মায়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জটিল আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি জটিল হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায়। কাটছাঁট করতে হয়েছে খাদ্য সহায়তা। ক্যাম্পগুলোতে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের ব্যবস্থাপনা খুব জটিল হয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে চীন। বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মায়ানমারের সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধের কারণে সেই সম্ভাবনায় আপাতত আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, মায়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এমনিতেই প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ নেই, তারপর এখন এই ঝামেলা। এটা প্রত্যাবাসন পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
রাখাইনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় এখন বাংলাদেশকে মায়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু করার তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তবে এই প্রস্তাবের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণ করলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে কি-না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
কারণ রাখাইনের বাসিন্দারাও রোহিঙ্গাদের পছন্দ করে না। ২০১২ সালে রাখাইনের বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে দাঙাও লাগিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে হংকংভিত্তিক গণমাধ্যম এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরাকান আর্মির কমান্ডার ইন চিফ থোয়ান ম্রা নাইং রাখাইন শব্দটিকে প্রকাশ্যে আপত্তির কথা জানান।
উদ্বেগজনকভাবে কমেছে আন্তর্জাতিক সহায়তা:
২০১৭ সালে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সে সময় বিপুল আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসে ধনী দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা দিয়েছে বলে জানায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
এদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর দেশটি থেকে লাখ লাখ শ্বেতাঙ্গ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। অবস্থা এমনই যে, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআরের হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন বিশ্বের মনোযোগ হারিয়ে না যায়। রোহিঙ্গা সংকটের দিকে যেন বিশ্বের মনোযোগ বজায় থাকে।
শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) জার্মানির মিউনিখে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, বিশ্বব্যাংক এ বছর রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য ৭০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অঙ্গীকার করলেও প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। ইউএনএইচসিআর ২০২২ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে ৮৮১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছিল। কিন্তু পেয়েছিল মাত্র ২৮৫ মিলিয়ন ডলার।
ভয়াবহ খাদ্যসংকটের আশঙ্কা:
রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমছে ২০১৯ সাল থেকেই। ২০২৩ সালের আগে প্রতিজন রোহিঙ্গার জন্য খাদ্যের বাজেট ছিল ১২ ডলার। সেটি কমে এখন ১০ ডলার করা হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ তথ্য জানায়।
ডব্লিউএফপি জানায়, অনুদানে ১২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার কম থাকায় প্রত্যেক রোহিঙ্গার জন্য ডব্লিউএফপির ১২ ডলারের খাদ্যসহায়তার পরিমাণ কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, খাদ্যসংকটের খারাপ প্রভাব পড়ায় রোহিঙ্গারা কাজ খুঁজতে ক্যাম্পের বাইরে যেতে চাইছে এবং নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরাও পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘৪৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার প্রয়োজনীয় খাবার খেতে পারে না। শিবিরে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো শিশুর সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধি হয় না। অন্তঃসত্ত্বা ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন নারীদের ৪০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। এটাও বাড়ছে, বাড়ছে অপরাধ।
দ্যসংকটসহ নানা কারণে রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পালিয়ে এসব রোহিঙ্গা লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। জীবনধারণের জন্য জড়িত হচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) এক প্রতিবেদন বলছে, ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৫ হাজার ৮২২ জন। এই হিসাবের মধ্যে রয়েছে ১৯৯১ সালে আসা ৩৪ হাজার রোহিঙ্গাও। বাকি দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা কোথায় গেছে, তা কারও জানা নেই। তবে সরকারি-বেসরকারি সব মহলই মনে করছে, এসব রোহিঙ্গা লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকেই মাদক চোরাচালান যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবহারও। গত বছরের শেষ দিকে টেকনাফে রীতিমতো অস্ত্র কারখানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখান থেকে ৬ জনকে আটকের পর র্যাব জানতে পারে এই অস্ত্রের একটা অংশ যেত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
কক্সবাজারের উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরাই এখন আতঙ্কে থাকি। রোহিঙ্গারা আসার পর এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধে যুক্ত। এলাকার অনেক মানুষকে অপহরণ করে তারা মুক্তিপণ আদায় করছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে বিষয়টি জানিয়েছি।’