নাবিকের সমুদ্র কথন (দ্বিতীয় পর্ব-২৫) : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
507
captain Abdullah Mahmud. photo : shuman shams

৩ অক্টোবর, ২০১৮ : আজকে ঘুম ভাঙল মাটির টানে। যতই জলে বসবাস করি, আমি তো আর উভচর প্রাণী নই, আমি মাটির বাসিন্দা, মাটির টান অনুভব করবোই। আজকে বন্দরের ফেরার দিন, এরকম উৎকণ্ঠা থেকেই মনে হয় পাঁচটা বাজে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্রিজে ফোন করে জেনে নিলাম স্পীড কি রকম। স্পীড অনেক কমে গেছে, তাই ইটিএ ও দেরী হবে সন্দেহ নেই। কোন বন্দরে পৌঁছানোর আগে আমাদের কে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইটিএ পাঠাতে হয়, কিন্তু শেষ দিনে ২৪ ঘণ্টার পর ১২ ঘণ্টা, অনেক ক্ষেত্রে ৬ ঘনটার আগমনী বার্তা ও পাঠাতে হয়। আমরা ২৪ ঘণ্টা নোটিশ দিয়েছি গতকাল বিকেল চারটায়, সে হিসেবে ১২ ঘণ্টা যাবে ভোর চারটায়। এসব ক্ষেত্রে মেসেজ তৈরি করে রেখে দেই, ডিউটি অফিসারকে বলে দেয়া থাকে যাতে ভোর চারটা বাজে মেইল সংযোগ করে, এবং সময় মত মেইলটি পাঠিয়ে দেয়।

এসব ব্যাপারে খুবই সময়ানুবর্তীটা অনুসরণ করা হয়, কারণ আমার এখানে ভোর হলেও, এই পরিবহন ব্যবসার সাথে যারা জড়িত, তারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মেসেজ যেতে দেরী হওয়া মানে সিঙ্গাপুর বা লন্ডনে কারো দুশ্চিন্তা তৈরি করা। এমেরিকান এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে পণ্যটি পরিবাহিত হচ্ছে, জাহাজও এমেরিকায় রেজিস্ট্রিকৃত একটি কোম্পানির নামে চলছে এবং জাহাজটি সচরাচর এমেরিকার জলসীমাতেই থাকে, জাহাজটি যারা ভারা করেছে তারাও এমেরিকান, কিন্তু এ ভাড়ার সাথে জড়িত আসল কুশীলবরা কেউ হয়ত এমেরিকান নয়।

জাহাজটি লন্ডনের চার্টার মার্কেটে ছাড়া হয়ে থাকে, সেখানে বড় বড় ডজন খানেক চার্টার কোম্পানি এরকম হাজার হাজার জাহাজের ট্রিপ কেনা বেচা করে অনেকটা শেয়ার মার্কেটের ব্রোকার হাউস এর মত। এই বড় কোম্পানিগুলির আবার শত শত এজেন্ট সাব এজেন্ট আছে, যারা সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, দুবাই, মুম্বাই অফিস খুলে বসে আছে। লন্ডনের আসল চার্টার কোম্পানি গুলি একটা জাহাজ ও হয়ত ভাড়া দেয় না, তারা এ খবর গুলি তাদের এজেন্টদের দিয়ে দেয়। এজেন্টরা আবার বিভিন্ন সাব এজেন্টদের কাছে ছড়িয়ে দেয়। নিউজার্সির এ কোম্পানি এক লাখ টন তেল আনবে হিউস্টন থেকে, সে চার্টার মার্কেটে এটার চাহিদা পাঠিয়ে দেয়। আবার চার্টার মার্কেটের সিঙ্গাপুরের কোন এজেন্ট এই চাহিদা অনুযায়ী হয়ত জাহাজ খুঁজছে।

সেখানে মুম্বাই থেকে একজন হয়ত দেখল জাহাজ মার্কেটের এই জাহাজটি এ সপ্তাহে খালি আছে, সে সিঙ্গাপুর এজেন্ট কে প্রস্তাব দিল, সব শেষে লন্ডন মার্কেটের প্রধান ব্রোকার হাউস চুক্তি চূড়ান্ত করল, সেই চুক্তির নির্ভরতায় সিঙ্গাপুর এজেন্ট নিউজার্সির গ্রাহক কে জানাল যে তোমার জাহাজ চূড়ান্ত, আর মুম্বাই এর পাতি এজেন্ট হিউস্টনে আমাদের কোম্পানিকে জানালো তোমার এ জাহাজের জন্য আমি গ্রাহক চূড়ান্ত করে ফেলেছি। ভাড়া দেবে নিউজার্সির লোক, ভাড়া পাবে আমাদের কোম্পানি, লন্ডনের ব্রোকার হাউস কমিশন নেবে এক ফোটা কাজ না করে। কিন্তু এই ভাড়া ঠিক ঠাকের কাজ টি করেছে, লন্ডনের দুই এজেন্ট, এই দুই এজেন্টের দুই পাতি এজেন্ট যারা সিঙ্গাপুর বা মুম্বাই থাকে। সুতরাং ব্রোকার হাউস তাদের কমিশন থেকে এজেন্টদের একাংশ দেবে, আবার এজেন্টরা তাদের পাতি এজেন্টদের কিছুটা ভাগ বুঝিয়ে দেবে। তাই আমাদের জাহাজ অফিসিয়ালি লন্ডনের ব্রোকার হাউস ভাড়ার চুক্তি সম্পাদন করলেও আমারা ডুবেছি না ভেসে আছি তা নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথা নেই, তারা তাদের কমিশন পাবে। কিন্তু এজেন্ট ও পাতি এজেন্টদের শান্তি থাকেনা যতক্ষণ পর্যন্ত মাল সহি সালামতে না পৌঁছে, আর এজন্যই আমাদের এই বার্তা গুলি সময়মত পাঠাতে হয় যাতে এই পাতি ব্যাপারীরা ঘুমাতে পারে। এখনো পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছে, পৌঁছেও যাব সময়মত। আমার এসব নিয়ে অত মাথা ব্যথা নেই, আমার এখন প্রধান মাথা ব্যথা আমার স্টোর নিয়ে। পুরনো জাহাজ, মেরামতের জন্য অনেক কিছু লাগে, এদিকে জাহাজ কয়েক মাস পর কোম্পানি ছেড়ে দেবে, তারা একদম হিসেব করে জিনিষ পত্র দিচ্ছে যাতে অব্যবহৃত না থাকে। এখন এ সামান্য স্টোর ও যদি সময়ের অভাবে না নিতে পারি সেটা আমাদের জন্য মুসিবত।

সকালেই সাপ্লায়ারকে ফোন করে যেসব জিনিষগুলি বাকি ছিল, তাদের কোটেশন আনালাম। সব কিছুর কোটেশন পেতে পেতে বাজল বেলা এগারটা , বারটা বাজে সব চূড়ান্ত করে
পারিন্টেনডেন্টের কাছে পাঠালাম। এখন মেইলের উপর ভরসা করলে কাজ হবে না, সকাল থেকেই একটা মেইল এর সাথে সাথেই ফোন করে প্রাপক কে বলতে হয় ‘ভাইজান মেইল টা খুলেন’। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হয় ভাই পাইছেন? পাইলে এতক্ষণ পর্যন্ত মাছি মারতাছেন কেন মিয়া? উত্তর দেন। সুপারকে ফোন করে অনুমোদন নিয়ে সাথে সাথে নিউজার্সির সাপ্লায়ার কে পাঠানো হল, পাঠিয়ে আবার ফোন ‘ভাই সব ফাইনাল হইছে, আপনে কেনা কাটা শুরু করেন, পারচেজ-অর্ডার নাই, সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর অফিস খুললে তা পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেই আশায় বইসা থাইকেন না, তাইলে আমারে সাপ্লাই দিবার টাইম পাইবেন না’। আসলে এসব কিছুই আমার কাজ না, কিন্তু ঠেকায় পরে চারদিকে হাত পা ধরে ভাই দুলা ভাই বলে কাজ করাতে হচ্ছে, এর প্রধান কারণ হাতে সময় নেই আর আমাদের পারচেজ ম্যানেজার সাহেব জরুরী ছুটিতে ছিলেন।

এদিকে জাহাজ বহির্নোঙ্গরে পৌঁছে গেছে। দেড়টা বাজে মালপত্র সাপ্লাইয়ের ব্যাপার নিশ্চিত করে ন্যাভিগেশনের দিকে মন দিলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি দু মিনিট ব্রিজে তো পাঁচ মিনিট রেডিও রুমে। এসব কাজ আমার এসিস্ট্যান্টই করার কথা কিন্তু সে নিতান্ত নিরীহ গোবেচারা হলেও তার দুরালাপন ভয়ংকর। সে এমন ভাবে ফোনে কথা বলবে যে মনে হবে সে বকা ঝকা করছে। তাই তাকে মেইল দেখিয়ে দিতে হচ্ছে, আবার সাথে সাথে টেলিফোনের ব্যাপার আমাকেই দেখতে হচ্ছে। পাইলটের সাথে যোগাযোগের পর জানলাম আমাদের বাইরে নোঙর করতে হবে, তাই দুটো বাজেই পৌঁছে গেলাম যায়গা মত। এর পর নোঙর করার জন্য পছন্দ মত জায়গা খোঁজা, স্রোতের দিক দেখে জাহাজ কে স্রোতের মুখোমুখি করা, অতঃপর জাহাজকে থামিয়ে একদম স্থির করা এবং তার পর নোঙর নামিয়ে দেয়া, এবং সব শেষে কিছুক্ষণ দেখা যে আসলে নোঙর মাটি কামড়ে ঠিক মত বসেছে কিনা। অনেক সময়ই হতে পারে যে নোঙর ফেলা হয়েছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে আস্তে আস্তে পিছলে বেড়িয়ে যাচ্ছে, চিটাগাং বহির্নোঙ্গরে এটি অহরহ ঘটনা। এসব করে যখন ব্রিজ থেকে নামলাম তখন প্রায় চারটা।

পাইলট আসবে কাল ভোর ৩:৪৫, কিন্তু পাইলট যে জায়গা থেকে উঠবে তা আমাদের চেয়ে আরও আড়াই ঘনটার পথ, এর সাথে আর আধা ঘণ্টা হাতে রাখা, সুতরাং ১২:৪৫ এ রওনা হতে হবে, তার মানে ১২:৩০ এ নোঙর তুলতে হবে। সাড়ে বারটায় নোঙর তুলতে হলে সাড়ে এগারটায় ইঞ্জিনের প্রস্তুতি শুরু, সোয়া বারটায় আমাকে ব্রিজে আর সাড়ে বারোটায় নোঙর তোলার লোকজন সামনে থাকতে হবে। আমি রাত সোয়া বারটায় ব্রিজে যাব, এর পর জাহাজ নিয়ে পাইলট উঠবো পৌনে চারটায়, তারপর ৭ ঘণ্টা নদী পথ শেষে জেটিতে জাহাজ বাধতে বাধতে দুপুর বারতা বাজবে, এবং এই বার ঘণ্টা ব্রিজেই থাকে হবে। এমনিতে সাগরে যখন জাহাজ চলে, ক্যাপ্টেন যদি সকাল বিকাল ১০ মিনিট করে বিশ মিনিট ব্রিজে যায়, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু জাহাজ যখন এমন পোর্টে যাবে, পাইলট থাকে, এসব সময়ে ক্যাপ্টেনকে সম্পূর্ণ সময় ব্রিজে থাকতে হবে নিরবধি। রাতে আর ঘুম হবে না, তাই কখন কি করতে হবে কখন কাকে ডাকতে হবে এসব নাইট অর্ডারে লিখে ছ’টার মধ্যেই বিছানায়, সে সাথে আরেকটি দিনের সমাপ্তি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে