মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র প্রদর্শনী শুরু

0
828

বৃহস্পতিবার, ১৫ মার্চ ২০১৯, (নোঙরনিউজ) : যাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে তাদের রক্তের কাছে নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই ঋণী।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের বীরত্বের গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় দিন। এই দিনে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের বাঁচার সাধ ছিল কিন্তু তারা একটা আলাদা দেশ, আলাদা জাত ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। বিজয় অতি আনন্দের কিন্তু এ আনন্দের মধ্যে আমাদের স্মরণ করতে হবে, এর পেছনে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস রয়েছে।

যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদরা প্রাণ দিয়েছে, সে স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব আজ আমাদের ওপর। আজ যদি যোগ্য নাগরিক তৈরি করে এ দেশের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা না যায় তা হলে শহীদের সে ত্যাগ বৃথা যাবে।

শহীদুল জহিরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস অবলম্বনে স্বাধীনতার মাস মার্চে নির্মিত হয়েছে প্রযোজনাটি। উপন্যাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনাময় রূপায়নের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ঘটমান বর্তমানের এক তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে পরিবর্তনশীল ‘সত্য’ প্রতিরূপায়িত হয়েছে প্রযোজনাটিতে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় নাটকটি মঞ্চে এনেছে প্রযোজনাভিত্তিক নাট্যসংগঠন স্পর্ধা।

নাটকটি প্রসঙ্গে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাদু বাস্তবতায় ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ লিখেছিলেন শহীদুল জহির। আর প্রযোজনাটিতে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনাময় রূপায়ন শুধু নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরবর্তী সময়ের চিত্র।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে যুদ্ধটা কেমন ছিল এবং স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা কিভাবে পরবর্তীতে পুনর্বাসিত হলো, সেসব বিষয় উঠে এসেছে ঘটনাপ্রবাহে। তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনযাতনা। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বর্তমানের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে এগিয়েছে কাহিনি। এতে পরিবর্তনশীল সত্যের পথ ধরে কাহিনির প্রতিরূপায়ণ ঘটেছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ২০ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত নাটকটির আরও দশটি প্রদর্শনী হবে। মোট ১১টি মঞ্চায়নের মাধ্যমে নাটকটি নিয়ে সাজানো হয়েছে সপ্তাহব্যাপী ‘মুক্তিযুদ্ধ নাট্য উৎসব’ ২০১৯। ৪৮তম স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী এ নাট্যযজ্ঞে সহযোগিতা করছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শিল্পকলা একাডেমি।

একাত্তরের ঘটনাকেন্দ্রিক নাটকের পটভূমিতে আসে ১৯৮৫ সাল। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১৪ বছর পর লক্ষ্মীবাজারের যুবক আবদুল মজিদ রায়সা বাজারে যাওয়ার পথে নবাবপুর সড়কে তার স্যান্ডেলটি ছিঁড়ে যায়। আবদুল মজিদ দেখে রাস্তার উল্টো দিকে পুলিশ ক্লাবের কাছে মাইক্রোফোন হাতে আবুল খায়েরকে জনতার উদ্দেশে ভাষণরত অবস্থায়। তার মনে হয়, আকাশে যত কাক ওড়ে, সেগুলো আবুল খায়েরের জোব্বার ভেতর থেকেই যেন বের হয়ে আসে। একাত্তর সনে প্রথম যেদিন লক্ষ্মীবাজার এলাকায় মিলিটারি আসে সেদিন আবুল খায়েরের পিতা বদরউদ্দিন মাওলানার নির্দেশে একদিনে সাতজন মানুষ খুন হয় এবং তিনজন নারী শ্লীলতা হারায়। এ সময় বদু মাওলানা ও তার ছেলেরা এক থালা মাংস নিয়ে বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে, মহল্লাবাসীর মতে সেগুলো ছিল মানুষের মাংস।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে আবদুল মজিদের বোন মোমেনাকে তুলে নিয়ে যায় বদু মাওলানার রাজাকার বাহিনী। মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়। একাত্তর সনের ডিসেম্বরের সেই বিষন্ন বিকেলে মজিদ যখন তার বোনের মৃতদেহ কুড়িয়ে আনে, সে সেটা একটি শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে এনেছিল। মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে মজিদের মায়ের কান্না জমে গিয়েছিল। মেয়েকে সে সেদিন শেষ গোসল করাতে দেয় নাই এবং কাফন ছাড়া পরনের শাড়িতে জড়িয়ে তাকে দাফন করতে মহল্লার লোকদের বাধ্য করেছিল। যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, বদু মাওলানা পালিয়ে যায়। কিন্তু দুই বছর পর ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে সে পুনরায় লক্ষ্মীবাজারে ফিরে আসে এবং মহল্লার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় একাত্তরের সেই আলখাল্লা দেখতে পায়। ফিরে আসার প্রথম দিন সে একাত্তর সনে মহল্লায় নিহত আট ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

মহল্লাবাসীর মতে এই দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা সে আসলে আটটি ক্ষতচিহ্ন পরীক্ষা করতে চেয়েছিল মাত্র। বদু মাওলানার এই ঔদ্ধত্য মজিদের মায়ের সহ্যের বাইরে চলে যায়; ঘৃণা জানিয়ে বলে ওঠে ‘থুক দেই, থুক দেই, থুুক দেই মুখে’। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দলের স্থানীয় নেতা লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা আজিজ পাঠান, মুক্তিযুদ্ধের সময় যার বাড়ি মিলিটারির সহায়তায় লুট করে বদু মাওলানা, সেই আজিজ পাঠান বলেন, আমার নেতা যেহেতু বদু মাওলানাদের মাফ করছে, আমার নিজের কোন প্রতিহিংসা নাই। রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কীইবা করার থাকে মানুষের।

কিন্তু লক্ষ্মীবাজারবাসী দেখে যে, তাদের অতীত অনবরত ঘাসের অঙ্কুরের মতো মাটি ভেদ করে উঠে আসে। তারা এখন এই সত্যটি ভুলে থাকে যে মসজিদে জমায়েত হওয়ার অধিকারও চিরন্তন নয়; কারণ একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে যখন তারা দেখেছিল নয়াবাজারের লাল আগুন আকাশ থেকে একটি পর্দার মতো ঝুলে আছে, সেই শুক্রবারে মসজিদে কোন মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ধ্বনিত হয় নাই, সেদিন কারফিউর ভেতর জুমার নামাজ কেউ পড়ে নাই। বোনের মৃত্যুর পনের বছর পর, ১৯৮৬ সালের গোড়ায় মজিদ তার নবজাতক কন্যার মুখ দেখে তার নাম রাখে মোমেনা।

একথা জানার পর বদু মাওলানা একদিন মজিদকে রাস্তায় থামিয়ে বলে, ‘বোনের নামে মেয়ের নাম রাখছো, বোনেরে ভোল নাই!’ বদু মাওলানার কথা শুনে মজিদের মনে হয়, বদু মাওলানা জানে আবদুল মজিদরা একাত্তরের নয় মাসের কথা ভোলে নাই। এই অবস্থায় কয়েক দিনের চিন্তাভাবনার শেষে মজিদ মহল্লা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মজিদ চায় না, তার মেয়েটি তার বোনের মতো বদু মাওলানা কিংবা তার ছেলেদের জিঘাংসার শিকার হোক।

বাস্তবতা সেভাবে এগোলে এরকম যে ঘটবে না, তা কেউ বলতে পারে না।

সৈয়দ জামিল আহমেদ জানান, অভিনেতা নির্বাচনে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসব্যাপী চারটি অভিনয় কর্মশালা আয়োজন করে নাট্য সংগঠন স্পর্ধা। এ নাটকে দেশের বিভিন্ন নাট্য সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৬ নাট্যকর্মী অংশ নেন। কর্মশালা থেকে নির্বাচিত ২০ অভিনেতা অংশ নিচ্ছেন নাট্য মঞ্চায়নে।

প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোয়েরী সুলতানা, প্রদ্যুৎ কুমার ঘোষ, আবদুর রাহীম খান, মহসিনা আক্তার, সউদ চৌধুরী, সোহেল রানা, যোজন মাহমুদ, উত্তম চক্রবর্তী, সরওয়ার জাহান, পিজু পারভেজ, কৌশিক বিশ্বাস, শারমিন আক্তার শর্মী, ফয়সাল কবির, শাহীন সাইদুর, শোভন দাস, সজীব চন্দ্র সরকার, হাসান মুহাম্মদ তাবিন, ইরফান উদ্দীন ও সানজিদা মিশি।

আগামী ২০ মার্চ পর্যন্ত সাত দিনে নাটকের মোট ১১টি প্রদর্শনী হবে। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হবে মঞ্চায়ন। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৭ এবং ২০ মার্চ দুটি করে প্রদর্শনী। এই দিনগুলোতে বিকাল সাড়ে তিনটায় প্রথম প্রদর্শনী হবে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে অনুষ্ঠিতব্য দুটি প্রদর্শনী জাতির জনকের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির নাটকের টিকেটের দাম রাখা হয়েছে এক হাজার, ৫০০ ও ৩০০ টাকা।

শিক্ষার্থীদের জন্য টিকেটের মূল্য ১০০ টাকা। নাটকটিতে অভিনয় করছে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের কর্মী এবং বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে