শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু : সৈয়দ আবুল মকসুদ

0
293

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হলেও পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয়নি। ওই যুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের দিকে, চীন পাকিস্তানের পক্ষে এবং আমেরিকা দুদিকেই ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছিল অরক্ষিত। তাই তার প্রতিরক্ষা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দেয়।

ষাটের দশকের বিশ্বপরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বাম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অভিভাবকত্ব করছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা ভাসানী। দুই দলের দুই ধারার দুই নেতাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি তাঁর শত্রুভাবাপন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে দ্বিধা করেননি। কোনো সংলাপ বয়কট বা বর্জনের রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। পাকিস্তান সরকার তাঁকে অব্যাহতভাবে নাজেহাল করেছে, কিন্তু তারপরও তাঁরা আলোচনার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তাতে যোগ দিয়েছেন এবং নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বঙ্গবন্ধু যে লিখিত জবানবন্দি দেন, তার সঙ্গে শুধু নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ তুলনীয়। তিনি বলেছিলেন:

১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন, আমি তাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।

যুদ্ধ প্রচেষ্টার সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে।

জুন ১৯৬৮-তে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত সেই জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন:

যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ও প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ সকল বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।

যুদ্ধকালীন অবস্থা ও পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য দুই প্রদেশের প্রধান দলগুলোর নেতাদের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয় লাহোরে। বঙ্গবন্ধুও সেখানে যোগ দেন। সে সম্পর্কে তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন:

১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলির নিয়মতান্ত্রিক সমাধান—ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থিত করি। ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হইয়াছে।

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথা যখনই বলা হয়েছে, তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র তাঁকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেছে। ১৯৫০–এর দশকে ভাসানী বলায় তাঁকে ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’, ‘ভারতের দালাল’ বলা হয়েছে। একইভাবে শেখ মুজিবকেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় ‘পাকিস্তানের শত্রু’ বলে করা হয়েছে জেল-জুলুম। ছয় দফার অপব্যাখ্যা করে শাসকশ্রেণি ও তাদের সহযোগীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে থাকায় শেখ মুজিবও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দেন।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬-তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা কর্মসূচী পুস্তিকাটি বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল। পুস্তিকাটি সে সময় যে আবেদন সৃষ্টি করেছিল, তা তুলনাহীন। শুরুতেই তিনি বলেন:

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,

আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবী রূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈহৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত-নির্বাচন-প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয় শিক্ষালাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।

আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতেও এঁরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই।…আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ বছরের বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সারাৎসার অংশ তাঁর আমাদের বাঁচার দাবী ৬–দফা কর্মসূচী লেখাটি। প্রথম মুদ্রণের পর স্বাধীনতার আগেও এটি অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। ছয় দফার সংক্ষিপ্ত আকারের পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। তবে প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকাটির বক্তব্য মূল্যবান নানা কারণে। সেই পুস্তিকাটির দু–তিনটি কপি আমার সংগ্রহে ছিল। ১৯৭৩–এ খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা যাই। তাঁর প্রকাশিত একটি কপি তাঁকে দেখিয়ে জানতে চাই সেটি প্রকাশের সময়ের কথা। তিনি বলেন, ওটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখা মুসাবিদা। অন্য কেউ ওতে হাত দেননি। তিনি ডিকটেশন দিয়ে লেখাননি। ওই পুস্তিকায় তিনি বলেছিলেন:

আমি জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এঁদের দশটা, গলার সুর এঁদের শতাধিক। এঁরা বহুরূপী। [পাকিস্তানের মূলমন্ত্র] ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট। এঁরা নানা ছলা-কলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে তিনি দোষারোপ করেননি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়:

আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন।…এই আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ী আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা। ধরুন যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি সদর দফতরই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা-সুবিধা হইত, একটু বিচার করুন।

পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্যের চরিত্র তিনি যুক্তিসহকারে তুলে ধরেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয়ের অধিকাংশ চলে যায় পশ্চিমে। অথচ জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগ বাস করে বাংলায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন:

পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান, আপনারা দেখিতেছেন, যেখানে-সেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয় দিতাম। যদি পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইত, তবে আপনাদের দাবী করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্য সত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম।…আমরা দেখাইতাম, পূর্ব পাকিস্তানীরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের নয়, ছোট-বড়নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানীর। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তার সুযোগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা সব অধিকার ও চাকরি গ্রাস করিতাম না।…পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না। এমনই উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফবোধই পাকিস্তানী দেশপ্রেমের বুনিয়াদ।

সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় ‘আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম শেখ মুজিবর রহমান’ লিখেছিলেন:

আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬-দফা দাবীতে একটিও অন্যায়, অসংগত, পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্কসহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছে।…আমার দেশের প্রিয় ভাইবোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।

আজীবন তিনি বাংলার মানুষের খাদেম বা সেবক হিসেবে ‘তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সাধনায়’ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। ছয় দফার বক্তব্য জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলায় জনসভা করছিলেন। মধ্যবিত্তের বিশেষ করে শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে আবেদন ছিল। তাদের মধ্যে ছিল সুপ্ত বঞ্চনাবোধ। তাই জনসভায় জনসমাগম হচ্ছিল প্রচুর। আইয়ুবের তাঁবেদার গভর্নর মোনায়েম খান তাঁর সভা–সমাবেশে বলছিলেন, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কোনো কোনো অংশ ‘আপত্তিকর’, গোয়েন্দাদের দিয়ে এমন রিপোর্ট করিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে থাকে। এক জনসভার মামলায় জামিন নিতে না নিতে আরেক জেলায় মামলা করা হয়। সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক তৎপরতায় বাংলার মানুষের সমর্থন বঙ্গবন্ধুর দিকে যায়। তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তীব্রতা সৃষ্টি হয় এবং জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।

৮ মে ’৬৬, নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে সরকারের দমননীতির কঠোর সমালোচনা করেন। ওই দিনই দেশরক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ৭ জুন নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সারা দেশে ধর্মঘট আহ্বান করে। ১৪৪ ধারা জারি সত্ত্বেও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। তেজগাঁও ও টঙ্গী শিল্প এলাকা ও নারায়ণগঞ্জে আবুল হোসেন, মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত অসংখ্য। গ্রেপ্তার করা হয় হাজার দেড়েক। হরতালে হতাহতের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ বিভিন্ন দল বিবৃতি দেয়।

সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক হীন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ৩ জানুয়ারি ১৯৬৮, তাঁকে এক নম্বর আসামি করে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৫ জন বাঙালি সদস্য ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে। সেই ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু ও অন্য অভিযুক্তদের সাধারণ কারাগার থেকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আটক করা হয়। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব’ শিরোনামে সেই মামলার বিচারের বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে শেখ মুজিবের প্রতি সব শ্রেণি–পেশার মানুষের গভীর সহানুভূতির সৃষ্টি হয় এবং গড়ে ওঠে তাঁর এক মহানায়কের ভাবমূর্তি।

আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব সরকারের পতনের লক্ষ্যে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ছাত্র-যুব-শ্রমিক –পেশাজীবীদের দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। ওই মামলা থেকে তিনি আদালতের রায়ে মুক্তি পাননি, বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর থাবা থেকে ছিনিয়ে আনে গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা দেয়। সেখানে তাঁকে যে অভিধায় সম্বোধন করা হয়, আজ তা তাঁর নামের অংশ: বঙ্গবন্ধু। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক ও লেখক 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে