শুক্রবার মধ্যরাতে সব নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ

0
28

মানুষ আর মানুষ। যেন জনস্রোত। ঠেলাঠেলি-গাদাগাদি। স্বাস্থ্যবিধি হাওয়া। কাঁধে ব্যাগ, হাতে শিশুসন্তান। কারোর কোলে দুধের শিশু। ঈদে গ্রামে ফেরার ঢল।

গতকাল শনিবার দেশের ফেরিঘাটগুলোতে ছিল এমনই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। করোনা সংক্রমণ রোধ এবং ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ঢল ঠেকাতে গত শুক্রবার মধ্যরাতে সব নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ।

গতকাল ঘাটে ঘাটে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপে সেই ঘোষণা থেকে কর্তৃপক্ষ সরে আসতে বাধ্য হয়। চলাচল শুরু হলে ফেরিগুলোতে কোনো গাড়িরই ঠাঁই হয়নি। ফেরিতে উঠতে যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গিজগিজ করে মানুষ পারি দিয়েছে নদী।

করোনা আতঙ্ক উপেক্ষা করে অটোরিকশা, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ট্রাকসহ ছোট ছোট যানবাহনে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গাড়ি পাল্টিয়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ রকম প্রেক্ষাপটে জনস্রোত ঠেকাতে গতকাল বিকেল থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তায় কাজ করবে। গতকাল সন্ধ্যায় বিজিবি সদর দপ্তর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

গতকাল গাবতলী ও আমিনবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সাভারের বাসে চেপে পাটুরিয়া ঘাটমুখী যাত্রীর চাপ আরো বেড়েছে। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির নারুয়া গ্রামের বাসিন্দা নেয়ামত আলী বলেন, ‘পদ্মা পার হওয়া সমস্যা হবে না, খবর পেয়েছি যাত্রীদের চাপে ফেরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।’

এদিকে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের যাত্রীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চেপে বাদামতলী ও সোয়ারীঘাট থেকে ঢাকা ছাড়ছে। যাত্রী নিয়ে নৌকা যাবে মাদারীপুর লঞ্চঘাট। মাদারীপুরের যাত্রী নামিয়ে সেই নৌকা যাবে টেকেরহাট। টেকেরহাটে নেমে গোপালগঞ্জের যাত্রীরা নিজ জেলার বাস ধরে পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। গতকাল সকালে এমন চারটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাওয়া যায় রাজধানীর সোয়ারীঘাটে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি শরাফত আলী বলেন, ‘আমরা সাধারণত সোয়ারীঘাট থেকে মালামাল নিয়ে মাদারীপুর ও টেকেরহাট যাই। এখন মালামাল টানার চেয়ে যাত্রী বহনে লাভ বেশি, তাই মানুষ টানছি। মাদারীপুর পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ৪০০ টাকা, টেকেরহাট পর্যন্ত ৪৫০ টাকা।’ নৌকায় কতজন যাত্রী বহন সম্ভব? জানতে চাইলে শরাফত আলী বলেন, ৫০ জন নেওয়া যাবে। ওই নৌকার যাত্রী মাদারীপুরের কালকিনির ভুরঘাটা এলাকার বাসিন্দা নেয়ামতউল্লাহ গাজীপুরের একটি কারখানায় কাজ করেন। মালিক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন, তাই বাড়ি যাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে নৌপথেই বাড়ি যাচ্ছেন। চারজনের এক হাজার ৬০০ টাকা ভাড়া দিয়েছেন।

দুপুরে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন শ্রমিক যাত্রীদের মাইক্রোবাস ভাড়া করে দিচ্ছেন। বিভিন্ন জেলার মাইক্রোবাস—চাঁদপুরের ভাড়া ৭০০ টাকা, লক্ষ্মীপুরের এক হাজার টাকা, কুমিল্লা এক হাজার ২০০ টাকা ও চট্টগ্রামে দুই হাজার টাকা। যাত্রীরা যেতে রাজি হলে অগ্রিম ভাড়ার টাকা দিতে হচ্ছে ওই মধ্যস্থতাকারী শ্রমিকদের কাছে।

মিরপুরের শাহ আলী মাজারের পাশ থেকে রাতের আঁধারে বাস ছেড়ে যায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন দাবি করলে ওই এলাকার লোকজন। এ ছাড়া গত শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে সেন্ট মান্টিন পরিবহন ছেড়ে যাওয়ার কথা জানালেন ওই বাসের একজন যাত্রী।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ফেরি না পেয়ে গতকাল সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘাটে আটকা পড়ে। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি কাউকেই। সব নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের পদ্মা পারাপারের একমাত্র ভরসা ছিল ফেরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যধিক চাপে ফেরিতে পার হচ্ছিল শুধু যাত্রী। এতে যানবাহন পারাপারে যেমন অসুবিধা হচ্ছিল, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছিল যাত্রীরা। এ অবস্থায় গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে ফেরি সার্ভিস সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

গতকাল শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ঘাটে ফেরি নেই। থাকলেও তা নোঙর করা রয়েছে। হাজার হাজার ঘরমুখো যাত্রী ফেরিতে পার হওয়ার জন্য পন্টুনে অপেক্ষা করছে। মানুষের ভিড়ে গাড়ি ফেরিতে ওঠার জো নেই। যাত্রী ফিরিয়ে দিতে বসানো হয়েছে পুলিশচৌকি। শিমুলিয়া ঘাটের প্রবেশমুখে আড়াআড়ি করে ট্রাক রেখে রাস্তা আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনস্রোত ঠেকাতে বাঁশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যারিকেডও। অনেক যাত্রীকে ঘাটে প্রবেশ করতে না দিয়ে ঢাকার দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যায়ে মানুষের ঢল ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে দুপুরের দিকে কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। শুরু হয় ফেরি চলাচল। একে একে ছেড়ে যায় পাঁচটি ফেরি। এতে এনায়েতপুরী নামের একটি ফেরিতেই পাঁচ হাজার যাত্রী পার করা হয়। এ ফেরিতে কোনো গাড়িই ছিল না। বিকেলের দিকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে পরিস্থিতি।

শিমুলিয়া ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) হিলাল উদ্দিন বলেন, শিমুলিয়া ঘাটের এক কিলোমিটার দূর থেকে যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকালের দিকে কোনো যাত্রীকে শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

বিআইডাব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল ভোর থেকে সরকারের নির্দেশে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে দুপুরের দিকে সরকারের নির্দেশে আবারও ফেরি চলাচল শুরু করা হয়।

এদিকে শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে রোগী নিয়ে বাংলাবাজার ঘাটে এসে অ্যাম্বুল্যান্সগুলোকেও দেখা গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে। জরুরি সার্ভিস পারাপারে বিলম্ব হওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি রোগীরাও ভোগান্তিতে পড়ে। শিমুলিয়া থেকে ছেড়ে আসা ও বাংলাবাজার থেকে ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ফেরিতেই  যাত্রী ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকায় শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট থেকে ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ অন্য যানবাহনগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায় করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে দেয়।

খুলনার যাত্রী আয়শা বেগম বলেন, গাজীপুর থেকে কয়েকটি বাস পাল্টিয়ে শিমুলিয়া ঘাটে সকাল ৭টায় এসে পৌঁছাই। ঘাটে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বসে থাকার পর অনেক কষ্ট করে একটি ফেরিতে উঠে বাংলাবাজার ঘাটে এসে দেখি কোনো বাস নেই। এখন কিভাবে বাড়ি পৌঁছাব বুঝতে পারছি না। আর ভাড়া তো সব জায়গায় তিন গুণ দিতে হয়েছে। বরিশাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে ঢাকাগামী এক রোগীর স্বজন হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘ফেরি বন্ধ থাকলেও তো অ্যাম্বুল্যান্সসহ জরুরি গাড়ি পারাপার করার কথা, কিন্তু আমার অসুস্থ বাবাকে নিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা বাংলাবাজার ঘাটে বসে আছি, এখনো ফেরি ছাড়েনি। কিভাবে ঢাকার হাসপাতালে পৌঁছাব বুঝতে পারছি না।’

বিআইডাব্লিউটিসির কাঁঠালবাড়ী ঘাট ম্যানেজার মো. সালাউদ্দিন বলেন, যাত্রীদের চাপ অনেক বেশি থাকায় ফেরিতে যানবাহন পারাপারে বিঘ্ন ঘটছে।

মানিকগঞ্জ থেকে আমাদের আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে। দুপুরে ফেরি চলাচল শুরু হলে ভিড় কিছুটা কমতে থাকে। পাটুরিয়া ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘাটের শত শত যাত্রী ফেরি পারের অপেক্ষায় পন্টুনে গাদাগাদি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে। দূরপাল্লার যানবাহনসহ আন্ত জেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে যে যার মতো গাড়িতে করে ঘাটে এসে পারের অপেক্ষায় রয়েছে। যাত্রীরা অভিযোগ করে, ‘গভীর রাতে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া  বিআইডাব্লিউটিসি  কর্তৃপক্ষ ফেরি বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের এ দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি জানা থাকলে অবশ্যই আমরা বের হতাম না।’ ঘাট  কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘লকডাউনের শুরু থেকেই আমরা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি চলাচল সীমিত করেছি। শুধু জরুরি যানবাহন ছাড়া কিছুই পারাপার করা হচ্ছে না।’

ঢাকা থেকে ঝিনাইদহগামী আব্দুল আজিজ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমি পরিবার নিয়ে সকালে ঘাটে এসে পারের অপেক্ষায় রয়েছি। ফেরি বন্ধের বিষয়টি জানতাম না। এখন ঘাটে এসে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছি। এভাবে হাজার হাজার লোক ঘাটে পারের অপেক্ষায় থাকলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে।’

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সরকারি বিধি-নিষেধ থাকলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ঈদ যাত্রা। গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গমুখী কয়েক হাজার যাত্রী নিয়ে শতাধিক যাত্রীবাহী বাস যমুনা সেতুর টোল প্লাজায় পোঁছায়। এক জেলার গাড়ি অন্য জেলায় যাতায়াতের সরকারি বিধি-নিষেধের কথা বলা হলেও সেতু কর্তৃপক্ষ যাত্রীবোঝাই বাসগুলোকে সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ সময় হাজার হাজার যাত্রী, চালক ও শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে সেতু কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে এসব দূরপাল্লার বাস সেতু দিয়ে পারাপারের অনুমতি দেয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু গোলচত্বর থেকে হাটিকুমরুল গোলচত্বর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে