বইমেলায় নামছে বিশেষ টাস্কফোর্স

0
794

একুশে বইমেলায় একাধিক প্রকাশনীর নীতিমালা ভঙ্গের খবরে এবার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করছে বাংলা একাডেমি।

নীতিমালা ভঙ্গের বিষয়টি তদারকি করতে সাত সদস্যের ওই বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে বলে শুক্রবার রাতে নোঙরনিউজ ডটকমকে জানান গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ।

বাংলা একাডেমির বিক্রয়-বিপণন বিভাগের এই পরিচালক বলেন, “দু-একদিনের মধ্যেই তারা (টাস্কফোর্সের সদস্যরা) মাঠে নামবে।”

জালাল আহমেদ জানান, গ্রন্থমেলার নীতিমালার ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর ধারার ব্যত্যয়ে কাজ করবে এই ‘বিশেষ’ টাস্কফোর্স, যাতে বাংলা একাডেমি, কপিরাইট অফিস ও পুলিশের সদস্যও থাকবেন।

টাস্কফোর্সের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত প্রকাশনীগুলোর বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ছুটির দিনে জমজমাট বইমেলা

ছুটির দিনে সারা বেলা বইমেলা ছিল পাঠক-দর্শকের আনাগোণায় মুখর।

শুক্রবার সকালে ছিল শিশুপ্রহর; শিশু-কিশোররা যখন তাদের পছন্দের বইগুলো বাছাই করছে, তখন বড়দেরও পছন্দের উপন্যাস-অনুবাদ-গল্প কিংবা রহস্য রোমাঞ্চের খোঁজে ঢুঁ মারতে দেখা যায়।

বিকাল হতেই পাঠকের দীর্ঘ সারি ছাড়িয়ে যায় টিএসসি চত্বর, ওপাশে দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে হাই কোর্ট মাজারের দিকেও চলে গিয়েছিল সারি। সন্ধ্যায় ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই।

বাবা মোহাম্মদ বারাকাতের সঙ্গে মেলায় এসেছিল আফসানা তৃষা। মেলায় এসে ড্রাগন আর ডাইনোসরের গল্পের বই কিনেছে। ভয়ঙ্কর সব দৈত্য-দানোর গল্প পড়তে ভালোলাগে তৃষা’র, ভালোবাসে ছড়াও। সিলেবাসের বইয়ের বাইরে অনেকগুলো ছড়া তার মুখস্থ।

তৃষা বলল, “আমি স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের এসব ছড়া শোনাই। বন্ধুরা বলে, তুমি কত ছড়া জানো..!”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রেজাউল করিম খান এসেছেন তার দুই মেয়ে মিম খানম ও মন্টি খানমকে নিয়ে।

ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মিম বলল, “বই পড়ার সুযোগ খুব কম পাই। পড়ার চাপ অনেক তো। তবে ছুটি পেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে আমি সঙ্গে করে বই নিয়ে যাই। বই তখন আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে।”

তবে আরেক খুদে পাঠক রাহাত আহমেদ হিমেল জানাল, সে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে বই পড়ে।

আর তাসজিদ আরিফ বলল, ‘জানো, আমি পড়ার বইয়ের ফাঁকে ওসব বই পড়ি! ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি আম্মু দেখে ফেলে।”

১২ বছরের ক্ষুদে পাঠক শ্রেষ্ঠর ভালো লাগে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস। শিশুদের চত্বরে পছন্দের বইটি না পেয়ে সে চলে গিয়েছিল বড়দের চত্বরে। সেখানে গিয়ে সে খুঁজে পেল ‘তিন গোয়েন্দা’ আর ‘ফেলুদা’ সমগ্র।

আড়াই বছরের নুহাশ ফাতিমাকে নিয়ে মেলায় আসা বাবা আলম খান বলেন, “মেয়েকে প্রতিদিন রাতে ছড়া শোনাতে হয়। নতুবা সেই ঘুমাবেই না।”
শুক্রবার সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, এর উদ্বোধন করেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী। প্রতিযোগিতা ক-শাখায় ২৩৮ জন, খ-শাখায় ৩২৪ জন এবং গ-শাখায় ৭৮ জনসহ সর্বমোট ৬৪০ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

প্রবাস থেকে সদ্য দেশে ফিরেছেন তানভীর রানা আহমেদ, মেলায় এসেছেন স্ত্রী জয়শ্রী চৌধুরীকে নিয়ে। এই দম্পতি জানালেন, তারা উপন্যাস-অনুবাদ আর জীবনী পড়তে ভালোবাসেন। নিজেদের পাশাপাশি স্বজনদের জন্যও বই কিনেছেন তারা।

তানভীর বলেন, “পাঁচ বছর পর মেলায় এলাম। পছন্দের বইগুলো কিনে নিয়েছি আজ।”

রাজন-মুমিত-সায়মা-লুবনা, চার বন্ধুর এই দলটি মেলায় এসেছিল ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে। পছন্দের উপন্যাস সমগ্র খুঁজে পেলেও তারা অন্যান্য বিষয়ের বইগুলো কিনতে পারেননি।

রাজন বলেন, “এই ভিড় ঠেলে কোনোভাবেই বই কেনা যাবে না। একসময় ফাঁকা দিনে এসে বই কিনতে হবে।”

বাংলার প্রভাষক শ্যামল কান্তি বলেন, “মেলায় আসা তরুণরা বই কিনুক আর না কিনুক, তারা তো বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। এটাই আমাদের মতো সাহিত্যপ্রেমী, লেখকদের উৎসাহিত করে।”

মধ্যবয়সী তিন বন্ধু আফজালুর রহমান, মুশতাক মল্লিক ও জিল্লুর হাসান রবি এসেছিলেন দল বেধে। প্রিয় বইয়ের খোঁজ করেছেন, তেমনি কিনেছেন লেখক বন্ধুদের বেশকটি বই।

আফজাল রহমান বলেন, “বন্ধুর বই এসেছে। অনুরোধও করেছে একটি বই কিনতে। বন্ধু লিখে খারাপ না।”

প্রবাস থেকে ফিরে মিল্টন মোজাহিদ এসেছিলেন মেয়ে বর্ষাকে নিয়ে। বর্ষার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের গল্পসমগ্র কেনার পাশাপাশি তিনি আরও কিনেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু বই।

শুক্রবার মেলায় ‘ভালো বিকিকিনি’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি।

“মেলা যত গড়াচ্ছে, বই বিক্রি বাড়ছে। পাঠকরা তাদের পছন্দসই বই কিনে নিচ্ছেন। মেলা যেন তার আসল রূপটি ফিরে পাচ্ছে।”

মূল মঞ্চের আয়োজন

বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ই মার্চ ১৯৪৮’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। আলোচনায় অংশ নেন আহমাদ মাযহার এবং মো. মশিউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান।

গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেকেই ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়কে তেমন গুরুত্ব প্রদান করেননি।”

সভাপতির বক্তব্যে ড. আতিউর রহমান বলেন, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এক বহুব্যাপ্ত আন্দোলন। মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে বাংলার ছাত্রজনতা আন্দোলন সংগ্রামে শামিল হয়।

“এরই অংশ হিসেবে ১৯৪৮-এর ১১ই মার্চ আন্দোলনের যে বীজ বপন হয়, তা পরিণতি লাভ করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে।”

নতুন বই

গ্রন্থমেলার দশম দিনে নতুন বই এসেছে ৩১৩টি; মোড়ক উন্মোচন করা হয় ৪৩টির।

নতুন আসা বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্প ৪১টি, উপন্যাস ৬৪টি, প্রবন্ধ আটটি, কবিতা ১০৯টি, গবেষণা পাঁচটি, ছড়া নয়টি, শিশুসাহিত্য ছয়টি, জীবনী ছয়টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছয়টি, নাটক দুইটি, ভ্রমণ তিনটি, ইতিহাস তিনটি, রাজনীতি দুইটি, চিকিৎসা/স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি, রম্য/ধাঁধাবিষয়ক চারটি, ধর্মীয় একটি, সায়েন্স ফিকশন সাতটি এবং অন্যান্য বিষয়ে ৩৩টি।

শুক্রবার মেলায় এসেছে মুস্তাফিজ শফির দুইটি নতুন বই। এর মধ্যে উপন্যাস ‘ঈশ্বরের সন্তানেরা’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ, তার পুরস্কারপ্রাপ্ত ও আলোচিত আটটি ধারবাহিক প্রতিবেদন নিয়ে ‘নির্বাচিত অনুসন্ধান’ প্রকাশ করেছে রয়েল পাবলিশার্স।

শাকিলের রচনাসমগ্র প্রকাশ করবে বাংলা একাডেমি

শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে সদ্য প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলের ‘ফেরা না-ফেরার গল্প’। মৃত্যুর আগে তার লেখা ছয়টি গল্পের সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বইটি।

এ গল্পগুলোতে উঠে এসেছে চারপাশের বাস্তবতা, বন্ধুত্ব, দেশপ্রেম, জঙ্গিগোষ্ঠীর অপতৎপরতা, শেকড়চ্যুত মানুষের একাকীত্ব ও যন্ত্রণা।

গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসবে অংশ নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ঘোষণা দেন, মাহবুবুল হক শাকিলের তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও এই গল্পগ্রন্থটি নিয়ে তার রচনাসমগ্র প্রকাশ করবে বাংলা একাডেমি।

অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘ফেরা না-ফেরার গল্প’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য দেড়শ টাকা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে