প্রথম সকালঃ ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
17

ঢিমে তালে রওনা হয়েছি। দিনে স্লো-এহেড, বলতে গেলে কোয়ার্টার স্পীড, রাতে আধা স্পীড বা হাফ এহেড। রাতে ইঞ্জিনরুমে কেউ থাকেনা, আন-ম্যানড বলি আমরা, তাই তখন একটু গতি বাড়িয়ে দেয়া হয়। স্লো স্পীডে চললে কিছু জটিলতার সম্ভাবনা থাকে, আন-ম্যানড অবস্থায় সে ঝুকি নেই না। হাওয়াই থেকে পানামা ৯০০০ কিলমিটারের মত, এমনিতে ১৪-১৫ দিনে পৌঁছে যাবার কথা।

এখন ধীর গতিতে চলার কারণে ২০ দিনে পৌঁছব, এবং তাতে তেলের সাশ্রয় হবে। স্বাভাবিক গতিতে চললে প্রতিদিন ৩৪ টন হিসেবে ৫১০ টন তেল লাগবে, ধীর গতিতে চললে প্রতিদিন ২২ দিনে ২০ টন হিসেবে ৪৪০ টন লাগবে, হয়ত ৬০-৭০ টনের মত সাশ্রয় হবে, যার মুল্য প্রায় ৪২০০০ ডলার বা ৩৬ লাখ টাকার মত। যখন বাজার খারাপ থাকে, তখন এভাবেই কৃচ্ছতা সাধন করতে হয়। যা হোক আমি আদার ব্যাপারী, এতে আমার কিছু আসে যায় না, আমার বেতন ঘন্টা হিসেবে, মাইল হিসেবে না।

দায়িত্ব নেবার পর জাহাজে আজ আমার প্রথম সকাল। এখনও সকালে ঘুম ভাঙছে, ব্রিজে ঘুরে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নাস্তার জন্য গেলাম। আমাদের চিফ-কুক ভারতীয়, সেকেন্ড কুক মালায়সিয়ান।

মালায়সিয়ান ক্রুদের সম্বন্ধে অনেকের মন্তব্য নেতিবাচক, বিশেষ করে কুকের ব্যাপারে, অন্য সব কুকরা বহুজাতিক খাবার প্রস্তুতের ব্যাপারে সচেতন থাকে, কিন্তু মালায়সিয়ানরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের কোম্পানির জনবল সর্বদা বহুজাতিক, প্রতি জাহাজে অন্তত পাঁচ ছয় দেশের নাগরিক থাকে, এমন কি ৮-৯ দেশের নাগরিকও পেয়েছি দু একবার। তাই খাবার এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যাতে সবার জন্যই তা গ্রহনযোগ্য হয়।

তবে অন্য দেশীদের রান্না হোক বা না হোক, ভারতীয় বা আমাদের উপমহাদেশীয় টাচ খাবারে থাকতে বাধ্য। আমি সর্বদা মনে মনে ভাবি, খাবারের ব্যাপারে আমরা খুবই স্বার্থপর, আমাদের বেসিক খাবার থাকতে হবে, এর পর অন্যাদেরটা।

ভাত, কারী, ডাল থাকতেই হবে, সন্ধ্যায় রুটি, রবিবার বিরিয়ানির বিকল্প নেই। যেহেতু চীফ কুক ভারতীয়, লাঞ্চ ডিনার নিয়ে চিন্তা নেই। ফিলিপিনো কুক পাঠালেও নিশ্চিত করা হয় যে সে উপমহাদেশীয় খাবার রান্নায় পারদর্শি। সকালের খাবার তৈরি করে সেকেন্ড কুক। নাস্তায় জ্যাম, জেলি, রুটি, দুধ, জুস, হাফ ডজন মডেলের সিরিয়াল, এগুলো থাকতেই হবে। এর পর নির্ভর করবে সেকেন্ড-কুক কি রান্না করে। কুক সাধারণত ডিম, সসেজ, নুডল এসব তৈরি করে। কিন্তু মালায়সিয়ান সেকেন্ড কুকের নাস্তা দেখে মোটামুটি বিস্মিত হলাম। ডিম সেদ্ধ, ডিমের ভুজিয়া (স্ক্র্যামল্ড এগ), ব্রেড, কেক, সসেজ মাসাল্লা, আলু-কপি ভাজি, ফ্রাইড রাইস, এমনকি সূপও তৈরি করেছে। যাক, ঢাকা থেকে আসার সময় পাক্কা টার্গেট নিয়ে এসেছি, ওজন কমাতেই হবে, দেখা যাক।

প্রতিদিন সকালে কাজ শুরু হয় আটটা বাজে, তার দশ মিনিট আগে ডেকের ক্রুরা জড়ো হয় শিপ’স অফিসে, ইঞ্জিন ক্রুরা জড়ো হয় ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুমে। আমরা এটা কে বলি টুল-বক্স মীটিং। সারাদিনে যেসব কাজ হবে তা নিয়ে চীফ অফিসার এবং সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিজেদের ডিপার্টমেন্টে আলোচনা করবে। এসব কাজে কি কি ঝুঁকি থাকতে পারে, কে কোন কাজ করবে, কার সাথে কে গেলে সুবিধা হবে, এসব কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল, সারঞ্জাম আছে কিনা পর্যালোচনা করা হবে। মীটিং এ ক্যাপ্টেনের উপস্থিতির দরকার নেই, তবুও আজ আমি গেলাম, উদ্দেশ্য ক্রুদের সাথে পরিচিত হওয়া, নিজের টার্মস এন্ড কন্ডিশন বলে দেয়া। গিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষন দিলাম, যার বিষয়বস্তু হলো আমি এসব জিনিষ আশা করি, এসব জিনিষ আমি পছন্দ করিনা, এবং আমার কাছ থেকে তারা কি কি আশা করতে পারে। অতঃপর ডেক রাউন্ড নিয়ে সব দেখে নেয়া, চীফ অফিসারের সাথে বসে জেনে নেয়া কি কি কাজ আগে থেকে চলছিল, এবং আগামী দিন গুলিতে কি কি কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

দিনভর পুরনো মেইল, পেপার ওয়ার্ক দেখেই দিন কেটে গেল। আবহাওয়া এখনও বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। পানামা পর্যন্ত আগামী বিশ দিনের চেহারাটা একটু দেখে নিলাম, রিপোর্ট দেখে মনে হলো না কোন বড় ধরনের ঝড় ঝাপ্টার সম্মুখীন হবো। এরপর ক্যাবিন গুছানো, লাগেজ খুলে জামা কাপড় কাবার্ডে রাখা, টয়লেট্রিজ সাজিয়ে রাখা, ডকুমেন্টস আমার এডমিন এসিস্ট্যান্ট এর কাছে বুঝিয়ে দেয়া, সব মিলিয়ে নূতন সংসার গুছিয়ে নেয়া বলা চলে।

দুপুরের লাঞ্চের সময়েও ডায়েটিং এর ব্যাপারটা ভুলে গেলাম ক্ষণিকের জন্য। চীফ কুক উত্তর ভারতের লোক, সম্পুর্ন নিরামিশাসী, কিন্তু তিন প্রকারের আমিষ রান্না করেছেন। আমিষ রান্না করার সময় চেখে দেখতে পারেনা, অনেকটা ব্লাইন্ড কুকিং, তারপরেও খুবই ভালো রান্না। টেবিলে এসে জানতে চাইল আমি কোন মেন্যু দেব কিনা কারন অনেকেই সপ্তাহের মেন্যু ধরিয়ে দেয়। বললাম এটা আমার পছন্দ না, আমি সারপ্রাইজ পছন্দ করি, গত চার দিনে আইটেমের পুনরাবৃত্তি দেখিনি, সুতরাং এভাবেই চলুক। অনেক কুক দেখা যায় একই রকমের রান্না প্রতিদিন করছে, তখন তাদের জন্য মেন্যু ধরিয়ে দেই, যেমন দুপুরে বেকড ফিস, বিফ কারী, ফ্রাইড চিকেন হলে রাতে পালটে দিতে হবে, প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন স্যুপ দিতে হবে। অরহর, মুগ, মশুর, সবুজ মুগ, কিডনি বীন, চনা ডাল, ছ’দিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিতে হবে। জাহাজে আমাদের খাবার প্রথমত কুক, দ্বিতীয়ত ক্যাপ্টেনদের উপর নির্ভর করে। অনেক কুক নিজ থেকেই ভাল, তাদের কিছু বলতে হয় না, ক্রিয়েটিভ রান্না করে। আবার অনেক কুকের দক্ষতা আছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন যদি নজর না দেয়, সে ফাকি দেয়। আর কপালে লিখা থাকলে এমনও পাওয়া যায়, তার দক্ষতা ও নেই, আগ্রহও নেই, এবং ভাগ্যগুনে এমন কুক পেয়ে গেলে মেদ-ভুরি অটোম্যাটিক বিদায় নেয়।

আমরা এখনও হাওয়াই দ্বিপপুঞ্জের সীমানার মধ্যেই আছি, দুই দ্বীপের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছি উন্মুক্ত প্যাসিফিকের দিকে। ভোর রাতে আমরা ECA (Emission Control Area) ছেড়ে বেড়িয়ে যাব, তখন থেকে ইঞ্জিন ডিজেল এর পরিবর্তে হেভি অয়েলে ব্যাবহার করবে। তাই ভোর বেলা ইঞ্জিনিয়ারদের জানাতে হবে সাথে আমাকেও।

সেকেন্ড অফিসার লিও ইলেকট্রনিক চার্টে(ন্যাভিগেশন ম্যাপ) আগেই মার্ক করে রেখেছে, কোথায় পৌছলে ক্যাপ্টেন এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জানাতে হবে। রাতে মাস্টার্স নাইট অর্ডারে শেষ নির্দেশ লিখে রাখলাম, অবশ্যই ECA সীমানা পার হবার সময় আমাকে ডাকতে হবে, এছাড়াও যখনই প্রয়োজন আমাকে ডাকতে হবে। ন্যাভিগেশন অফিসারদের জন্য একটা তালিকা থাকে, কি কি পরিস্থিতিতে মাস্টারকে ডাকতে হবে। সার্টিফিকেট নেবার সময় লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা হয়, দুট পরীক্ষাতেই খুব কমন প্রশ্ন, “কলিং দা মাস্টার”।

মৌখিক পরীক্ষায় এতে ভুল করলে ফেল মোটামুটি নিশ্চিত। দশ বারো টা আইটেমের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন, যখনই কোন ব্যাপারে তোমার ডাউট হবে, মাস্টারকে ডাকতে হবে। এই ডাউট বা অনিশ্চয়তা ব্যাপারটি খুবই বিভ্রান্তিকর, কখন কাকে ডাউট বলা হবে এটা লাখ টাকার প্রশ্ন। এর সহজ ব্যাখ্যা হল, তুমি যদি চিন্তা করো, আচ্ছা ক্যাপ্টেনকে কি এখন ডা্কা উচিৎ হবে? নাকি একটু পরে ডাকব? এর মানেই হল “ডাউট। ডাকতে হবে কিনা এমন প্রশ্ন মনে উদয় হওয়াকেই ডাউট বলা হয়, মানে তুমি দ্বিধান্বিত, অতএব অবশ্যই এখন ক্যাপ্টেনকে ডাকতে হবে। জাহাজে ন্যাভিগেশন সম্পর্কিত দুর্ঘটনার অন্যতম কারন এই ডাউট।

প্রথমদিনই আমি ন্যাভিগেশন অফিসারদের ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে দেই। আজও বারটার আগেই ঘুমাতে যাচ্ছি, ৮-১২ টা পর্যন্ত ডিউটিতে থাকে থার্ড অফিসার, সে সবার জুনিয়ার, সুতরাং তাকে ডাউটের ব্যাপারটি আবারো বুঝিয়ে চলে এলাম, শুভরাত্রি।

ছবি: এমেরিকান সাবমেরিন। ১৮ নভেম্বর, ২০২১

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে