভরাত্রি। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
স্বত্বাধিকারী নোঙর নিউজ | ও সম্পাদক - সুমন শামস
Developed by KetNey Pvt .Ltd. and UnivaHost