সাগরের ডাক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
55

আমার ক্ষেত্রে জাহাজে যাবার ব্যপারটি সবসময় তাড়াহুড়োর মধ্যে ঘটে। এক মাস আগে রেডিনেস জানাতে হয়, কিন্তু রেডিনেস দেবার পর পুরো মাস কখনও কাটানো হয় নি। কিন্তু এবার ঘটল সমপুর্ন উল্টো, রেডি হয়ে বসে আছি, যাওয়া হচ্ছে না।

মার্চে এমেরিকান ভিসার মেয়াদ শেষ। ভিসার জন্য আবেদন করে জানিয়ে দিলাম যে ভিসা পেলেই চাকরি তে যোগ দিব। কিন্তু পাসপোর্ট জমা দেবার পরদিন থেকে দেশব্যাপী লকডাউন, এমব্যাসির কাজকর্ম বন্ধ।

এদিকে অফিস থেকে ফোন, আমাকে আগের জাহাজেই যোগ দিতে হবে, এবং সে জাহাজের ক্যাপ্টেনের ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে, আমার জন্য আটকে গেছে। অবশেষে বেচারা এক মাস অতিরিক্ত জাহাজে কাটিয়ে বাড়ি গেল, কিন্তু আমার ভিসা হলো না। ভিসা কার্যক্রম শুরু হবার পর যখন ভিসা পেলাম, শুরু হলো নুতন সমস্যা। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, সুতরাং ভ্যাকসিন নেয়া হয়নি। এটা নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা ছিলনা, কারন সবাইকে এমেরিকা এনে জাহাজে তোলার আগে মডার্নার ডোজ দেয়া হচ্ছিল।

কিন্তু এখন এয়ারলাইনস গুলোও নুতন নুতন নিয়ম নীতি শুরু করেছে, ভ্যাকসিনটা বেশ জরুরী। এদিকে পাসপোর্ট দিয়ে ভ্যকসিনের কথা বলা হলেও সুরক্ষা এপে তা কাজ করছে না। স্বাস্থ্য বিভাগে খবর নিয়ে জানলাম পাসপোর্ট ডাটাবেইজ আর সুরক্ষা এপের সম্পৃক্ততায় সমস্যা হচ্ছে, তবে চেস্টা চলছে।

অফিস থেকে আতিক ভাই (Atikur Rahman Onu ) ফোন দিয়ে বলল, স্যার আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। কিছু লোকের হাতে যাদু থাকে, আতিক তেমন একজন। আসলেই তার হাতে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেল আর সেই সুবাদে ১৯ সেপ্টেমবর প্রথম আর ১৮ অক্টোবর দ্বিতীয় ডোজ বাপের দেশের টিকা নিয়ে ফেললাম, আমার না, করোনার বাবা চীন দেশের টিকা।

টিকার ঝামেলা মেটানোর মাঝে আরেক ঝামেলাও পার করতে হয়েছে। আমাদের একটি রেডিও অপারেটর সার্টিফিকেট থাকে, যাকে আমরা বলি GMDSS, যার মেয়াদ ছিল ৩১ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত । জয়েন করার কথা ছিল জুন/জুলাইতে, সুতরাং সমস্যা ছিলনা, মেয়াদ শেষ হবার আগে আমার চার মাসের কনট্রাক্ট শেষ হয়ে যেত। এখন যোগদানে বিলম্ব হওয়াতে ফেসে গেলাম, নবায়ন করতে হবে। নবায়ন করতে গিয়ে আরেক সমস্যা, আমার আগের কয়েকটি জাহাজের চাকুরির রেকর্ড অনলাইনে আপডেট করা হয় নি, এবং সেটা না করা হলে সনদ নবায়ন হবে না। ঢাকার সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরে গিয়ে নবায়ন করা হল, কিন্তু এসব তথ্য অনলাইন করা হবে চিটাগাং থেকে। ঢাকা অফিস থেকে মাসে দু’একবার নাকি হার্ড কপি পাঠানো হয়, সেটা চিটাগাং পৌছলে তারা অনলাইনে উঠায়, আর এটাকে ইংরেজিতে ডিজিটাইজেশন বলে। যেমন ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটারে চিঠি টাইপ করে তা ইলেক্ট্রনিক প্রিন্টার দিয়ে কাগজে প্রিন্ট করে পায়ে হেটে কাউকে পৌছে দিলে তাকে “ইমেইল” বলা হয়। ডিজি শিপিং এর ক্যাপ্টেন আহসানের সাথে পরিচয়ের সুবাদে বিশেষ মেইলে নথিপত্র চিটাগাং পাঠিয়ে মোটামুটি ৪-৫ দিনের মধ্যে অনলাইনে আপডেট করা সম্ভব হলো, আর সে সুবাদে সনদও নবায়ন হয়ে গেল।

আগে থেকে আমার জয়েনিং নির্ধারন করাছিল হিউস্টনে, নভেম্বরের ৩/৪ তারিখে। কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়ে তার ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবার পরপরই মেসেজ চলে আসল যে আমার জয়েনিং ৪ তারিখ, কিন্তু হাওয়াই এবং আমার আগের জাহাজে।

মেসেজটা পড়ে মোটামুটি নিশ্চিত যে কোন ভুল হয়েছে। চিটাগাং অফিসের রেজা ভাই অনেক জাহাজেরই দেখভাল করেন, ভুলে হয়ত আমাকে পাঠিয়েছেন অন্যের মেসেজ, কিংবা পোর্টের নাম ভুল করেছেন। আমি সাধারনত বড় ট্যাংকারে চাকরি করি, আমাদের কোম্পানির এসব জাহাজ হাওয়াই যায় কখনও শুনিনি। সুতরাং টাইপো। অনলাইনে জাহাজের লোকেশন দেখলাম কোরিয়াতে। জাহাজ এমেরিকা থেকে লোড করে কোরিয়া যায়, কিন্তু হাওয়াই? অসম্ভব। হাওয়াই এবং কোরিয়া, দুটোই ডিসচার্জ পোর্ট, মানে এসব দেশ তেল আমদানি করে। সুতরাং কোরিয়া থেকে হাওয়াই আসার সম্ভাবনা শুন্য। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য জাহজে অবস্থানরত ফিলিপিনো সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠালাম জাহাজের পরবর্তি বন্দর কি জানতে চেয়ে। অনেকক্ষন পর উত্তর পেলাম যে এখন কোরিয়া ডিসচার্জ করছে। এরপর এখানেই লোড করবে এবং পরবর্তি বন্দর হাওয়াই।

মাশাল্লাহ, কত অজানারে। মনে মনে বাক্স পেটরা গুছাতে শুরু করলাম আর বাস্তবে ঢাকার বকেয়া কাজ শেষ করা শুরু করলাম। দাপ্তরিক ভাবে সব প্রস্তুত, সমস্ত সার্টিফিকেট আপডেটেড, সুতরাং সেসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। অন্যান্য সময়ে যোগ দেবার মাত্র তিন চারদিন আগে খবর পাই, আর এবার প্রায় ১৫ দিন আগেই জানিয়ে দিল, সুতরাং মন বেশ ফুরফুরে। জাহাজ হাওয়াই আসবে ১১ তারিখ, কিন্তু আমাকে হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে সাত দিন, সুতরাং হৃদয় আমার হাওয়া হাওয়াই, হাওয়া হাওয়াই।

এরপর নভেম্বর পচিশে নুতন সংবাদ, ১০ তারিখ হাওয়াই পৌছতে হবে, কোয়ারেনটাইন আইন কিঞ্চিত শিথিল করা হয়েছে, তিন দিন হলেই চলবে। যাক, আরও কিছু সময় হাতে পাওয়া গেল অতএব পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে যেমন পড়াশুনায় ঢিলে দেয়া হয়, আমার প্রস্তুতিতেও একটু ঢিলা দেয়া হলো। অবাক করার মতো ব্যপার হলো ১লা নভেম্বর টিকিটও চলে আসল। এবারের সবকিছুই যেন কেমন অদ্ভুত। জাহাজে যোগ দেয়ার বড়জোর একদিন আগে টিকিট পাই, অনেক সময় কয়েক ঘন্টা আগেও টিকিট পেয়েছি। সেখানে পাক্কা দশদিন আগের টিকিট হজম করাটা একটু কঠিন।

এরকম অনুকুল আবহাওয়া বিরুপ হলো ৫ নভেম্বর, শনিবার। সন্ধ্যায় চিটাগাং থেকে রেজা ভাই এর একটি ফোন শান্ত সমুদ্র কে উত্তাল করে দিল। কিছুদিন আগে অনেক হাঙ্গামা করে যে রেডিও অপারেটর বা GMDSS সনদটি নবায়ন করেছিলাম, তা নিয়ে সমস্যা। জাহাজ চালানোর জন্য আমাদের একটি সার্টিফিকেট বা লাইসেন্সের প্রয়োজন।

কিন্তু এর সাথে থাকে আরও ডজন খানেক ছোট, বড় কিংবা মিনি সার্টিফিকেট। ফায়ার ফাইটিং, মেডিক্যাল কেয়ার, লাইফবোট সহ জীবন রক্ষাকারী সারঞ্জামাদি, ট্যাংকার জাহাজ পরিচালনা, রেডিও অপারেটরের মত অনেক ছোট খাট সার্টিফিকেট রয়েছে, যা প্রতি পাচ বছর পরপর নবায়ন করতে হয়। এর একটিও যদি মেয়াদোত্তীর্ন হয়, তাহলে আমাকে জাহাজ চালনার জন্য অযোগ্য বিবেচনা করা হবে। এর মধ্যে রেডিও অপারেটর লাইসেন্সটি সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর। এ সার্টিফিকেটটি বাংলাদেশ সরকার ইস্যু করলেও আমি যখন যে জাহাজে যাব, সে জাহাজের ফ্লাগ স্টেট বা যেখানে জাহাজটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, তারা আমার সার্টিফেকেটের প্রেক্ষিতে তাদের দেশী একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। যেমন ভাবে বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিদেশ গিয়ে আরেকটি সাময়িক লাইসেন্স পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা যেদিন জাহাজে যোগ দিতে যাই, সেদিনই আমাদের এজেন্ট অফিস থেকে ফ্লাগ স্টেটকে একটি মেইল পাঠিয়ে দেয়া হয় যে অমুক ব্যক্তি তোমাদের ফ্লাগের একটি জাহাজে যোগ দিয়েছে, তোমরা তার অরিজিনাল সনদের সৌজন্যে নিজেদের একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করো।

ওরা এর প্রেক্ষিতে একটি “আবেদনপত্র পাইয়াছি” মর্মে একটি উত্তর পাঠিয়ে দেয়, এবং পরবর্তি তিন মাসের জন্য সেটাই যথেষ্ঠ। এর মধ্যে ওরা একটি সার্টিফিকেট ছাপিয়ে কোম্পানিতে পাঠিয়ে দেয়, আর সেটা পরে জাহাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবার যেহেতু হাতে অনেক সময় ছিল, রেজা ভাই আগেভাগেই এর জন্য আবেদন করে দিয়েছিল এবং শনিবার সন্ধ্যায় উনি উত্তর পেয়েছেন যে আমার সনদটি তাদের জন্য গ্রহনযোগ্য হয়নি।

কারন আমার সার্টিফকেটের যে স্ক্যান কপি তারা পেয়েছে, তার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশের ওয়েব সাইটে উল্লেখিত তারিখের সাথে মিল নেই। সহজ বাংলায় বললে, আমার সার্টিফকেটে এক্সপায়ারি ডেট উল্লেখ করা হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৬, কিন্তু সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পোর্টালে লেখা রয়েছে ৩১ ডিস ২০২৬। সুতরাং সিংগাপুর অথরিটি আমার সার্টিফিকেটটি গ্রহন করছে না, এবং এ সমস্যার নিরসন না হলে আমার হাওয়াই যাওয়া হাওয়ায় উড়ে যাবে।

পরদিন সকালে আবার ডিজি শিপিং এর ক্যাপটেন আহসানকে ফোন করে বললাম সমস্যার কথা। বলল, স্যার কাউকে দিয়ে কি পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব, আমি দেখি কি করা যায়?

ঢাকা শহরে এখন বাসায় কাজের লোক পাওয়া যায় না এক কাপ চা বানানোর জন্য, আর সার্টিফিকেট পাঠাবার লোক কই পাব! আমিই চলে গেলাম সার্টিফকেট সহ। অসম্ভব জ্যাম ঠেলে শিপলুর বাইকের পেছনে বসে ডিজি শিপিং এ পৌছানোর পর ক্যাপটেন আহসানকে আর পেলাম না, ডিজি সাহেবের সাথে সবাই জরুরী মিটিং এ। সমস্যা নেই, মিটিং শেষ হোক, আমি অপেক্ষা করি। আহসানের সাথে কখনোই দেখা হয়নি, টেলিফোনেই পরিচয়। তাই ওর সাথে দেখা করেই যাব, এ উদ্দেশ্যে বসে রইলাম।

কিন্তু ১১ টা থেকে বারটা বাজল, অতপর লাঞ্চের সময়, অতপর দুটো বাজল, তারপরেও মিটিং শেষ হবার নাম নেই। ডিজি শিপিং এ প্রচুর পরীক্ষার্থীরা এসেছে, সবাই সার্ভেয়রদের অপেক্ষায়, কিন্তু মিটিং অবিচল। দুটো বাজে চিন্তা করলাম, যেহেতু তারা মিটিং এ বসেই লাঞ্চ করেছে, আজকে মিটিং শেষ হতে সময় লাগবে। সুতরাং নিজেই গেলাম কম্পিউটার অপারেটরের কাছে, যদি কিছু করা যায়। অন্তত সমস্যাটি সমন্ধে যদি ধারনা নেয়া যায়, তাহলে আহসানকে ব্যাপারটি আরও ভাল বুঝিয়ে বলা যাবে। কম্পিউটার অপারেটর সার্টিফিকেট দেখে বিজ্ঞের মতামত জানালো যে কম্পিউটার ডাটাবেইজ ঠিক আছে, কিন্তু আপনার সার্টিফিকেটে যে তারিখের স্ট্যাম্প আছে সেটা ভুল। যে স্ট্যাম্প করেছিল, সে ভুল করেছে তবে কোন ব্যাপার না, আমি ঠিক করে দিচ্ছি। সে একটি ইরেজার নিয়ে তারিখ ঘষা শুরু করে দিল। এবং তাতে কাজ হবে না বুঝে একটি এন্টি কাটার নিয়ে ঝাপিয়ে পরল স্ট্যাম্প করা বেগুনি রঙের তারিখের উপর।

আমি তাড়াতাড়ি তাকে থামালাম, বললাম ভাই সার্টিফিকেটে কিছু করবেন না, এভাবে সংশোধন করা সম্ভব না।

সে আমার উদ্বেগ উড়িয়ে দিল, আরে এটা কোন ব্যপার না, আগেও করেছি। সুন্দর করে নুতন ডেট স্ট্যাম্প করবো, কেউ বুঝবে না।

বললাম ভাই, এটা সিংগাপুরে পাঠানো হয়েছে, তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন কালকে যদি দেখে পুরনো তারিখ সুন্দর ভাবে বদলে গেছে, তারা কি ভাববে? বলবে না যে পুরো সনদটিই জাল?

এবার তার একটু টনক নড়ল, হ্যা, তা ভাববে, তাহলে কি করবো?

অনলাইনে কারেক্ট করে দিন।
সেটা তো করতে পারি কিন্তু সেটা আমি করার পর একজন সার্ভেয়ার এপ্রুভ করবে, তারপর ডিজি সাহেব এপ্রুভ করবে, এর পর অনলাইনে শো করবে, তার আগে না।
অসুবিধা নেই, করেন, সেটা ছাড়া উপায়ও নেই।

সে সাথে সাথে তারিখ পরিবর্তন করে সাবমিট বাটনে ক্লিক করে বলল কাজ শেষ।
জানতে চাইলাম এখন অন্যদের এপ্রুভ করে অনলাইনে প্রতিফলন ঘটাতে কতক্ষন লাগবে?
চার দিন?
চার দিন? কি বলেন?
এজন্যই তো আপনাকে বললাম যে আমি ঠিক করে দেই, সাথে সাথে হয়ে যেত। আমার কথায় তো কান দিলেন না।
কথায় কান দেব কি, আমার কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল।

সোমবার সারাদিনের কাজ তেমন নেই। কভিড টেস্ট করতে হবে উড়াল দেবার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে। আতিক ভাই বলল সন্ধ্যায় করে ফেলতে। আমি গেলাম আরও আগে, চারটায় কভিড টেষ্ট করে বনানী অফিসে গিয়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করলাম। কাগজপত্র মানে ঢাকা ও হনলুলু ইমিগ্রেশনের কাছে চিঠি, হনলুলু এজেন্টের গ্যারান্টি, আমার চাকরির চুক্তিপত্র, মেডিকেল রিপোর্ট, টিকেট, ইত্যাদি।

এসবের এক কপি আমি স্বাক্ষর দিয়ে রেখে যাব কোম্পানির জন্য। এরপর গেলাম বনানীতে আমার বাসায়, সেখান থেকে কিছু কাপর চোপর নিয়ে আবার মোহাম্মদপুর ফেরত।

ক্যাপটেন আহসান খুবই কর্তব্যপরায়ন, নিজে থেকেই জানিয়ে দেয় কি হচ্ছে বা হতে পারে। কিন্তু সোমবার সারাদিনেও কোন খবর পেলাম না। সন্ধ্যায় জানালো যে ও আজকে ছুটি নিয়েছিল, কিনতু ওর একজন সহকর্মিকে ব্যপারটি দেখতে বলেছে। যদি না হয়ে থাকে, আগামীকাল নিজে গিয়ে নিশ্চিত করবে। কিন্তু একটু পরেই রেজা ভাই এর মেসেজ আসল, অনলাইনে সঠিক তথ্য দেখাচ্ছে, সুতরাং সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। অতএব শান্তি, ওম শান্তি। কিন্তু রাতে হঠাৎ মনে পরল যে আমার ক্রেডিট কার্ডে গত বছরের প্রথম দিকে ডলার এনডর্স করার পর আর করা হয় নি।

বাইরে ক্রেডিট কার্ড এখন খুব জরুরী, বিশেষ করে উবার এর জন্য তো অবশ্যই। আমার ব্যাংক একাউন্ট HSBC তে, ওদের ক্রেডিট কার্ড নেই, শুধু ডেবিট কার্ড দিয়েছে। বউর ক্রেডিট কার্ডের একটি সাপ্লিমেন্টারি ব্যবহার করি। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যংকের নিয়ম হলো আমার কার্ডে ডলার এনডর্স করতে হলে প্রাইমারী কার্ড মালিকের স্বাক্ষর লাগবে, মানে সাথে বউকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আজকে ওর সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত মিটিং, যেখানে মিটিং এর হোস্ট এবং বক্তা সে নিজেই। বিশ্বের বিভিন্ন যায়গা থেকে সবাই লগ ইন করবে, প্রশ্ন করবে, বুঝতে চাইবে, বাংলাদেশ থেকে সে বিশ্লেষণ করবে, উত্তর দেবে, সাথে দেবে প্রশিক্ষন। সুতরাং তার পক্ষে ব্যংকে যাওয়া সম্ভব না। বললাম যেতে হবে না, তোমাকে নিয়ে রিক্সায় ব্যাংকে যাবার চেয়ে দ্রুত শিপলুকে নিয়ে বাইকে গিয়ে ফর্ম নিয়ে আসব, সিগনেচার নিয়ে আবার গিয়ে কাজ সেরে আসব। এদিকে রাত দশটাতেই মেসেজ চলে আসল, কভিড নেগেটিভ, সুতরাং যাত্রা নিশ্চিত।

মঙ্গলবার সকালে শিপলুকে নিয়ে রওনা হলাম ব্যংকের উদ্দেশ্যে। আবাহনি মাঠের কাছে গিয়ে প্রথম ধাক্কা, এসসিবি ব্যংকের ব্রাঞ্চটি বন্ধ করে দিয়েছে, নিকটতম ব্রাঞ্চ ল্যাবএইড। কিন্তু মিরপুর রোডের জ্যাম দেখে বুঝে গেলাম এখান থেকে ফর্ম নিয়ে বাসায় গিয়ে স্বাক্ষর নিয়ে ফিরে আসতে গেলে আর অন্য কাজ হবে না। তবুও একটা ফর্ম নিলাম কিন্তু বাসায় না গিয়ে ছুটলাম ইসকাটন। আম্মাকে বলেছি আমি দুপুরে আসব, কিনতু এখন উপায় নেই, এ কাজটা আগে সারতে হবে। আগেভাগে ইস্কাটন চলে যাওয়াতে আম্মা এবং ছোট বোন পারভীন, দুজনেই মন খারাপ করল।

ভেবেছিল আমার জন্য দুপুরের খাবার রান্না করবে। এটাও জানে ব্যস্ততার মাঝে আমাকে এখন আটকে রাখা যাবে না। ফ্রিজে যা ছিল তা দ্রুত গরম করে খেয়ে কিছুটা স্বস্তি দিলাম। খাবার শেষ হতেই ফোন আসল ঢাকা অফিসের ফাহমিদার কাছ থেকে, আমার ফ্লাইট একদিন পিছিয়ে দেবার জন্য বলা হয়েছে। অন্য যে কোন সময়ে এমন একটি খবর প্রশান্তির কারন হতো, কিন্তু আজকে মোটেও তা নয়, কারন কভিড টেস্ট আবার করাতে হবে। অতএব খবর পেয়ে আর দেরি করলাম না।

সন্ধ্যায় আমার বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে গুরুত্বপূর্ন মিটিং রয়েছে, এর সাথে কভিড টেস্টের সময়ের সমন্বয় করতে হবে। বাসায় ফিরে সিদ্ধান্ত নিলাম টেস্ট কালকে করাব। আতিক ভাই বললেন সকাল সকাল চলে গেলে অসুবিধা নেই, বিকেলের মধ্যেই ফলাফল চলে আসবে। সন্ধ্যায় মিটিং শেষ করে রাতের জন্য বিশ্রাম, আজকেই স্বদেশে শেষ রাত্রি যাপন এবং শুভ নিদ্রা।

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

সাগরের ডাক- ৯ নভেম্বর ২০২১

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে