নাবিকের সমুদ্র কথন (দ্বিতীয় পর্ব-২৭) : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
443
captain Abdullah Mahmud. photo : shuman shams

৫ অক্টোবর, ২০১৮ : রাতে বউ এর সাথে মেসেঞ্জারে টেক্সট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল থার্ড অফিসারের ফোনে, তখন বাজে পৌনে ন’টা। এক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর একটানা প্রায় আট ঘণ্টা ঘুম। নিচে এসে ডিসচার্জ সম্পর্কিত কাগজপত্র স্বাক্ষর করে নাস্তা করছি, এমন সময় খবর এলো যে স্টোর নিয়ে বোট চলে এসেছে। আমাদের পাইলট আসবে এগারটায়, এখান থেকে যাব দশ কিমি দূরে একটি এংকরেজ এ, সেখানে আমাদের জ্বালানী ভরতে হবে। আগের পরিকল্পনা ছিল জ্বালানী ভরার সময়ে বোট আসবে খাবার ও স্টোর নিয়ে, কিন্তু চলে এসেছে এখানেই। যাক হাতে ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে, এসব উঠলে একটা ঝামেলা শেষ হবে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পরল স্টোর উঠানো ও তা নির্ধারিত জায়গায় রাখা নিয়ে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে পিচ্চিদের সাথে ভিডিও চাট করার জন্য ফোন দিলাম, ফোন ছিল ছোট ছেলে কাছে, সে নিজে নিজেই কল রিসিভ করে এক তরফা না না কথা বলে গেল, কিন্তু ক্যামেরা অন করতে পারলো না নিজে নিজে, তাই তার কণ্ঠ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হল। পাইলট চলে এলো পৌনে এগারটায়, জানালাম আমাদের একটু দেরী হবে, স্টোর উঠানো হচ্ছে। মালপত্র উঠানো শেষ করে যখন লঞ্চ চলে গেল এগারোটার একটু পরে, আর সাথে সাথে শুরু হল আমাদের দরি-কাছি ছেড়ে জেটি থেকে বেড়িয়ে যাওয়া। বাধন মুক্ত হতে সময় অনেক কম লাগে, সাড়ে এগারটার দিকে জেটি ছেড়ে ভেসে এলাম মাঝ নদীতে, গন্তব্য মারকাস হুক এংকোরেজ।

দশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নোঙর করতে করতে বেজে গেল সাড়ে বারটা। পাইলট নামার সময় দেখিয়ে দিল যে আমাদের জ্বালানী বহনকারী জাহাজ একদম কাছে চলে এসেছে, সুতরাং তার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। এবার ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মচঞ্চলতা শুরু হবে, ডেকের লোকের ভূমিকা শুধুই সহায়তাকারী। লাঞ্চ করে ব্রিজে গিয়ে বকেয়া মেইলগুলো দেখে নিলাম। পরবর্তী ভয়েজের কোন নির্দেশ এখনো আসেনি, তবে মৌখিকভাবে বলা আছে ভেনিজুয়েলা যেতে হবে লোডিং এর জন্য। দুটা বাজে ক্যাবিনে গিয়ে আবার ঘুম দিলাম কারণ আজকেও রাত জাগতে হবে।

এলার্ম দিয়েই ঘুমিয়ে ছিলাম, এবং পাঁচটায় ঘুম ভাঙল এলার্মের ১০ মিনিট আগে। একটু ফ্রেশ হয়ে ব্রিজে গিয়ে মেইল চেক করে দেখলাম যে পরবর্তী ভয়েজের নির্দেশ বা ভয়েজ-অর্ডার চলে এসেছে, ভেনিজুয়েলা লোডিং, পণ্য খালাস করব লেক-চার্লস, টেক্সাস। শুরু হয়ে গেল আরেক কর্ম ব্যস্ততা। এত লোড করলে আমাদের ড্রাফট কত হবে মানে জাহাজ পানির নিচে কতটা ডুববে, লেক চার্লসে এত পানি আছে, এত পানিতে নিরাপদে যেতে হলে সর্বোচ্চ কত কার্গো লোড করতে পারব এসব হিসাব নিকাশে ব্যস্ত হয়ে গেল চিফ অফিসার। এসিট্যান্ট পাওয়ার ব্যস্ত হয়ে গেল বার্তা প্রস্তুত করাতে, কাকে কাকে বার্তা পাঠাতে হবে, কখন ইটিএ নোটিশ দিতে হবে, এসব আগে ভাগে ঠিক করে রাখবে ও। এর পর চিফ অফিসার সব হিসাব নিকাস করে জানালে তার সাথে এসব বার্তা চলে যাবে যারা আমাদের ভাড়া করেছে তাদের কাছে, সাথে ভেনিজুয়েলার এজেন্ট ও আমাদের অফিস।

এদিকে জ্বালানী তেল ভরা হচ্ছে কচ্ছপ গতিতে, শেষ হতে হতে রাত তিনটা বাজবে, আর শেষ হলেই পাইলট আসবে দেলোয়ারে নদীপথ পাড়ি দিয়ে বহির্নোঙ্গর পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্য, যেখান থেকে আটলান্টিকের কোল ঘেঁষে রওনা হব ভেনিজুয়েলার দিকে। পাইলট আসার আগ পর্যন্ত আর কোন কাজ নেই, সুতরাং আমি বসে গেলাম আমার বকেয়া দিনপঞ্জি লেখায়। শুভরাত্রি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে