মেয়াদ বাড়িয়েও অসম্পন্ন হাওড়ের বাঁধ নির্মাণ

0
512

হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন, প্রাক্কলন ও কাজ শুরু কোনোটিরই ডেডলাইন রক্ষা হয়নি। এবার সময় বাড়ানোর পরও বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করা যায়নি। এরই মধ্যে সিলেটে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। গত বৃহস্পতিবার রাত এবং গতকালও বেশ বৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। গত বছরের দুর্যোগের আগাম অশনিসংকেত পাচ্ছেন তারা।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুনামগঞ্জের হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আরো ১৫ দিন সময় বাড়ানো হয়। এ বর্ধিত সময়সীমাও শেষ হয়েছে ১৫ মার্চ। কিন্তু অধিকাংশ বাঁধের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

কৃষকদের ভয়ের কারণ হলো, গত বছরও মার্চের শেষ সপ্তাহে হাওড়ে অকাল বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল বোরো ফসল। ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওড়ের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টরের ফসল। কৃষকদের হিসাবে অবশ্য ক্ষতির পরিমাণ এর দ্বিগুণ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের জন্য এবার সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৯৬৪টি পিআইসির মাধ্যমে এসব কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঁধ নির্মাণের নির্ধারিত সময় শেষে ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছিল। এরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

এর আগে নতুন নীতিমালায় হাওড়ের ফসল রক্ষা বাঁধের সব পিআইসি গঠন গত ৩০ নভেম্বর শেষ করার কথা থাকলেও তা জানুয়ারি পর্যন্ত বিলম্বিত হয়। ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরুর কথা থাকলেও শুরু হয় ৫ জানুয়ারি। এবার বাঁধ নির্মাণের সময়সীমাও রক্ষা করা গেল না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোতেও নীতিমালা অনুযায়ী কমপেকশন এবং স্লোপের কাজ হয়নি। ঘাস লাগানোর কাজ চলছে ঢিমেতালে। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারে বাঁশ, বস্তা, চাটাই, জিওটেক্সটাইল দেয়ার কাজ শুরু হয়নি। জগন্নাথপুরে মইয়ার হাওড়ের কয়েকটি বাঁধে মাটির বদলে বালি ফেলা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকছে।

জগন্নাথপুর উপজেলায় পিআইসি ৯১টি। মাটির কাজ এখন চলছে পাঁচ-সাতটিতে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, সার্বিকভাবে বাঁধ নির্মাণকাজ ৮৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। বালি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ রকম হয়ে থাকলে বালি মাটি সরিয়ে ভালো মাটি ব্যবহার করা হবে।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের জামখলা হাওড়ের ২ নং পিআইসির ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের কাজ এখনো শেষ হয়নি। এ বাঁধে বিশাল ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটল বন্ধের জন্য মাটি ফেলার কাজ চলছে। এ উপজেলার ৮০টি পিআইসির মধ্যে মাত্র দুটি পিআইসির বাঁধে ঘাস লাগানো শেষ হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পে ঘাস লাগানোর কাজ শুরুই হয়নি।

জামালগঞ্জের মোট পিআইসি ১০০টি। এখানে সব প্রকল্পে মাটির কাজ শেষ তবে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ হয়নি। হালির হাওড়ের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কালীবাড়ী ক্লোজারের মাটির কাজ শেষ করা হলেও দুর্মুজ-কমপেকশন সঠিকভাবে হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

জামালগঞ্জের হালির হাওড়ের কালীবাড়ি ক্লোজার, পাগনার হাওড়ের গজারিয়া ক্লোজার, মুচিবাড়ী ক্লোজার, বোগলাখালী ক্লোজার, শনি হাওড়ের নান্টুখালী ক্লোজার, ঝালখালী ক্লোজার, লালুর গোয়ালা ক্লোজারে এখনো জিওটেক্সটাইল দেয়া শেষ হয়নি। তবে দু-একদিনের মধ্যেই জিওটেক্সটাইল দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী নিহার রঞ্জন দাস।

জামালগঞ্জের ইউএনও শামীম আল ইমরান দাবি করেন, মাটির কাজ শেষ। অধিকাংশ বাঁধে ঘাসও লাগানো শেষ। জিওটেক্সটাইল দেয়ার কাজ দু-একদিনের মধ্যে শেষ হবে। সার্বিকভাবে ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে তার দাবি।
তাহিরপুর উপজেলার শনি ও মাটিয়ান হাওড়ের মোট প্রকল্প ৯৭টি। এর মধ্যে শনির হাওড়ের মাটির কাজ শেষ হয়েছে। মাটিয়ান হাওড়ের পুঁটিমারা ও বোয়ালামারা কম্পার্টমেন্টাল বাঁধসহ ১০টি পিআইসির কাজ এখনো চলছে। কোনো প্রকল্পেই ঘাস লাগানো শুরু হয়নি। এ উপজেলার বাঁধ ও ক্লোজারে জিওটেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়নি।

ধর্মপাশায় মোট পিআইসি ১৩৪টি। অধিকাংশ পিআইসির মাটির কাজ শেষ হলেও ঘাস লাগানো শুরু হয়নি একটিতেও। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে বাঁশ, বস্তা ও চাটাই সঠিকভাবে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

মধ্যনগরের চামরদানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকিরুল আজাদ মান্না অভিযোগ করেন, এখানকার দুটি হাওড়ে অধিকাংশ পিআইসির কাজ সঠিকভাবে হয়নি। বাঁধের গোড়া থেকে মাটি তোলা হয়েছে। সঠিকভাবে কমপেকশন ও স্লোপ দেয়া হয়নি।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মোট পিআইসি ৪১টি। বাঁধে ঘাস লাগানো হয়েছে চার ভাগের একভাগ। কোথাও এখনো মাটি ফেলার কাজ চলছে। তবে ক্লোজারগুলোয় বাঁশ, বস্তা ও চাটাইয়ের কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ।

দিরাই উপজেলার চাপতির হাওড়ের কালধর শিমের গাছ থেকে বৈশাখীর পশ্চিমের ভাঙা পর্যন্ত পাঁচটি পিআইসির মধ্যে মাত্র একটিতে মাটির কাজ শেষ হয়েছে। গত বছর বৈশাখীর যে বাঁধ ভেঙে হাওড়ে পানি ঢুকেছিল, সেটির মাটির কাজ শেষ হয়নি। একই উপজেলার কোনো বাঁধেই ঘাস লাগানোর কাজ শুরু হয়নি। কোথাও চলছে মাটির কাজ।

শাল্লা উপজেলার ১৮০টি প্রকল্প রয়েছে। জেলার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া কাজ এ উপজেলার। অধিকাংশ বাঁধের মাটির কাজ এখনো চলছে। কোনো বাঁধেই ঘাস লাগানো শুরু হয়নি।
পাউবো, সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (১) আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, সার্বিকভাবে ৮৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অন্যান্য কাজ চলমান থাকলেও সব বঁঁধ নির্মাণে মাটির কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। দ্রুত শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী (২) খুশি মোহন সরকার বলেন, দিরাই-শাল্লা, জগন্নাথপুরের হাওড়গুলোর পানি নেমেছে দেরিতে। তাছাড়া বাঁধের উপযুক্ত মাটি পেতেও বেগ পেতে হয়েছে। তার পরও তিন-চারদিনের মধ্যে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।

একই কারণ উল্লেখ করে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ পিআইসির কাজ শেষ। আমরা আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে