‘নদী এবং নদীতে প্রাণ বাঁচাতে ঐক্য’: নোঙর’র ভাসমান সভা ২০১৬

0
499

এক সময় গোটা বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল নদী, সেই গল্প এখন অতীত।

নদী আমাদের প্রাণ, নদী না বাঁচলে ঢাকা তো দূরের কথা বাংলাদেশও বাঁচবে না। যে ক’টা নদী আছে সেগুলো দখল-দুষণ থেকে সুরক্ষা এবং নদীতে চলাচলকারী নৌযানের নিরাপত্তা গ্রহণের এখনই সময়।

নদীতে ভেসে নৌ-নিরাপত্তা ও নৌ-যানের সুরক্ষা বিষয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী সংগঠক, বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষ এবং নৌ-যান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জোরালোভাবে এমনটাই মতামত দিয়েছেন। পাশাপাশি নৌ-দুর্ঘটনা থেকে রক্ষায় নৌ-যানের নকশার ত্রুটি দূরীকরণ এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের (ডিজি শিপিং) কাছে নৌ-নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়। নৌ-নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকার পাশেই বুড়িগঙ্গা ও কুমিল্লা-চাঁদপুরে মেঘনা নদীর বুকে একটি জলযানে সোমবার (২৩ মে) দিনব্যাপী একটি ভাসমান সেমিনারের আয়োজন করে নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন ‘নোঙর’।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মল হক সদরঘাটে সংস্থার ‘সন্ধানী’ জাহাজে সকাল সাড়ে ১০টায় এই সেমিনারের উদ্বোধন করেন।

‘নদী এবং নদীতে প্রাণ বাঁচাতে ঐক্য’ স্লোগান নিয়ে সেমিনারের শুরুতেই বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান বলেন, নদী আমাদের প্রাণ, নদী সুরক্ষায় সবার সচেতনতা দরকার। নৌ-দর্ঘটনা এড়াতে বর্তমানে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডিজি শিপিং) নৌ-যানের নকশা অনুমোদন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, নৌযানগুলোর তথ্য ভাণ্ডার তৈরির কাজ চলছে। ক্লিক করলেই নৌ-যানের ফিটনেসের তথ্যগুলো চলে আসবে। এতে বোঝা যাবে নৌযানগুলো ফিট কি না। ফলে নজরদারি আরও বাড়বে। রাতের বেলা নৌযান চলাচলের জন্য রাডার, জিপিএস সিস্টেম, ইকো সাউন্ড রাখা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বলেন, যান্ত্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়া কোন নৌ-যান চলবে না।

একই সাথে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। নদী না বাঁচলে শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশও বাঁচবে না জানিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ. ই. মামুন সরকারের নীতি নির্ধারকদের নিয়ে নদী রক্ষার পথে এগোনোর পরামর্শ দেন। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার বলেন, দখল ও দুষণ রোধ এবং নৌ-নিরাপত্তায় নিজ নিজ উদ্যোগ জরুরি। নৌ-যানের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানের ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মো. কাওসার বলেন, নৌ-যানের নকশার ত্রুটির কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরকে ভাঙা, ল্যাংড়া, নুলা নৌ-যান দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে তারা যুদ্ধ করছেন, লোকবলও নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কাছে নৌ-যানগুলোকে আধুনিক করার জন্য কোন সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল। তিনি বলেন, সেখান থেকে মোডিফাই প্ল্যান না পাওয়ায় নৌ-যানগুলো আধুনিক ও গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া দুর্ঘটনা এড়াতে নদীর পাশে বেসিন (নিরাপদে রাখার স্থান) না থাকায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় খালের মধ্যে ঢুকাতে হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। ‘শেখ সাহেব (বঙ্গবন্ধু), ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী আমাদের ছোট ছোট লঞ্চে উঠে জনগণের কাছে যেতেন, লঞ্চেই ঘুমাতেন; কই সে সময় তো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এখন কেন দুর্ঘটনা ঘটছে?’ তিনি বলেন, মালিকরা উচ্ছা করে নৌ-যান ডুবায় না, নদীর নাব্যতা কমে গেছে, ঠিকমত পানির স্রোত থাকে না বলেই দুর্ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে বড় বড় লঞ্চ দিলে দুর্ঘটনা কম ঘটবে। দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষায় দেশ মাতৃকার জন্য সবাইকে একটু সচেতনভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা সাইদুর রহমান।

২০০৪ সালের ২৩ মে’ চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ফিটনেসহীন লঞ্চ ‘এমভি লাইটিং সান’ ডুবির বার্ষিকীতে নৌ-নিরাপত্তা নিয়ে এই ভাসমান সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ‘এমভি লাইটিং সান’ ডুবির এক যুগপূর্তির দিনে এই আয়োজনে ওই দুর্ঘটনায় মা হারানো নোঙর’র চেয়ারম্যান সুমন শামস জানান, অভ্যন্তরীণ ৬ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথের ৭৪টি রুটের ছোট বড় ২০ হাজার নৌ-যান চলাচল করে।

এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি লঞ্চের রেজিস্ট্রেশন নেই, যেগুলোর আছে সেগুলোর ফিটনেস বিহীন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নৌ-যান তৈরির নকশা অনুমোদন করে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদপত্র নিতে হয়। নৌ স্থপতিদের নৌ-যান নকশা তৈরির কথা থাকলেও এ কাজ করছেন অদক্ষ ড্রাফটসম্যানরা, ফলে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিখিত বক্তব্যে সুমন আরও বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ৫৪৫টি নৌ-দূর্ঘটনায় ১৮ হাজার ২৬২ মানুষ প্রাণ হারান। এরমধ্যে ১ হাজার ৫২৭টি নৌ-যান নিমজ্জিত হযেছে, উদ্ধার হয়েছে ৯৯৯টি। এখনো ৫২৯টি নৌ-যান উদ্ধার করা হয়নি।

সম্পদহানি হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার প্রায় ৪০ ভাগ চালকের দোষে, ২০ ভাগ মালিকের অতি লোভ, ২০ ভাগ খারাপ আবহাওয়া, ১০ ভাগ ড্রয়িং ডিজাইনের ক্রুটি, ৫ ভাগ নৌ-পথের নাব্যতার অভাব, ৩ ভাগ পাইলটের ক্রুটি এবং ২ ভাগ মার্কিংয়ের অভাবে ঘটে বলে জানান সুমন।

নৌ দুর্ঘটনা ও নদী রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ২৩ মে’কে জাতীয় নৌ-নিরাপত্তা দিবস ঘোষণার দাবি জানায় নদী নিরাপত্তার সামাজিক এই সংগঠন। বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে নোঙর’র প্রতিনিধিদের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদনের পরামর্শ দিয়ে সে বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

পদ্মাসেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুজ্জামান খান, পরিবেশ সংগঠক জাকিয়া শিশির, বিআইডব্লিউটিএ’র সাবেক কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ বন্দরের যুগ্ম পরিচালক আরিফ হোসাইনসহ বিশিষ্টজনরা সেমিনারে অংশ নেন।

সকালে সদরঘাটে জাহাজে সেমিনারের উদ্বোধনের পর মেঘনা ব্রিজের কাছ থেকে পুনরায় সদরঘাটে ফিরে আসার ৭০ কিলোমিটার নদী পথে চলে আয়োজনটি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে