ঢাবি ক্যাম্পাসে চলছে নিয়মিত ছিনতাই, প্রশাসন অসহায়

0
595

শনিবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ (নোঙরনিউজ ডটকম): ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় একের পর এক ছিনতাই, গুলি আর অন্যত্র খুন করে লাশ ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সেগুলো ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা নেই।

ক্যাম্পাস এলাকায় রাতে আতঙ্কিত বোধ করার কথা জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকে। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, পথচারী আর নিয়মিত ঘুরতে আসা অন্যদেরও ভাষ্য, এখনকার ক্যাম্পাস অনেক বেশি ‘অনিরাপদ’।

এই আতঙ্কের জন‌্য গত তিন বছরে এ এলাকায় সংঘটিত অন্তত ২০টি অপরাধকে কারণ মনে করা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এই অভিযোগ অস্বীকার করছে না। তারা বলছে, চারদিক খোলা হওয়ায় দুর্বৃত্তরা সহজেই ক্যাম্পাস এলাকায় অপকর্ম করে সটকে পড়তে পারছে। যে কারণে ‘চেষ্টা থাকলেও’ কিছু করা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে মোটর সাইকেল আরোহী ছিনতাইকারীর গুলিতে আহত হন বিশ্ববিদ‌্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মনিরুজ্জামান মাসুদ। ওই সময় চার ছিনতাইকারী ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেন তিনি। তাতেই ছিনতাইকারীরা তাকে গুলি করে ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের মাত্র কয়েক গজ দূরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের সামনে ছিল এক গাড়ি পুলিশ; আর যে পথে ছিনতাইকারীরা পালিয়েছে সেখানে পড়ে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি ও নিউ মার্কেট থানা।

এর আগে ৩১ জানুয়ারি সকালে একই স্থানে ছিনতাইয়ের শিকার হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইমারত হোসেন ইমু। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে ক্লাসে যাওয়ার পথে ক্লাবের সামনে এলে দুই ছিনতাইকারী চাকু দেখিয়ে তার মোবাইল ফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যায়।

ছিনতাইয়ের মুখে গুলির আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল মাস দুই আগে। পলাশী থেকে চা খেয়ে হলের ফেরার পথে ব্যানবেইসের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল যুবায়ের ভূঁইয়ার মোটর সাইকেল আটকে দাঁড়ায় একটি প্রাইভেটকার। ঘটনা বুঝে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে ফের পলাশীর দিকে আসতে চাইলে ছিনতাইকারীরা গাড়ির ভেতর থেকেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।

২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একটি অনুষ্ঠানে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি মারগারিটা কুলেনারার হাতব্যাগ চুরি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। পরে অবশ্য চোরকে আটক করা হয়।

একই বছরের ৯ অক্টোবর দূর্গাপূজা দেখতে আসার পথে নীলক্ষেত গেইটের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্রের স্ত্রীর গলা থেকে স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নেয় দুই ছিনতাইকারী।

এর আগে ৯ এপ্রিল দুপুরে দোয়েল চত্বরে রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় আজম উদ্দিন নামের এক পোশাক ব্যবসায়ী কাছ থেকে ডিবি পরিচয়ে সাত লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।

২০১৬-র মতো আগের বছরের ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায়ও ছিনতাইকারীরা দোয়েল চত্বরকেই বেছে নিয়েছিল। এদিন রিকশায় বাসায় যাওয়ার পথে ল্যাপটপসহ ব্যাগ হারান এনসিসি ব্যাংকের কর্মকর্তা একরাম হোসেন। ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগ টান দিলে একরাম নিজেও চলন্ত রিকশা থেকে নিচে পড়ে যান, ভাঙে তার হাত।

ওই বছরের ২৩ মে সকালে রোকেয়া হলের সামনে ছিনতাইয়ে শিকার হন ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান। প্রাইভেটকারযোগে এসে হাতব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইরকারী। এ সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে সামনে দাঁড়ানো দেখলেও তারা কিছুই করেননি বলে অভিযোগ ইশরাতের।

তার কিছু দিন পর ৪ জুন জগন্নাথ হলের সামনে রিকশায় থাকা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিনের ল্যাপটপ ছিনতাই করে নেয় দুর্বৃত্তরা।

তার তিন সপ্তাহ পর সন্ধ্যায় টিএসসি থেকে হলে ফেরার পথে ভিসি চত্বরের কাছে কবি জসীম উদদীন হলের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম সুজনের ল্যাপটপের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া হয়।

ওই বছরের ২৭ অগাস্ট রাতে পলাশী থেকে চা খেয়ে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আব্দুল আলীম ও জাহিদ হাসান। “সাদা রঙয়ের একটি গাড়ি থেকে তিনজন নেমে হলের গেইটের সামনেই অস্ত্র দেখায়। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে দুটি মোবাইল ফোন, টাকা আর এটিএম কার্ডসহ মানিব্যাগ দিয়ে দিই,” বলেন আব্দুল আলীম।

২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে ফেরার পথে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় ছিনতাইয়ের শিকার হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সুধাংশু শেখর রায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান সুধাংশু যেদিন ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন, তার পরদিন ইডেন কলেজের ছাত্রী রোকেয়া সরকার দোলা বিশ্ববিদ্যালয়ে জহরুল হক হলের সামনে দিয়ে রিকশায় যাওয়ার সময় হারান তার হাতে থাকা ব্যাগ। দুই ছিনতাইকারী তার ব্যাগ টান দিলে তিনিও রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হন।

ওই বছরের ৭ মার্চ বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিকশায় করে জগন্নাথ হল থেকে শাহবাগে যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের শিকার হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ছাত্র সুজন ঘোষ। চারুকলা অনুষদের সামনে পৌঁছালে মোটর সাইকেল আরোহী দুই ছিনতাইকারী তার ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়। ওই দিন ৭ মার্চ সোহরাওয়াদী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থাকায় রাস্তায় পুলিশ ছিল। “কিন্তু পুলিশকে বললেও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি ছিনতাইকারীকে ধরার,” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন সুজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে জানিয়ে শাহবাগ থানায় জিডি করেও কোনো লাভ হয়নি তার।

এর আগে ২০১৩ সালে ২৭ এপ্রিল শহীদ মিনার এলাকায় ছাত্রলীগের গত কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুল হাসান রাসেলকে গুলি করে তার মোটর সাইকেল ছিনতাই করে নেয় দুর্বৃত্তরা।

ছিনতাই ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ২০১৬ ও ২০১৫ সালে দুইটি অজ্ঞাত ব্যক্তি লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

২০১৫ সালে ২১ মার্চ সকালে ক্যাম্পাসের ভেতর পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনের রাস্তায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের কপালে ও পিঠে আঘাতের দাগ ছিল; বাইরে কোথাও হত্যা করে দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পাসে লাশ ফেলে রেখেছে বলে শাহবাগ থানার তৎকালীন ওসি সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন।

ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলায় গুরুত্র আহত হয়ে হাতের আঙ্গুল হারান তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। সেটি জঙ্গিদের কাজ বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

২০১৪ সালে ছিনতাইয়ের শিকার শিক্ষক সুধাংশু উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ক্যাম্পাসে যে সমস্ত জায়গায় ছিনতাইয়ে ঘটনা ঘটে সেখানে পুলিশের টহল বাড়ানো দরকার।”

একের পর এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করছে জানতে চাইলে ‘অসহায়’ সুর ফুটে উঠে প্রক্টর এম আমজাদ আলীর কণ্ঠে।

তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে অবাধ যাতায়াত থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহিরাগতরা ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যেতে পারছে।

“ক্যাম্পাসে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী নিরাপত্তা দেওয়া চেষ্টা করছি। পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি- তাদের টহল বাড়াতে বলেছি। তবে হঠাৎ হঠাৎ এরকম ঘটনা ঘটে যায়। যেহেতু ক্যাম্পাস উন্মুক্ত, সেহেতু বহিরাগতদের আনাগোনা আছেই।”

প্রক্টর জানালেন, ঘটনা ঘটে গেলে কিছু তৎপরতার পর আবারও পুরনো নিরাপত্তা কার্যক্রমের সুযোগ নেয় দুর্বৃত্তরা।
“এ ঘাটতি পূরণ করা দরকার। যেকোনো ভাবেই হোক ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা আরো জোরদার করা এবং পুরো ক্যাম্পাস সিসি ক্যামেরায় আওতায় আনা জরুরি,” বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ে এলাকার মধ‌্যেই শাহবাগ থানা; তবে ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশের পদক্ষেপ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন
মঙ্গলবারের ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের টহল বেড়েছে বলেও জানান এম আমজাদ।

“ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। বহিরাগত কি না, তারা ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে এসে ক্যাম্পাসে ছিনতাই করে,আবার বের হয়ে যাচ্ছে। না কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত- তা এখনও নিশ্চিত না।”

ওই ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়েছে বলে জানান ওসি আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ওই ঘটনার ‘ক্লু’ পেয়েছি। এখন অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছি।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

“ছিনতাই ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টহল বাড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জায়গায় ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো ঘটছে সেসব স্থানে ও ক্যাম্পাসের প্রবেশ গেইটগুলোতে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।”

সূত্র : বিডিনিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে