সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি

0
704

‘বান্দের (বাঁধ) দেড়-দুই মাইলের মধ্যে কোনও মাডি কাডার (কাটার) জায়গা নাই। খালি ক্ষেত আর ক্ষেত। কেউ ক্ষেত কাইট্টা মাডি তুলতো দেয় কেউ না। হাওরের ফানি (পানি) কমছে দিরং (দেরি) কইরা। মেশিন নরম মাডির উফরে চলে না। গাইরা (দেবে) যায়। মাডি তুলতো না ফারলে বান্দের কাম তাড়াতাড়ি করবো কিদ্দিয়া (কীভাবে)।’ এভাবেই তাহিরপুর উপজেলার মাতিয়ান হাওরের বোয়ালমারা ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে নানা সমস্যার কথা বলছিলেন খলাহাটি গ্রামের শ্রমিক সুজন মিয়া।

পাশেই মাটি ফেলার কাজ করছিলেন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নয়াহাটি গ্রামের নবী হোসেন। তিনি বলেন, ‘হাওরের মাডি অহনো নরম। মেশিন চলাচল করতে পারে না। ট্রাক্টর গাড়লে আরও একটি ট্রাক্টর দিয়া টাইন্না তুলন লাগে। এমনেই চলতাছে বোয়াল মারা বাঁধের কাজ।’ পাটলাই নদী তীরবর্তী এলাকায় বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করে মাটিয়ান হাওরের ফসলকে আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ডুবন্ত বাধ তৈরি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার।

নুতন কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) নীতিমালা অনুযায়ী গেল ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল বাঁধ নির্মাণের সর্বশেষ সময়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। পিআইসি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন জানা যায়, হাওর থেকে দেরি করে পানি নামা, মাটি সংকট, মেশিন সংকট আর শ্রমিক সংকটের কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে হাওর ও নদীর পানি সমান্তরাল ছিল। তাই বেশির ভাগ হাওরের পানি নামতে অন্যান্য সময়ের চেয়ে ২০/২৫ দিন বেশি লেগেছে। এজন্য বাঁধের আনুমানিক ব্যয়, নকশা ও প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরিসহ সবকিছুতেই সময় লেগেছে। তাই বাঁধের কাজ কমপক্ষে একমাস দেরিতে শুরু হয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রাধানগর গ্রামের বাঁধের শ্রমিক মো: লিটন মিয়া জানান, সারা জেলায় ৯ শতাধিক পিআইসি রয়েছে। ১০ পিআইসির বিপরীতে এসকেভটর রয়েছে ১টি। এছাড়া ঢাকা থেকে একটি মেশিন আনতে লাখ টাকা পরিবহন খরচ হয়। মেশিনের মালিক ও চালককে অগ্রিম কয়েক লাখ টাকা দিতে হয়। এসব কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরুতে গতি পায়নি। ফলে কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাঈয়ুম বলেন, ‘সরকার নতুন নীতিমালা করেছে বাঁধের দেড়শো-দুইশো ফুট দূরে থেকে মাটি কাটতে হবে। কিন্তু বাঁধের কাছে তো দূরের কথা, অনেক বাঁধের এক দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কাটার মত কোনও মাটি নেই। তাহলে বাঁধের কাজ হবে কীভাবে।’

মধ্যতাহিরপুর গ্রামের নারায়ণ বর্মণ বলেন, ‘এবার হাওরের বাঁধে মাটির দরকার পড়েছে বেশি। কিন্তু মাটি সংকট, মেশিন সংকট, শ্রমিক সংকটের কারণে বাঁধ নির্মাণের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোনও কোনও হাওরের মাটি এখনও শুকায়নি। তাই এসব এলাকা দিয়ে মেশিন ও ট্রাক্টর চলে না। কাজের গতি বাড়ে না। কারণ এক ট্রাক মাটি দূর থেকে এনে বাঁধে ফেলতে এক দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। যদি কোনও কারণে ট্রাক্টর দেবে যায় তাহলে এটি টেনে তুলতে আরও কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।’

তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের আব্দুর রহিম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস যদি সরকারি এস্কেভেটর ও ড্রাম ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে বাঁধ নির্মাণকাজের অনেক সুবিধা হতো। কারণ এমন পিআইসি রয়েছে নগদ টাকা দিয়ে তারা এসব মেশিনারিজ সংগ্রহ করতে পারেনি। আগামীতে যদি পাউবো এসব সাপোর্টের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে কাজ শেষ করতে কমিটিকে কোনও বেগ পেতে হবে না।’

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মর্কতা পুর্ণেন্দু দেব বলেন, মাটিয়ান হাওরে মোট ৪৯টি পিআইসি রয়েছে। এসব পিআইসি মধ্যে ৫/৭টি পিআইসির মাটির কাজ এখনও চলছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাটিয়ান হাওরের বোয়ালমারা অংশে পাটলাই নদীর পানি ফেব্রুয়ারি মাসে নেমেছে। অন্যদিকে বাঁধ এলাকায় পানি থাকায় হাওরের মাটি নরম ছিল। তাই যথা সময়ে কাজ শুরু করা যায়নি। এখন পুরো দমে কাজ চলেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন, ‘হাওরের পানি দেরিতে নিষ্কাশন ও মাটি সংকট, মেশিন সংকট, শ্রমিক সংকটের কারণে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ শুরু করা যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত জেলার সবকটি হাওরে গড়ে ৮১ শতাংশ কাজ হয়েছে।’ আগামী সপ্তাহের মধ্যে সব হাওরের কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে