ত্রাণের মহড়া ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস

    0
    333

    করোনায় ত্রাণ বিতরণের ‘মহড়া’ আতঙ্ক ছাড়াচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠেছে ত্রাণ বিতরণের পদ্ধতি নিয়ে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বের নীতি৷

    এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ত্রাণ বিতরণের সময় ফটো সেশন৷ এমনও দেখা গেছে যারা ত্রাণ নিচ্ছেন তারা সামাজিক দূরত্ব মানছেন না৷ কিন্তু যারা দিচ্ছেন তারা গাদাগাদি করে দাঁড়ান৷ ত্রাণ দেয়ার সময় ছবি তুলতে গিয়ে আরো ঘনিষ্ঠ হন ত্রাণ প্রার্থীদের৷ সব মিলিয়ে ত্রাণই এখন যেন নতুন এক বিপদের নাম৷

    ত্রাণ বিতরণের বাংলাদেশ স্টাইল
    মঙ্গলবার দুপুরে গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ত্রাণ বিতরণ করে বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ নামের একটি সংগঠন৷ তারা একটি মাইক্রোবাসে করে তারা প্যাকেট করে দুপরের খাবার নিয়ে আসেন৷ আর তখন সেই খাবার নিতে জড়ো হন ওই এলাকার কয়েকশ’ গরীব মানুষ৷  সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা তারা রীতিমত ধাক্কাধাক্কি কাড়াকাড়ি শুরু করে দেন৷ এক পর্যায়ে পুলিশও তাদের সামলাতে ব্যর্থ হলে ত্রাণদাতা সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ওই এলাকা থেকে দ্রুত সটকে পড়তে বাধ্য হন৷

    এর কিছুক্ষণ পর গোলাপ শাহ মাজারের কাছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি পিকআপ ভ্যানে করা চাল-ডালসহ ত্রাণসমগ্রী নিয়ে আসা হয় ভাসমান মনুষকে দেয়ার জন্য৷ কিন্তু পিকআপ ভ্যান থেকে তাদের আর বিতরণ করতে হয়নি৷ ভাসমান গরীব মানুষরা নিজেরাই কাড়াকাড়ি করে ত্রাণের প্যাকেটগুলো নিয়ে যান৷ যারা ত্রাণ বিতরণ করতে আসেন তারা অসহায়ের মত তাকিয়ে দেখেন৷  এরকম দৃশ্য ঢাকার রাস্তায় এখন প্রায়ই চোখে পড়ে৷ এমনকি  অনেকে নিজ বাড়িতে  বসে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা মানছেন না৷ আর বাড়ির সামনে শত মানুষের ভিড় জমে যায়৷ পুলিশ থাকলেও তারা কোনো ভূমিকা নেন না৷ পরিস্থিতি খারাপ দেখলে চলে যান৷ গত সপ্তাহে ধানমন্ডির একটি বাড়ির সামনে গেট আটকে দেয়ার পর রীতিমত যুদ্ধ শুরু হয় ত্রাণের জন্য৷ আর তখন পুলিশও দ্রুত সেখান থেকে চলে যান৷ 

    ‘ত্রাণ দেয়ায় শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন এখনই’

    শাহবাগ ও প্রেসক্লাবের সামনে কিছু সামাজিক ওর রাজনৈতিক সংগঠন রীতিমত ব্যানার টানিয়ে ফটোসেশন করে ত্রাণ বিতরণ করছে৷ ঢাকার বাইরেও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কমীরা একইভাবে সামাজিক দূরত্ব না মেনে ফটোসেশন করে ত্রাণ বিতরণ করছেন৷

    ঢাকায় আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বের হন৷ অভাবী মানুষের জটলা দেখলেই সেখানে নেমে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেন৷ আর এই কারণেই এখন বিভিন্ন রাস্তার পাশে একসঙ্গে বসে থাকেন ত্রাণপ্রার্থীরা৷ 

    আছে ব্যতিক্রম
    তবে এর ব্যতিক্রমও আছে৷ যেমন বাকেরগঞ্জের কলসকাঠির সামাজিক সংগঠন ‘সম্ভাবনার কলসকাঠি’ আগে তালিকা করে রাতে বাসার সামনে গিয়ে ত্রাণ সামগ্রী রেখে ফোন করে তাদের নিয়ে যেতে বলেন৷ তারা পুরোপুরি সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য নিরপত্তা মেনে এই কাজ করেন বলে জানান সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কামরুল হাসান সোহাগ৷

    ঢাকার ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল ও তার বন্ধুরা ‘চাল,ডাল, আলু- বাঁচার জন্য’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে ত্রাণ কাজ চালান৷ তারাও তালিকা করেন ত্রাণ দেন৷ তবে তারা তালিকা ধরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তা বিতরণ করেন৷ যাতে লোক জমতে না পারে তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই কাজটি করেন তারা৷ উজ্জ্বল বলেন, ‘‘ঢাকায় অনেকে আছেন ভাসমান ৷ আবার বস্তিতে গেলে লোক জমে যায়৷ তাই আমরা এই পদ্ধতিতে কাজ করি৷’’

    উজ্জ্বল বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে গরীব মানুষ খুঁজতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হতে হয়না৷ যার যার এলাকায়ই গরীব মানুষ আছেন৷’’

    ত্রাণ বিতরণে করোনা ছাড়ানোর আশঙ্কা 

    বাংলাদেশে এখন করোনার কমিউনিটি স্প্রেডিং শুরু হয়েছে৷ এ পর্যন্ত করোনায় ১৭ জন মারা গেছেন৷ মঙ্গলবার মারা গেছেন পাঁচ জন৷ সারাদেশে কার্যত লকডাউন চলছে৷ সেই অবস্থায় নিয়ম নীতি না মেনে এইভাবে ত্রাণ বিতরণে আশঙ্কায় রয়েছেন চিকিৎসকেরা৷

    প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‘যেভাবে ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে গাদগাদি করে, করোনার স্বাস্থ্য বিধি না মেনে তাতে আসলে করোনা আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে৷ অশ্লিল ফটোসেশন আর প্রচারের লোভে তারা কী ভয়ঙ্কর ক্ষতি করছেন তারা হয়তো নিজেরা তা বুঝতে পারছেন না৷’’

    এটা বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সরকারি বেসরকারি সব পর্যায়ে ত্রাণ দেয়ায় শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন এখনই৷ সবচেয়ে ভালো হয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিধি মেনে তালিকা করে ত্রাণ বাসায় পৌঁছে দেওয়া৷ তবে বস্তি বা ভাসমান মানুষের জন্য নিরাপদ কোনো জাগায় তালিকা করে ত্রাণ বিতরণ করা যেতে পারে৷ সেখানে প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নিয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে৷ মনে রাখতে হবে এটা করোনার সময়৷ আমরা যেন সেবা করতে গিয়ে ক্ষতি না করে ফেলি৷’’  

    সরকারের অবস্থান
    সরকার এরই মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো যেকোনো ত্রাণ বিতরণ বাড়িতে গিয়ে করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে৷ আর সেটা হতে হবে তালিকা করে ৷ বিতরণের সময় অপ্রয়োজনীয় লোকজন যেতে পারবেন না৷ সামাজিক দূরত্ব মেনে ত্রাণ দিতে হবে৷

    ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান, ‘‘সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা হলো রাস্তায় বাইরে সারি করে ত্রাণ দেয়া যাবে না৷ তালিকা করে সামাজিক দূরত্ব মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ দিতে হবে৷ সরকারের বাইরে যারা ত্রাণ দিতে চান তারা জেলার ডিসিদের কাছে ত্রাণ জমা দেবেন৷ প্রশাসনের পক্ষ থেকেই স্বাস্থ্য বিধি মেনে ত্রাণ পৌছে দেয়া হবে৷ এর ব্যতিক্রম হলে আমরা তাদের শাস্তির আওতায় আনবো৷’’

    তিনি জানান, ঢাকার বাইরে এরই মধ্যে বাইরে লাইন ধরে ত্রাণ দেয়ার এই প্রবণতা কমেছে৷ কিন্তু ঢাকায় এখনো অব্যাহত আছে৷ আমরা মনিটরিং জোরদার করছি৷ 

    কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বাড়বে
    দেশে বিশেষ করে ঢাকা ও বড় শহরে অনেক মানুষ আছে যাদের কোনো সুনির্দিষ্ট থাকার জায়গা নেই, ভাসমান৷ তাদের কাছে কিভাবে ত্রাণ পৌছে দেয়া সম্ভব? তারাতো রাস্তার পাশে দল বেধে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকেন৷ আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে সেই ভাসমান মানুষের মধ্যেই ত্রাণ বিতরণ করেন৷ এর জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘কারোর যদি ঘর নাও থাকে তারপরও তার একটা ঠিকানা আছে৷ রাতে সে এক জায়গায় ঘুমায়৷ সেভাবেই তাদের চিহ্নিত করতে হবে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ত্রাণ পৌঁছে দিতে হবে৷’’

    তার মতে, ‘‘এটা না করা গেলে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বাড়বে৷ এটা আমরা হতে দিতে পারি না৷’’

    চিহ্ন দিয়ে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে সারি করিয়েও ত্রাণ দেয়া যাবেনা বলে জানান তিনি৷ কারণ শেষ পর্যন্ত ওই দূরত্ব থাকে না এবং হুড়োহুড়ি হয়৷

    এদিকে ত্রাণ বিতরণের সময় পুলিশকে জানানো এবং তাদের সহায়তা নেয়ার জন্যও বলা হয়েছে৷

    একটি উত্তর ত্যাগ

    আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
    এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে