গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই

0
6

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

৮২ বছর বয়সী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। কিছু দিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগেও ভুগছিলেন। গত বুধবার তাঁকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রধান কিডনি বিশেষজ্ঞ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রধান চিকিৎসক অধ্যাপক মামুন মোস্তাফী আজ রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।

মৃত্যুর খবর জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফেইসবুক পাতায় বলা হয়েছে, “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রাণ পুরুষ, প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১১ এপ্রিল (মঙ্গলবার) আনুমানিক রাত ১০:৪০ এ গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।”
জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাস্কুলার সার্জন। তিনি মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালর ওষুধ নীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।

একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহর পরে বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করায়ও তার অবদান স্মরণ করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। তবে এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

নানা রোগে কাবু হয়ে গত কিছুদিন ধরে হাসপাতালে ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তার লিভারেও সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া তিনি অপুষ্টিসহ সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত বলে চিকিৎসকরা জানান।

গত ৩ এপ্রিল নগর হাসপাতালে ভর্তির পর সেখানেই তার চিকিৎসা চলছিল। গত রোববার তার শারীরিক অব্স্থার উন্নতি না হলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। অবস্থার অবনতি না ঘটল তাকে সোমবার নেওয়া হয়েছিল ‘লাইফ সাপোর্টে’।

এরপর মঙ্গলবার সকালে মেডিকেল বোর্ড বসে তার রক্তে সংক্রমণ পাওয়ার কথাও জানায়। তবে দুপুরে তার কিডনি ডায়ালাইসিস শুরু করা হয়েছিল। এরপর রাতেই এল মৃত্যুর খবর।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।

এরপর উচ্চ শিক্ষা নিতে তিনি যুক্তরাজ্যে গেলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন।

লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন জাফরুল্লাহ, পরে সেখানেই ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিবেদিত হন। তার এই বড় ভূমিকার কথা এখনও স্মরণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

স্বাধীনতার পর মেলাঘরের সেই ফিল্ড হাসপাতালকে ঢাকার ইস্কাটনে নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পরে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘চল গ্রামে যাই’ এই স্লোগান নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয়। তখন এর নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাধীনতার পর নারীর ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক কর্মী নেওয়া হয়েছিল নারীদের মধ্য থেকে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন তিনি।

কোভিড মহামারীর সময় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে নমুনা পরীক্ষার কিট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, যদিও সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।

দুটি কিডনি নষ্ট হওয়ার পরও নানা সঙ্কটে সমাধান খুঁজতে ছুটে বেড়িয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘র‌্যামন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ হিসেবে সম্মাননা দেয়।

খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী; কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি বলতেন- “আমি মানুষের রাজনীতি করি।”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে