বসন্তের রঙে রঙিন বসন্ত-বরণ

0
1802

‘আসে বসন্ত ফুল বনে, সাজে বনভূমি সুন্দরী/ চরণে পায়লা রুমুঝুমু, মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি’- কবির এই গানের মতো করেই যেন বসন্তের রং-রূপ এবার প্রকৃতি থেকে উঠে এল মানুষে দ্বারে; ফাগুনের রং ছড়িয়ে গেল রাজধানীবাসীর মনে।

রঙিন বসন্তকে উৎসবে বরণ করে নিতে রুক্ষ ইট-পাথরের রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সোমবার সকাল থেকে দিনভরই ছিল নানা আয়োজন, যাতে সব বয়সীদের ছিল সরব উপস্থিতি।

সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বসন্ত উৎসবের আয়োজনটি ছিল জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের। সকাল পৌনে ৮টায় সারেঙ্গিতে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনায় শুরু হয় এই আয়োজন।

“নিষ্প্রাণ, হিসেবী, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন এই নগরজীবন। ফাগুনের এই দিনে তাই সবাই যেন প্রকৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে মিলে গেছেন নিমিষেই। নিজেকে নতুন করে চিনে নেওয়া আর অন্যকে প্রীতির বন্ধনে বাঁধার এ যেন এক দারুণ উৎসব,” বলেন উৎসবে যোগ দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সংগীতা আহমেদ।

অভিনেত্রী নোভা ফিরোজের কাছে শহরে বসন্ত উৎসব মানে ‘প্রাণের উৎসব’।

তিনি বলেন, “স্কুলবেলা থেকে এ উৎসবে আসছি। তখন উৎসবের মাজেজা তো অত বুঝতাম না। দিনে দিনে এই বসন্ত উৎসব আরও রঙিন হয়ে উঠল। হয়ে উঠল নগরবাসীর প্রাণের উৎসব।”

আশি বছর ছুঁইছুঁই কমরে আলম বলেন, “বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ উৎসবে সামিল হই। কেমন এক মানসিক প্রশান্তি পাই এ উৎসবে এসে।”

ঋতু উৎসবের আয়োজনটি শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক ও কবি শামসুর রাহমানের প্রচেষ্টায় ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।

উৎসবে এসে সোয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান খবির উদ্দিন খান বলেন, “বসন্তের প্রতি অনুভূতি আর আবেগের কমতি হয়নি এতটুকু। তার তীব্রতা আরও বেড়ে গেছে বলে এ উৎসব উদযাপনের প্রবণতা যেন আরও বেড়ে গেছে। বাঙালির এই বসন্ত সত্যি সার্বজনীন।”

বসন্তবরণে সবার সঙ্গে উৎসবে জড়ো হয়ে মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা জানান মিলি নামের এক তরুণী।

“উৎসবে এসে মানসিকতাই পরিবর্তন হয়ে গেল। মন খারাপ ছিল, কিন্তু এখানে এসে মন ভীষণরকম ভালো হয়ে গেল। প্রকৃতির রংয়ে রঙিন হতে আজ নেই মানা, মানা নেই রং ছড়াতে।”

শ্যামল নামে এক তরুণ বলেন, “ব্যস্ত নগরজীবনকে উপভোগ করার মতো সাংস্কৃতিক উৎসব নেহায়েত কম। এমন উৎসবে এসে মনে আজ রং লেগেছে। রংয়ের এমন ছড়াছড়িতে আটপৌরে নগরজীবন থেকে যেন একটু রেহাই পেলাম।”

বিয়ের ঠিক পরই বসন্ত উৎসব, সে উৎসবে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে এলেন আব্দুর রশিদ ও নুসরাত দম্পতি।

নুসরাত বলেন, “পহেলা বৈশাখ আর বসন্ত উৎসব- এই দুই ঋতু উৎসবের জন্য অপেক্ষায় থাকি।”

বসন্ত উৎসবে এসে পরিচয় সোহেল আর রুনুর, সেই পরিচয় সূত্রে প্রণয়। বসন্ত উৎসব তাই ‘বিশেষ দিন’ হয়ে আছে তাদের কাছে।

রুনু বলেন, “এ উৎসবে না এসে কি পারি! তবে ছুটির দিনে এই উৎসবটি হলে বড় ভালো হত। এই দেখুন না, একটু পরেই অফিসে যেতে হবে। সারাবেলা ঘুরে বেড়ানো, আবীর খেলা, গান শোনা, নাচ দেখা- কত কিছু মিস করব।”

সময় টেলিভিশনের গবেষণা বিভাগে কাজ করা সাজিদ আরাফাত ব্যস্তসূচির ফাঁকে সময় পেতেই চলে এলেন বন্ধু অনুকে নিয়ে।

তিনি বলেন, “সার্বজনীন এ উৎসবের প্রচারণা আরও বেশি হওয়া দরকার ছিল। উৎসব চারুকলা অনুষদকেন্দ্রিক না হয়ে নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেলে এতে আরও প্রাণের সঞ্চার হত।”

একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক স্মৃতি মণ্ডলের প্রার্থনা, “ঋতুরাজের প্রথম দিনে আগতরা সকলেই কায়মনে প্রার্থনা করেছেন- সব সংকট কেটে ভালো থাকুক মানুষ, ভালো থাকুক দেশ।”

এর আগে মতিয়ার রহমানের ধ্রুপদী যন্ত্রসংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় বসন্ত উৎসব। তিনি রাগ ভৈরবী পরিবেশন করেন । যন্ত্রের বাদন শেষে শাস্ত্রীয়সংগীত উপস্থাপন করেন অসিত রায়, তিনি গেয়ে শোনান বসন্তভিত্তিক ধ্রুপদী রাগ।

ঋতুরাজকে স্বাগত জানিয়ে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী গেয়ে শোনায় ‘আয়রে বসন্ত নবীন পাখা মেলে’। এরপর পরিবেশন করা হয় সাওতালি নাচ। মাদলের তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন চার সাওতাল তরুণ-তরুণী।

‘কোন গহিনে ফুটে চম্পা’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ‘কাঁদামাটি’। তামান্না রহমানের নির্দেশনায় ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যম। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ বসন্ত’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়।

ফাহিম হোসেন চৌধুরী গেয়ে শোনান ‘অলি বারবার ফিরে আসে যায়’। ‘আমার মল্লিকা বনে’ গেয়ে শোনান বুলবুল ইসলাম। ‘জাগাও জাগাও গানের সুরে’ নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যনন্দন।‘বসন্ত এল এল রে’ পরিবেশন করে গানের দল সুরসপ্তক। ‘বসন্ত বর্ণন’ শীর্ষক মণিপুরি নাচ পরিবেশন করেন ওয়ার্দা রিহাব ও তার দল ধৃতি নর্তনালয়।

পরে একক গান পরিবেশন করেন বিমান চন্দ্র বিশ্বাস। বসন্ত গানে সাজানো নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে পূজা সেনগুপ্ত।‘বসন্ত বাতাসে সই গো’ গানটি গেয়ে শোনায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। ‘আহা আজি এ বসন্তে’ পরিবেশন করে নৃত্যাক্ষ।আদিবাসী নৃত্য পরিবেশন করে রাঙামাটি থেকে আগত অন্তর দেওয়ান ও তার দল।

শিল্পকলা একাডেমিতে ‘বসন্ত উৎসব’

বসন্ত বরণে শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে তিন দিনের বসন্ত উৎসব।

সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টায় একাডেমির নন্দনমঞ্চে শুরু হয় এ উৎসব, যার আয়োজক একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগ।

‘দোল ফাগুনে দোল লেগেছে’, ‘ঘরেতে ভ্রমর এলো গুণগুণিয়ে’ গানের সঙ্গে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশনায় শুরু হয় উৎসব। তারপর অনিক বোসের পরিচালনায় ‘বসন্ত মনে দিচ্ছে উঁকি’ গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পী দল।

এরপরে সমবেত সংগীত পরিবেশন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ, ঢাকা সাংস্কৃতিক দল।

একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সালমা আকবর, খায়রুল আনাম শাকিল, অদিতি মহসিন, ইয়াসমিন মোশতারী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝর্ণা সরকার, নায়লা তারান্নুম কাকলী, বেলায়েত হোসেন, মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে