সুমন ব্যাপারীর “ময়লা তদন্ত”

0
383
ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

মৃত্যুই একটি মর্মান্তিক ঘটনা, অতপর ময়নাতদন্ত হলো মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত। তবুও মৃত্যুর আসল কারন নির্ধারনের জন্য তা জরুরী হয়ে পরে।

কিন্তু জীবিত মানুষের কি ময়না তদন্ত করা হয়? তাতো আসলে সম্ভব না কিন্তু অনেক সময় “ময়লা তদন্ত” করা জরুরী হয়ে পরে কালিমা মুছে ফেলার জন্য।

মর্নিং বার্ড নামক একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায় ময়ুরী জাহাজের ধাক্কায়। ১৩ ঘন্টা পর ডুবুরীরা যখন উঠাবার চেষ্টায় লিপ্ত, তখন নীচ থেকে সাতরে উপরে আসেন সুমন ব্যপারী। শুরু হয়ে গেল তাকে নিয়ে “ময়লা তদন্ত”
উন্নত বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটলে তাকে ন্যাশনাল হিরো বানানো হতো। যেমন ভারতীয় পাইলট আভিনন্দন গিয়েছিল বোমা মারতে, উল্টো তার বিমানকে পাখীর মত গুলি করে নামানো হয়েছে। বোমা হয়ত মারতে পারেনি, তার পরেও তো বেঁচে এসেছে? কয়েকশ কোটি টাকা দামের বিমানটি না হয় খুইয়ে এসেছে, কিন্তু মোচ টা তো পুরা শাহেনশাহ’র মতো, সুতরাং হিরো বানিয়ে দাও। সুমন ব্যপারীর দুর্ভাগ্য সে বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করেছে, অন্য দেশ হলে বুড়িগঙ্গার তীরে স্থাপিত হত তার বিশাল মুর্তি।

কিন্তু তার পরিবর্তে সবাই নেমে গেছে তার তেল চকচকে গায়ে ময়লা লাগানোর জন্য। আবার আরেক দল ব্যস্ত বৈজ্ঞানিক গবেষনায়। ওমুকে ৭২ ঘন্টা সাগরের তলদেশে আটকে থেকেও বেঁচে গিয়েছিল, সুতরাং সুমন ব্যাপারীর ১২ ঘন্টা তো ডাল ভাত। কত পানির নীচে কত প্রেসার থাকবে, অক্সিজেন কনসেনট্রেশন কত বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে কতক্ষন শ্বাস নেয়া যাবে, এরকম অনেক কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক তথ্য যোগ করেছেন। তবে সুমন ব্যপারীর জন্য যারা এসব জটিল গবেষনা করেছেন, তাদের আন্তরিকতার জন্য সাধুবাদ।

অন্য সবার মত আমি বিজ্ঞানী নই, তবে আমি একজন নাবিক, এবং সামান্য ডাইভিং এর অভিজ্ঞতা আছে। সেই সুবাদে সুমন ব্যপারীর ফিরে আসা নিয়ে কিঞ্চিৎ অনুসন্ধান । যদিও টিভি, মিডিয়া, ফেসবুক ইউটিউবের কল্যানে সবাই এয়ার পকেট সমন্ধে জেনে গিয়েছে, তার পরও আমি এয়ার পকেট দিয়েই শুরু করতে চাই।

মনে মনে বিরিয়ানী রান্নার একটি ডেকচি নিন, পানিতে ভাসিয়ে দিন, এবার তার এক পাসে চেপে ধরে কাত করে ডুবানোর চেস্টা করুন। ডেকচি একদিকে কাত হবে, কিছু পানি ঢুকবে তার পর উপুর হয়ে হয়ত অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে থাকবে, কারন ভেতরে এয়ার পকেট তৈরী হয়েছে।

এবার সিংগারা ভাজার একটি বড় কড়াই নিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিন। একই ভাবে তাকে কাত করার চেষ্টা করুন। সে কাত হবে, তারপর খারাখারি তলিয়ে যাবে, ডেকচির মত ভাসবে না। কেন ডেকচি ভেসে থাকবে কিন্তু কড়াই ভাসবে না, এটা বুঝার জন্য বিজ্ঞানী হতে হয় না। দুটি পাত্রের আকৃতি ভিন্ন। ডেকচির নীচের অংশ কড়াইয়ের মত, তারে উপরের অংশ আবার ঢালু হয়ে ভেতরের দিকে চলে এসেছে। এই ঢালু অংশ বাতাস বেড়িয়ে যেতে বাঁধা দেবে, ফলে এয়ার পকেট তৈরী হবে। কিন্তু কড়াইতে তেমন কিছু নেই, ফলে কাত হয়ে খাড়া ডুবে যাবে।

মর্নিং বার্ডের নীচের অংশ কড়াইয়ের মত মাঝ থেকে ঢালু হয়ে উপরে উঠে গেছে, কিন্তু ডেকচির কাঁধের মত আবার ঢালু হয়ে ভেতর দিকে আসেনি, তবে খাড়া উপর দিকে উঠে গেছে। সে হিসেবে তার এয়ার পকেট তৈরীর সক্ষমতা কড়াই থেকে ভালো। কিন্তু খারা অংশটি নিরেট দেয়াল নয়, বরঞ্চ খোলা জানালা। তাই নীচ তলার খারা দেয়াল থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না।


এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন লঞ্চটি ডুবে কিভাবে তলদেশে পরেছিল? কাত হয়ে? নাকি একদম উল্টা হয়ে। মর্নিং বার্ড একটি দেড় তলা লঞ্চ। মানে দ্বিতীয় তলা হলো অর্ধেক। এমন আকৃতির একটি লঞ্চ কাত হয়ে পরে থাকার সম্ভাবনাই বেশী। কোন কিছু যখন ডুবতে থাকে, তার ভাড়ী অংশ নীচের দিকে থাকবে। মর্নিং বার্ড লঞ্চটির ভারী অংশটিও তার তলার অংশ, এবং সেভাবেই তার নীচে নেমে যাবার কথা। কিন্তু যেহেতু লঞ্চের তলদেশ সমতল নয়, তাই নীচে সোজা হয়ে বসে না থেকে সে হয়ত কাত হয়ে শুয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে কোন এয়ার পকেট তৈরী হবার সম্ভাবনা শুন্য, কারন সব বাতাস উন্মুক্ত জানালা দিয়ে বেড়িয়ে যাবে।

যদি একদম উল্টা হয়ে লঞ্চের ছাদের উপর ভর করে মাটিতে গেথে থাকে, তাতে খুব সামান্য একটি এয়ার পকেট তৈরী হলেও হতে পারে। এবার প্রশ্ন উঠবে, নাইজেরায় ডুবে যাওয়া টাগটিতে কিভাবে এয়ার পকেট রয়ে গেল, এবং সেখানে একজন লোক ৭০ ঘন্টা বেঁচে রইল? নাইজেরীয় টাগটি ডুবেছিল আটলান্টিক মাহাসাগর উপকুলে, এবং সে টি ছিল একটি সমুদ্রে চলাচলে উপযুক্ত জাহাজ।

সমুদ্রগামী সব জাহাজের সমস্ত বাইরের দরজা ওয়াটার-টাইট বা পানি-নিরোধক হতে হয়, এবং এটা বাধ্যতামুলক। আজকাল বাজারে আরএফএল এর যেসব এয়ারটাইট প্লাস্টিকের কন্টেইনার পাওয়া যায়, এদের ঢাকনার কিনার ধরে নরম রাবারের একটি মোটা সুতার মত থাকে, যা ঢাকনা বন্ধ অবস্থায় চেপে থেকে সম্পুর্ন এয়ারটাইট করে রাখে। জাহাজের স্টীলের দরজার কিনারেও এরকম রাবারের প্যাকিং থাকে, যা দরজা বন্ধ করা অবস্থায় সম্পুর্ন ওয়াটারটাইট থাকে, আর এজন্যই সমুদ্রে চলা কালীন অনেক বড় বড় ঢেউ জাহাজের উপর দিয়ে চলে গেলেও জাহাজ আবার ভেসে উঠে, কারন এক ফোটাও পানি ঢুকতে পারে না। এ ধরনের সমুদ্রগামী টাগের শুধু বাইরের দরজাই নয়, ভেতরেও অনেক ওয়াটার টাইট দরজা থাকে, যা ইঞ্জিন রুম, রান্নাঘর, থাকার জায়গা কে আলাদা আলাদা জোনে বিভক্ত করে ফেলে। ফলে একটি এলাকায় পানি ঢুকলেও অন্যান্য জোন ওয়াটারটাইট থেকে যাবে।

তাই টাগ জ্যাসন-৪ ডুবে গেলেও ওয়াটার টাইট দরজার জন্য ভেতরে অনেক এয়ার পকেট টিকে ছিল এবং হ্যারিসনের পক্ষে ৭২ ঘন্টা বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল। পক্ষান্তরে মর্নিং বার্ড হল চারিদিকে সম্পুর্ণ খোলা, দরজা জানালা বিহীন একটি কংকালের মতো, যেখানে এয়ার পকেট থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এবার আসা যাক সুমন ব্যপারীর বক্তব্যে। উনি পরদিন সকালেই মিডিয়ার কাছে খুব সুন্দর ভাবে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ননা করেছেন। উনি প্রথম দিকে কিছু পানি খেয়েও থাকতে পারেন, কিন্তু মুত্র বিয়োগের মাধ্যমে নাকি পেট পরিস্কার করে ফেলেছেন। উনি কোন রডের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন, ইঞ্জিন রুমের দিকে।
ওনার পায়ের দিকে সামান্য পানি ছিল, কিন্তু উপরে ছিল বাতাস। সে পানিতে উনি অজুও করেছেন, পরে দোয়া দরুদ পরেছেন। সর্বশেষ কথা হলো ১২ ঘন্টা তার কাছে ১০ মিনিটের মত মনে হয়েছে। মাশাললাহ।

এবার একটু মর্নিং বার্ড লঞ্চের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখি। উপরের তলায় যে কজন স্বাভাবিক উচ্চতার লোক দাড়িয়ে, তাদের মাথা প্রায় ছাদ ছুঁই ছুঁই। মানে একটি ফ্লোরের উচ্চতা ছয় ফুটের মত হবে। নীচের তলারও একই অবস্থা। যদি লঞ্চটি একদম উল্টে দাড়িয়ে থাকে, নীচ তলার একজন লোকের কাছে, নীচ তলার ছাদ হয়ে যাবে মেঝে আর নীচের পাটাতন হবে তার ছাদ, যা প্রায় তার মাথা ছুঁই ছুঁই করবে।

সেক্ষেত্রে তার কোন রডের উপর দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসেনা, মেঝেতেই আরামে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। সুমন ব্যাপারী বলেছেন তার পায়ের দিকে সামান্য পানি ছিল। নীচতলার দুই পাশে বিশাল বড় খোলা জানালা। সুতরাং উল্টানো অবস্থায় নীচের ৩-৪ ফিট পানিতে ভরা থাকবে, যা সুমন ব্যাপারীর কোমড় পর্যন্ত বা তার উপর। লঞ্চে এমন কোন জায়গা থাকা সম্ভব না, যেখানে শুধু পায়ের দিকে সামান্য পানি থাকবে। যখন আমরা অপেক্ষায় থাকি, বিপদে থাকি, আমাদের সময় কাটতে চায় না। কিন্তু সুমন ব্যাপারী ১২ ঘন্টা কেটেছে ১০ মিনিটের মত।

এরকম আবদ্ধ অবস্থায় ১২ ঘন্টা কাটালে যে কোন মানুষ মানষিক ভাবে আতংকগ্রস্থ হয়ে যাবে, মেন্টাল শক। শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়ে গেলেও মানসিক ভাবে ধাতস্থ হতে প্রচুর সময় নেবে। সন্দেহ নেই সুমন ব্যপারী অস্বাভাবিক দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। তাই উদ্ধার হবার ১২ ঘন্টা পরেই যে ভাবে মিডিয়ার সাথে কথা বলছিলেন, মনে হবে উনি প্রতি সপ্তাহে দু চারবার এমন ডুবো জাহাজে দশ বিশ ঘন্টা আটকে থাকেন।

জাহাজের আকৃতি, প্রকৃতি সহ সব বিবেচনায় সুমন ব্যাপারীর এয়ার পকেটে ১২ ঘন্টা টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? আমি বলব ১%। সুমন ব্যাপারী কি সত্যি আটকে ছিল? উত্তর আমি জানিনা। কিন্তু উত্তর জানা মোটেও কঠিন কিছু না। মিনিট দশেকের মধ্যে জানা সম্ভব। কিভাবে?

প্রথম পদ্ধতি: ডুবুরী দের জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে লঞ্চটি কি কাত হয়ে শুয়ে ছিল কিনা। যদি কাত হয়ে পরে থাকে, তাহলে এয়ার পকেটের সম্ভাবনা শুন্য ।

দ্বিতীয় পদ্ধতি: সুমন ব্যাপারীর নিশ্চয় একটি মোবাইল ফোন ছিল। সে নম্বরটি ফোন কোম্পানী কে দিলে তারা ১ মিনিটে বের করে দেবে ফোনেটির লোকেশন কখন কোথায় ছিল এবং কখন বন্ধ হয়েছিল।
ভালো থাকুন সুমন ব্যপারী, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখুন, মাস্ক ব্যবহার করুন।

লেখক : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে