করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তির নানা অভিযোগ

0
242

বাংলাদেশে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যে কারণে নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্যও হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে প্রতিদিন।

সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যাওয়া একজন ব্যক্তির পরিবার সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, ওই ব্যক্তিকে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে খাবার এবং কোন চিকিৎসা দেয়া হয়নি। হাসপাতালটি করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্ধারিত একটি হাসপাতাল।

বাংলাদেশে গত ৮ই মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হবার খবর প্রকাশের পর থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তির নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে। এমনকি অনেক জায়গায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে সেবা দিতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য-কর্মীদের অস্বীকৃতি জানানোরও অভিযোগ ওঠে।

কী বলছে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল

কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বিবিসিকে বলেছেন, রোগীকে অবহেলা বা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ তারা পেয়েছেন, এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

“আমি অস্বীকার করবো না যে এমন অভিযোগ আমরা পাইনি। কিন্তু এখন পরিবেশটাই হচ্ছে ‘প্যানিকড’ হবার পরিবেশ, এবং সবার মধ্যে ‘করোনা-ফোবিয়া’ কাজ করছে। কিন্তু আমাদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসক এবং সেবাকর্মী আন্তরিকতা ও সাহসের সঙ্গে কাজ করছে। এখন এর মাঝে দুয়েকজন আছে, যারা অবহেলা করতেও পারেন।”

“কিন্তু তাদের ব্যাপারে আমরা কঠোর হয়েছি, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয় কঠোর হয়েছে। এখন আশা করি আস্তে আস্তে এ পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।”

ডা. শিহাব উদ্দিন উল্লেখ করেন, এই অভিযোগে ১১ই এপ্রিল কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ছয়জন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্তও করেছে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ছয়জনের মধ্যে দুই জন সরাসরি কোভিড-নাইনটিন আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

এদিকে, সরকারও বলছে যারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীর নমুনা সংগ্রহ এবং তাকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অবহিত রয়েছে।

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি নতুন হওয়ায় এবং এখনো এর চিকিৎসা আবিষ্কৃত না হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ধরণের সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে।

তবে দ্রুতই সেসব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে সরকার।

‘আমার ভাই খাবার বা চিকিৎসা পাননি ১২ ঘণ্টায়’

ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ৯ই এপ্রিল ঢাকার একটি পোশাক কারখানার মালিক মোহাম্মদ তাসলিম আক্তার মারা যান। মার্চের ২৮ তারিখে প্রথম জ্বর ওঠে মি. আক্তারের। এরপর জ্বর একবার কমেছে, একবার বেড়েছে, কিন্তু তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।

যদিও তার পরিবার বলছে, মি. আক্তারের শরীরে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষ্মণ ছিল না। এক পর্যায়ে ৬ই এপ্রিল আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পুরান ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রুটিন পরীক্ষায় কোন ক্রুটি না পেয়ে, চিকিৎসকের পরামর্শে তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। ৭ই এপ্রিল জানা যায় তিনি করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। পরদিন দুপুরে মি. আক্তারকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৯ই এপ্রিল সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে কোন এক সময় তিনি মারা যান।

মি. আক্তারের ছোটভাই মোহাম্মদ এহতেশাম বিবিসিকে বলছিলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর তার ডায়াবেটিক ভাইকে ১২ ঘণ্টায় কোন খাবার দেয়া হয়নি, এমনকি কোন চিকিৎসকও আসেননি তাকে দেখতে।

“বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে আমার আরেক ভাইয়ের সঙ্গে, বড় ভাইয়ের (মি. আক্তার) কথা হয়, উনি তখন বলেছেন, ঐ সময় পর্যন্ত তাকে কোন ডাক্তার দেখতে আসেনি, কোন খাবারও দেয়া হয়নি।”

এরপরের কয়েক ঘণ্টা ফোনে আর কোন যোগাযোগ করতে পারেনি মি. আক্তারের পরিবার। এরপর তারা অস্থির হয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, পরে নিজেরা হাসপাতালে চলে যান। তার আগেই তারা জানতে পারেন, মি. আক্তারকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বাথরুমে পাওয়া গেছে এবং দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করা হয়েছে। বিকেল নাগাদ জানা যায় তিনি মারা গেছেন।

মি. এহতেশাম বলছিলেন, “আমার কথা হলো হাসপাতালে গিয়ে উনি কোন খাবার খাননি, সেটা দুঃখজনক। উনি কোন চিকিৎসাই পেলেন না, সেটা দুঃখজনক।”

বাংলাদেশে এই মূহুর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আটটি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সবগুলোতে এখনো পুরোদমে কাজ শুরু না হওয়ায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়া রোগীর সিংহভাগই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

কিন্তু এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে মি. এহতেশামের ভাই এর মত অনেকেই অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলছেন।

বাংলাদেশে পুলিশ, সৈন্য দিয়ে লকডাউন নিশ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে
বাংলাদেশে পুলিশ, সৈন্য দিয়ে লকডাউন নিশ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে

পরীক্ষাতেও ভোগান্তি

করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে অপ্রতুল সরঞ্জামাদির একটি অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। আস্তে আস্তে সরকার পরীক্ষার সুযোগ বাড়ালেও এখনো অনেককেই বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মুশফেকা ইসলাম বলছিলেন, চারদিন ধরে ফোন করে ও বিভিন্ন মাধ্যমে তদবিরের পর গত ২৭শে মার্চ তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর।

“আমি জ্বর ও গলা ব্যথা নিয়ে আইইডিসিআরে ফোন দিই, তখন তারা কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা করার পর জানাল আমার নমুনা সংগ্রহ করতে হবে এবং তারা দ্রুতই বাসা থেকে নমুনা নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনদিন পার হবার পরেও কেউ এলো না।”

“এরপর আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেই, যেটা দেখে আমার শিক্ষক এবং কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সহযোগিতায় ফোন দেয়ার চতুর্থ দিনে আমার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর।”

কিন্তু এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মিজ ইসলামকে তার পরীক্ষার ফল জানানো হয়নি। তিনি জানিয়েছেন, পরিচিত একজন কর্মকর্তার সূত্রে আইইডিসিআর থেকে নিজের নমুনার ফল জানতে পেরেছেন তিনি।

নমুনা সংগ্রহে ভোগান্তির এমন অভিজ্ঞতা মিজ ইসলামের মত আরো অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে