নদীর আইনী অধিকার নিশ্চিত করুন’ : সুমন শামস

0
695
সুমন শামস, নদী নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙর প্রতিষ্ঠাতা

এক সময় গোটা বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল শত শত নদনদী, সে কথা এখন অতীত। স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় স্লোগান ছিল- ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা’। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর সেসব ঠিকানা হারিয়ে যেতে বসেছে। উজানের দেশ বিভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করায় উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় পানির অভাবে খরা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে সাগরের লোনা পানি খাল-বিল-নদী হয়ে উল্টো পথে চলতে শুরু করেছে। সে কারণে জীবনযাপন, কৃষি চাষ, সবুজ প্রকৃতি, জলজ প্রাণী ও সার্বিক পরিবেশ অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে। আমরা যেন নদীমাতৃক পরিচয় হারিয়ে যেতে বসেছি!

এ ছাড়াও নদী দখল-দূষণের মহাউৎসব চলছে শহরের চারপাশ ঘিরে। শুধু শহরেই নয়, এই দৃশ্য এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক জেলার নদীতে দেখা যায়। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না শুকিয়ে যাওয়া কিংবা ভরা নদনদী দখল। সবখানে সমানতালে চলছে দখলের মহোৎসব। আমাদের নোঙরের অনুসন্ধানে দেখতে পাচ্ছি, দখল প্রক্রিয়া থামানোর জন্য মাঝে মধ্যে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু তার মেয়াদ থাকে খুবই কম। বাকি সময় ধরে চলতে থাকে দখলের প্রতিযোগিতা। আর এই দখলবাজরা কোনো সাধারণ লোক নয়, সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা।

নদীর পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে একযোগে দখলমুক্ত করে নদী বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই বলে নদী বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহল থেকে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। আমরা দেখি, বারবার দখলমুক্ত করার চেষ্টা চলে; কিন্তু নদী দখল বন্ধ হয় না। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। যখন যেখানে যে যেমন পারছে নদীর পল্গাবন ভূমি এবং নদীর বুকের ওপরেই নির্মাণ করা হচ্ছে বিশাল বিশাল দালান। এক কথায় কোথাও নদনদী তার আপন গতিতে চলতে পারছে না। নদীতে স্রোত না থাকায় কচুরিপানা ও ময়লা জমে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটছে। নদনদীর প্রাণশক্তি ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়ায় পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখনও কোনো নদী নীতিমালা নেই! ২০০৯ সালে নদনদী রক্ষায় হাইকোর্ট থেকে একটি রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও নদী রক্ষায় জাতীয় নদী কমিশন ও টাস্কফোর্স রয়েছে। এদের কোনো সুপারিশও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই নদীও রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশপ্রেমবিরোধী একটি সংঘবদ্ধ চক্র নদী ধ্বংস করে অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছে। আর এই চক্র সবসময় নদী-প্রকৃতি ধ্বংসের পক্ষে কাজ করছে রাজনৈতিক পর্দার আড়ালে থেকে।

অথচ পৃথিবীতে একটিমাত্র নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। আমরা দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করছি যে, আমাদের দেশের নদীগুলো দখল-দূষণ এবং নানা রকমের মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার কারণে নদীগুলো এখন মুমূর্ষু অবস্থায় আছে।

নদীমাতৃক দেশ হিসেবে একসময় বাংলাদেশ সারা দুনিয়ায় পরিচিতি লাভ করেছিল। তার গ্রামীণ পরিবহন ব্যবস্থার একটা বৃহত্তর অংশ ছিল নদীপথে এবং নদীর পানি এই দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেনি বরং নদ-নদীতে উত্পাদিত মাছ আমাদের প্রোটিন চাহিদা পূরণের প্রধান উত্স হিসেবেও বিবেচিত হতো। সময়ের বিবর্তনে আমাদের নদীগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে, তাদের হাজার হাজার শাখা নদী ও খাল-বিলে এখন পানি নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চর পড়ে গেছে, অনেক স্থানে নদী ও খাল ভরাট করে মানুষ চাষাবাদ করছে। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টি ও উজানের পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে, প্রধান প্রধান নদী ও তাদের শাখা নদীসমূহের ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে সেগুলো ভর্তি হয়ে পাড় উপচিয়ে গ্রামগঞ্জ পানিতে তলিয়ে দিচ্ছে। এতে বন্যার ভয়াবহতা বাড়ছে এবং বাড়িঘর, গবাদিপশু ও মানুষের সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি হচ্ছে।

নাব্য হ্রাস পাওয়ায় নদীপথে নৌযান চলাচল অসম্ভব ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে নদীসমূহের গভীরতা না থাকায় শুকনা মওসুমে সেচের পানির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বস্তুত নদীনালা, খালবিল ও হাওরসমূহে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে দেশের অগভীর মূল ও শেকড়সম্পন্ন গাছপালার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। এছাড়াও নদী দখল দূষণের মহাউত্সব চলছে শহরের চারপাশ ঘিরে। শুধু শহরেই নয়, এই দৃশ্য এখন বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক জেলার নদীতে দেখা যায়। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না শুকিয়ে যাওয়া কিংবা ভরা নদনদী দখল। সবখানে সমানতালে চলছে দখলের মহোত্সব। আমাদের নোঙরের অনুসন্ধানে দেখতে পাচ্ছি, দখল প্রক্রিয়া থামানোর জন্য মাঝে-মধ্যে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু তার মেয়াদ থাকে খুবই কম। বাকি সময় ধরে চলতে থাকে দখলের প্রতিযোগিতা।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বহুমাত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নোঙরের পক্ষে আমরা দেশের নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশে প্রথম দাবি তুলে ছিলাম। এই নদীগুলোকে সুরক্ষার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে এবং একত্রে মিলিত হয়ে আমরা যে আন্দোলন করি, শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ না রেখে নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে নদীর অধিকার নদীকেই বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। তাহলে প্রত্যেকটি নদী নিজেই বাদী হয়ে নিজেকে সুরক্ষার জন্য আদালতে রিট করতে পারবে, মামলা করতে পারবে।

পাশাপাশি যারা নদী সংশ্লিষ্ট আছেন, সরকারে যারা আছেন, তাদের সবার প্রতি আমরা নোঙর পরিবারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানাচ্ছি, ‘আসুন নদীর প্রতি আমরা সচেষ্ট হই, নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে নদীর প্রতি আমরা সদয় হই। তাহলে নদী আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে আর আমাদের দেশটি আরও সবুজ ও সুন্দর হয়ে উঠবে।

প্রতিষ্ঠাতা, নোঙর, নদী নিরাপত্তার সংগঠন
shumanshams@yahoo.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে