হোম-নট সো সুইট: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
5
লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

রাতে ঘুমের আগা মাথা অন্যান্য দিনের মতই ছিল, তবে পার্থক্য হল আজকে ব্রেকফাস্ট করে আর ঘুমানোর উপায় নেই। যেহেতু রাতে ডিনার করিনি, সকালে স্টারবাকসের ডাবল ব্রেকফাস্ট অর্ডার করে পেট পুরে খেলাম সাথে সিগনেচার কফি।

এমেরিকাতে এজেন্টদের কখনও এক মিনিট দেরীতে আসতে দেখিনি, তবে আগে আসতে দেখেছি, এবং আজকেও তাই এলো। ১০ মিনিট আগেই বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে নীচে নেমে বসে বসে নেটিং করছিলাম। রাকেশ এবং মালিক ও চলে আসলো ছয়টার মধ্যে আর রওনা হলাম লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশ্যে।

জাহাজ সমুদ্রে, আমাদের লঞ্চ নিয়ে যেতে হবে। সাড়ে ছয়টায় আমাদের ঘাটে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার চলে গেল, ঘাটের লোক জানালো যে সাতটায় লঞ্চ রওনা হবে। মিনিট দশেক পরে আরেকটি গাড়ি এসে থামল, আমাদের এজেন্সির আরেক ড্রাইভার। আমরা তিনজনের বাইরে অন্য কেউ যাচ্ছে জানতাম না, এখন দেখি আরেক জন এসেছে ছোট একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে, এবং বুঝে গেলাম ডাল মে কালো কালো কিছু রয়েছে। আমি একটু দূরে দুরেই হাটাহাটি করছিলাম, সে রাকেশ ও মালিক এর সাথে কথা বলছিল।

এগিয়ে যাবার পর বলল, ক্যাপ্টেন আমি তোমাদের জাহাজের ভেটিং করতে যাচ্ছি। মাসাল্লাহ, এর চেয়ে ভালো খবর আর কি আছে। ভেটিং হল জাহাজের হেলথ চেক-আপ এর মতো, যা শুধু ট্যাংকার জাহাজের জন্যই হয়। আমাদের কাস্টমার হল সব হোমরা চোমরা লোকজন, এরা এমনিতে গাড়ি ভাড়া করেনা। গাড়ি ভাড়ার আগে তারা ডাক্তারের রিপোর্ট দেখে, এবং সেই রিপোর্ট আবার আমাদের পকেটের টাকা খরচ করেই করাতে হবে, এবং একটা চেক-আপ করাতে আট দশ লাখ টাকাও বেড়িয়ে যায়। জাহাজের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন, কখনোবা চীফ ইঞ্জিনিয়াররা জাহাজের চাকরী ছেড়ে তার জাত ভাইদের পশ্চাৎ দেশে অঙ্গুলি দেবার কাজটি গ্রহণ করে। জাহাজের মালিকরা প্রতি তিন চার মাস পর পর এসব ডাক্তারদের ডাকবে জাহাজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। অনেক বন্দরেই তাদের আবার কাছে পিঠে পাওয়া যায় না, উড়িয়ে আনতে হয় অন্য শহর, কখনও বা অন্য দেশ থেকে। এই ভদ্রলোক এসেছে ক্যানাডা থেকে, প্লেন ভাড়া দিয়ে আনা হয়েছে, পাঁচ তারকা হোটেলে রাখা হয়েছে।

অনেক সময় হেলিকপ্টার দিয়েও জাহাজে নিতে হয়, তবে এবার আমাদের সাথে একই লঞ্চে যাওয়াতে খরচ কিছুটা সাশ্রয়। উনি জাহাজে আসবেন, তাকে জামাই আদর করা হবে। উনি আট ঘণ্টা ধরে জাহাজকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন, টোকা মেরে দেখবেন, খোঁচা মেরে দেখবেন, বিগত বছরগুলোর কেস-হিস্ট্রি দেখবেন, তাকে কিভাবে যত্ন করেছি তার রেকর্ড দেখবেন, এমন কি আমরা সবাই যারা জাহাজের সেবা শ্বশ্রূসায় নিয়োজিত তাদের যোগ্যতা কেমন, তাও দেখবেন। তারপর দিন শেষে উনি বের করবেন তার ভ্রু তেরা, চোখ ট্যাঁরা। লিপস্টিক ঠিকমতো লাগানো হয় নি, গাঁয়ের চামড়া খসখসে, সানস্ক্রিন নেইল পলিস মোটেও ভালো ব্র্যান্ডের না।

আর যদি কোন ভাবে বের করতে পারেন, উপরে দেখতে যেমনই হোক, তার ব্লাড প্রেশার আছে, কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, ঠিকমতো দৌড়াতে পারেনা, হাঁটুতে ব্যথা আছে, তাহলে সানডে মানডে ক্লোজ। পাত্রী দেখা শেষ হলে একখান রিপোর্ট তৈরি করবেন, সেখানে লেখা থাকবে সারাদিনে তিনি কি কি খুঁত খুঁজে পেয়েছেন। এটুকু হলেও চলতো, কিন্তু এখানেই থামবেন না। রিপোর্টটি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেবেন, সেটা ভালো হোক বা মন্দ হোক। ভাইরাল মানে শাদী ডট কমের ওয়েবসাইটে তুলে দেবেন, দুনিয়ার তাবৎ পাত্ররা মানে শেল, মবিল, বিপি’র মতো আমাদের যতো খদ্দের আছে তারা পুরো রিপোর্ট দেখতে পাবে, আর জানবে আমাদের কন্যা দেখতে রূপবতী হলেও চরিত্র খারাপ। ট্যাংকার জাহাজে আমরা ঝড় কে পাত্তা দেই না, কিন্তু এরকম ইনস্পেকটর আসার আগের কয়েক সপ্তাহ ঘুম হয় না, কোথায় না খুঁত রয়ে গেল এই ভেবে।

যা হোক সাতটা বাজে পাত্র পক্ষের গোয়েন্দা নিয়ে রওনা হলাম জাহাজের দিকে। আমাদের জাহাজ জেটিতে নেই, বলা চলে এতো বড় জাহাজের জন্য এখানে জেটি বানানো হয় নি। সাগরে SBM মানে সিঙ্গেল বয় মুরিং এ জাহাজ বাঁধা। একটি বড় বল সাগরে ভাসমান থাকে, তাকে জায়গায় রাখা হয় কয়েকটা নোঙর দিয়ে।

এই বয়ার সাথেই জাহাজ নাকে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। কিনারার রিফাইনারি থেকে সাবমেরিন পাইপ দিয়ে সংযুক্ত থাকে বয়া, সেখান থেকে ভাসমান রাবার পাইপ দিয়ে জাহাজের সাথে যুক্ত করা হয়। জাহাজ থেকে আমরা পাম্প চালাই, তেল আমাদের ট্যাংক থেকে রাবারের পাইপ হয়ে বয়ার সাথে সংযুক্ত সাবমেরিন পাইপ দিয়ে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দুরের রিফাইনারিতে চলে যায়। আমরা সব পাম্প চালালে ঘণ্টায় প্রায় ১০৫০০০০০ লিটার, বা মিনিটে ১৭৫০০০ লিটার, বা সেকেন্ডে ২৯০০ লিটার তেল খালাস করতে পারি।

আটটা বাজে পৌঁছে গেলাম আমার আগামী চার মাসের বাড়িতে। আগের জাহাজে ফেরা যদিও হোম সুইট হোম না, তবুও মনে হয় পরিচিত আবাস। সব কিছুতেই নিজের একটা অধিকার বোধ থাকে, মনে হয় আমার নিজের বাড়ি। আমি এটা এখানে রেখে গেছিলাম নেই কেন? আমি এভাবে সিস্টেম করেছিলাম তা মানা হচ্ছে না কেন, এরকম নানাবিধ কমপ্লেক্স কাজ করতে থাকে।

জাহাজের ক্যাপ্টেন আমার পূর্ব পরিচিত, চীফ অফিসার থাকাকালীন সময়ে আরেকবার তাকে আমি রিলিভ করেছিলাম। খুবই হাসিখুশি মানুষ, সর্বক্ষণ সরব, আদরের গালি ছাড়া কাউকে ডাকেনা, আর তার এরকম ডাকে সবাই হাসে। ইনস্পেকটরের প্রথম কাজ হল সবাইকে নিয়ে ওপেনিং মীটিং করা, কখন কি পরিদর্শন করবেন তার বিস্তারিত টাইম ফ্রেম বুঝিয়ে দেয়া। সে মীটিং এ ক্যাপ্টেন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল যে উনি জাহাজের মালিক, আমি সাময়িক ভাবে এসেছিলাম, এখন চলে যাচ্ছি, কোন কিছু হলেই মালিক কে ধরবেন। এটা বলার কারণ এ নিয়ে তৃতীয়বার এ জাহাজে আসা এবং সিস্টার শিপ মিলিয়ে চারবার।

ইনস্পেক্টরের আদি নিবাস ও পাঞ্জাব, ক্যাপ্টেন আর সে একই কলেজে পড়াশুনা করেছেন কয়েক বছরের ব্যবধানে, সুতরাং প্রচুর স্মৃতিচারণ চলতে লাগল জাহাজের ডকুমেন্ট পরীক্ষা করে দেখার পাশাপাশি। ক্যাপ্টেন অনবরত কথা বলেই চলছে, তার কারণ সে যাতে ত্তো মনঃসংযোগ করতে না পারে। যদিও এসব ব্যাপারে অনেক ক্যাপ্টেনরা খুব পারদর্শী, আমি এখানে খুবই দুর্বল। সারাদিন এভাবে ইনস্পেক্টরের সাথেই কাটল, সে যেসব জায়গায় গেল আমরাও সঙ্গী হলাম, সে নোট বুকে খুঁজে পাওয়া খুঁত টুকতে লাগল, বিকেল সাড়ে তিনটায় সব শেষ করল।

এবার হবে মীটিং, তাকে একটু পটিয়ে পাটিয়ে রিপোর্ট টি যতটা সুন্দর করা যায়, যেমন পাত্রী ফর্শা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা, চোখ গুলি একটু ছোট কিন্তু পাওয়ার সিক্স বাই সিক্স। যা হোক সব শেষে কনে দেখার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হল, আমাদের জাহাজ আসলেই ভালো, তারপরেও দশ বছরের পুরনো জাহাজে কিছুনা কিছু তো পাবেই। খুবই সামান্য দুটি খুঁত তিনি উল্লেখ করেছেন, সে হিসেবে তাকে বেশ নমনীয়ই বলা যাবে। চারটা বাজে বোট আসল তাকে নেবার জন্য, যার ভাড়া টরোন্টো-হাওয়াই রিটার্ন ফ্লাইটের টিকিতের চেয়েও বেশী হবে। কিন্তু তাকে বিদায় দিয়ে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, এবং বলা চলে অনেকটা উল্লাসিতই হলাম খুবই অল্পতে পার পেয়ে যাবার জন্য।

জাহাজের কার্গো কাল সকালে শেষ হবে, তারপর আমরা এখান থেকে যাব নোঙরে। সারাদিনে ইন্সপেকশনের সাথে সাথে দু চারজনের সাথে পরিচিত হয়েছি, একমাত্র সেকেন্ড অফিসার লিউ ২০১৯ এ আমার সাথে এ জাহাজেই চাকরী করেছে, বাকি কারও সাথে পরিচয় নেই। এমনিতে রাতে ঘুম হয়নি কিন্তু উঠতে হয়েছে ভোর পাঁচটায়। সারাদিনে কোন বিশ্রাম মেলেনি, বরঞ্চ অনেক হাটাহাটি হয়েছে। সব মিলিয়ে বেশ ক্লান্ত, ক্যাপ্টেনকে বললাম আজ আর কোন হ্যান্ড-ওভার নিয়ে কথা বার্তা বলবো না, আমি ঘুমাতে যাবো।

ক্যাপ্টেনও ক্লান্ত, শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিক ভাবে। এক দীর্ঘ দিন শেষে বিশ্রাম এবং শুভ রাত্রি। ১৫ নভেম্বর, ২০২১

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে