স্যান্ডউইচ-একটি খাবার এবং দ্বীপপুঞ্জের নাম: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
12
স্যান্ডউইচ-একটি খাবার এবং দ্বীপপুঞ্জের নাম। লেখা এবং ছবি : আব্দুল্লাহ মাহমুদ

ব্রিটেনে একসময় বাংলাদেশের মতই আধুনিক রাস্ট্রব্যবস্থা ছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহান সদস্যরা তখন দেশের গুরুত্বপূর্ন পদে নেতৃত্ব দিত। যে কোন পদে নিয়োগ দেবার আগে রক্ত পরীক্ষা করা হতো। আভিজাত্যের মাপকাঠিতে তাদের পদায়ন হতো। ব্রিটিশ যুব পার্টির প্রধান কিংবা ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড অথবা লন্ডনের মেয়র, এসব পদ তাদেরই দেয়া হতো যাদের রক্ত হতো গাড় নীল।

জন মন্টাগু ছিলেন তেমনই একজন ব্যক্তি। পোস্টমাস্টার জেনারলে, ব্রিটিশ এডমিরালটির প্রধান কিংবা সেক্রেটারি অফ নর্দার্ন স্টেট, এরকম অনেক গুরুত্বপূর্ন পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছে। ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড বা ইসিবি’র প্রধান হবারও সব যোগ্যতা তার ছিল, কারন ক্যাসিনো বা জুয়ার প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা।

খেলা তিনি খুবই ভালবাসতেন, দিনভর জুয়ার টেবিলে প্র্যাকটিস করতেন। এতটাই নিমগ্ন থাকতেন যে খাবার জন্যও টেবিল ছেড়ে উঠতেন না। অনুশীলনরত অবস্থায়ই স্টুয়ার্ড কে ডেকে বলতেন দুপিস রুটির মাঝে এক পিস মাংস দিয়ে নিয়ে আসো। প্রায় প্রতিদিনই সে এভাবে খেলার মাঠে, মানে খেলার টেবিলে তার খাওয়া সারতেন।

ইংল্যান্ড বা ব্রিটেনে এসব নীল রক্তধারীদেরকে কেউ আসল নামে ডাকত না, ডাকা হতো তাদের জমিদারী বা এলাকার নামে। জন মন্টাগু ছিলেন “ফোর্থ আর্ল অফ স্যান্ডউইচ”, সবাই তাকে “লর্ড স্যান্ডউইচ” বলে ডাকত। জুয়ার মাঠে তার টীমমেটরাও তার অধ্যাবসায়ে অনুপ্রানিত হয়ে টেবিলে বসেই খেয়ে নিত।

স্টুয়ার্ডকে ডেকে বলতো, আমার জন্যও লর্ড স্যান্ডউইচের মতো খাবার দাও। পরে সংক্ষিপ্ত ভাবে বললেই হতো আমার জন্য একটা স্যান্ডউইচ, আর তাতেই স্টুয়ার্ড বুঝে যেত যে দুই ফালি রুটির মাঝে এক টুকরা মাংস দিয়ে আনতে হবে।

সেই জন মন্টাগু ওরফে লর্ড স্যান্ডউইচের মাধ্যমেই টোকিও থেকে নিউইয়র্ক, ক্যানাডা থেকে অসট্রেলিয়া, তথা সারা বিশ্বে স্যান্ডউইচ নামের খাবারটি প্রচলিত।

লর্ড স্যান্ডউইচের সময়ের আরেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন জেমস কুক। জেমস কুক নীল রক্তের ছিলেন না। খামার শ্রমিক বাবার সন্তান কুকের রক্ত ছিল লাল। তার পড়শুনাও ছিল খুব কম, মাত্র বছর পাঁচেক ছিল তার শিক্ষা জীবন। কিন্তু নিজের প্রচেষ্টায় সে এস্ট্রনমি, ত্রিকোনোমিতি, গনিত নিয়ে পড়াশুনা করে নিজেকে স্বশিক্ষিত করেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন নাবিক।

মেরিটাইম হিস্ট্রি তে ক্যাপটেন কুকের চেয়ে বিখ্যাত কোন নাবিক কখনও জন্ম নেয় নি, ভবিষ্যতেও নেবার সম্ভাবনা নেই, কারন আধুনিক যুগে একজন নাবিকের পক্ষে আর তার মতো সাফল্য অর্জনের সুযোগ নেই। একটি কয়লার জাহাজের খালাসী হিসেবে জীবনে শুরু করে রয়াল নেভীর ফ্লীট কমান্ডার পর্যন্ত হয়েছিলেন।

তিনি নিউফাউন্ডল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, তাহিতি থেকে এমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, আলাস্কা হয়ে বেরিং প্রনালী সহ বিশাল অঞ্চল শুধু আবিস্কারই করেননি, ১৭৬৮ থেকে ১৭৭৯ পর্যন্ত ১১ বছরের তিনটি ভয়েজে এই বিস্তৃত এলাকার নিঃখুত নেভিগেশন ম্যাপ তৈরী করেন যা পরবর্তি ১৫০-২০০ বছর পর্যন্তও ব্যবহৃত হয়েছে। তাকে শুধু নাবিক হিসেবে নয়, একজন কার্টোগ্রাফার হিসেবে সম্মানিত করে রয়াল সোসাইটি অফ সাইনটিস্ট এর ফেলো বানানো হয়।

তার স্মরনে এবং সম্মানে পৃথিবীতে এত কিছু হয়েছে যা গুনে শেষ করা যাবেনা। তার নামে হয়েছে কুক ইউনাভার্সিটি, কুক আইল্যান্ড, কুক প্রনালী, কুক ইনলেট, নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট কুক, আলস্কার মাউন্ট কুক, এমনকি পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের একটি ক্রেটার ও জেমস কুকের নামে নামকরন করা হয়েছে। সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশের নেতা নেত্রীদের নামেই সর্বাধিক স্থাপনা হয়েছে, এর পরেই মনে হয় জেমস কুকের নাম আসবে।

সে কোন রাজা বা লর্ড না হয়েও ধাতব মূদ্রায় তার ছবি দেয়া হয়েছে। নাসা’র বিখ্যাত শাটল, এনডেভার ও ডিসকভারী তার জাহাজের নামেই নামকরন করা হয়েছিল। এপোলো ১৫ এর মডিউলের নামও এনডেভার রাখা হয়েছিল জেমস কুকের সম্মানে।

ব্রিটিশ সংসদের হাউজ অফ লর্ড তাকে আখ্যায়িত করে “দা ফার্স্ট নেভিগেটর অফ ইউরোপ”। বিবিসির ১০০ শ্রেষ্ট ব্রিটিশের তালিকায় জেমস কুক আসেন ১২ তম অবস্থানে। জেমস তার জীবদ্দশাতেই এত সম্মানিত হন যে, ব্রিটেনের সাথে এমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন সমস্ত নেভী জাহাজে নির্দেশনা পাঠান, তারা যদি ক্যাপ্টেন কুকের জাহাজের মুখোমুখি হয়, কখনো যাতে তার জাহাজ বা তার নাবিকদের কোন ক্ষতি না করে।

ক্যাপটেন জেমস কুক তার তৃতীয় ভয়েজে রওনা হন অস্ট্রেলিয়া হয়ে তাহিতির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে উত্তরমুখা রওনা হন এমেরিকা এবং আলাস্কার পথে। পথিমধ্যে তিনি আবিস্কার করেন আটটি বিশাল দ্বীপের সমাহার। বহির্বিশ্বের কাছে অজানা এই দ্বীপ গুলির নাম রাখেন “স্যান্ডউইচ আইল্যান্ডস”। দু স্লাইস রুটির মাঝে এক স্লাইস মাংসের নাম যে কারনে স্যান্ডউইচ হয়েছে, দ্বীপগুলোর নামও স্যান্ডউইচ হয়েছে একই কারনে।

সে সময়ে লর্ড অফ এডমিরালিটি ছিলেন সেই জন মন্টাগু, ফোর্থ আর্ল অফ স্যান্ডউইচ। তার সম্মানেই দ্বীপপুঞ্জের নামকরন করা হয় স্যান্ডউইচ দ্বীপপুঞ্জ, যা আজকের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের হাতেই তার মৃত্যু হয়, এবং তৃতীয় ভয়েজ তিনি আর শেষ করতে পারেন নি।

আবিস্কারের প্রায় ২৪৪ বছর পর, এই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জেরই সমুদ্র সৈকতে দাড়িয়ে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর ভোর হতে দেখলাম। রাত বারটায় রুমে আসার পর ক্লান্তিতে শুয়ে পরেছিলাম। কিন্তু দেহ ঘড়ি ১৬ ঘন্টা স্লো হওয়া হজম করতে পারেনি, দু ঘন্টা পরেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এরপর এপাশ ওপাস করতে করতে পাঁচটা। রুম সার্ভিসে অর্ডার করলাম ব্রেকফাস্টের জন্য। নাস্তা হিসেবে পাঠালো স্টারবাকস এর কফি, স্যান্ডউইচ, চিজ চিকেন প্রোটেইন বক্স। ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে গেল, আর কফির সাথে ঘুমও পালিয়ে গেল। নীচে নেমে এলাম একটু হাটাহাটি করবো বলে। কিন্তু হোটেলের বাইরে পা রাখতেই বিস্ময়ে মুখ হা। হোটেলের বাইরেই উনমুক্ত প্যাসিফিক। মধ্যরাতে যখন এসেছি, তখন রাস্তার অপর পারের অংশটি ছিল সম্পুর্ন অন্ধকার, ভেবেছি সামনে হয়ত কোন পাহাড়।

কখনোই ভাবিনি হোটেল সমুদ্রের একদম পারে অবস্থিত। এই ভোর বেলাতেই অনেকে সার্ফিং এ চলে এসেছে। বীচে সামান্য হাটাহাটি করে হোটেলে ফিরে আসলাম ঘুমোব বলে। ছানা পোনাদের সাথে কিছুক্ষণ ভিডিও কল করে আবার ঘুম।

ঘন্টা তিনেক আধো জাগা আধো ঘুম, অতপর লাঞ্চের সময়। ভারত থেকে আরেকজন নাবিক এসেছে, ওকে নিয়ে গেলাম খাবারের সন্ধানে। হোটেলর বিল্ডিং এ রয়েছে স্টারবাকস, একটি জাপানি এবং আরেকটি এমেরিকান রেস্টুরেন্ট।

নাস্তা রুম সার্ভিস, কিন্তু দুপুর ও রাতে রেস্টুরেন্টে বসে খেতে হবে। জাপানিজ খাবার কখনোই পছন্দ না, তাই দুজনে চলে গেলাম এমিরিকান ডাইন এ। রেস্টুরেন্টে ঢুকার মুখেই আটকে দিল। এখানে খেতে হলে ভ্যাকসিন কার্ড এবং ফটো আইডি নাগবে। সুতরাং আবার হোটেলে গিয়ে টিকা কার্ড ও পাসপোর্ট নিয়ে আসলাম। রাকেশ পন্ডিচেরীর ছেলে। আমি বীফ স্টেক অর্ডার করাতে সেও বলল স্টেক খাবে। একটু অবাক হয়ে তাকাতে নিজ থেকেই বলল যে তাদের এলাকায় বীফ পর্ক সবই চলে, কারন পন্ডিচেরী ছিল ফ্রেঞ্চ কলোনী, এখনও সেখানে প্রচুর ফ্রেঞ্চরা থাকে।

খেয়ে দেয়ে রুমে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা। ভাতঘুম যখন ভাঙ্লো, তখন প্রায় সন্ধ্যা। রাকেশকে সাথে নিয়ে বীচে হাটাহাটি, অতপর ডিনার, ইন্টারনেট, চ্যাট, ফোন। এভাবেই আধো ঘুম আধো জাগরনে শেষ হল হাওয়াই এর প্রথম দিন।

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

শুভরাত্রি। ১২ নভ, ২০২১

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে