মূল উদ্যোক্তাকেই তাড়িয়ে দেয় গ্রামীণফোন

0
417

শুধু প্রতারণা আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ নয়, মূল উদ্যোক্তাকেই জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে গ্রামীণফোন তথা তাদের মূল প্রতিষ্ঠান টেলিনর। ইকবাল কাদির নামের ওই ব্যক্তিই ছিলেন এই মোবাইল ফোন কোম্পানির স্বপ্নদ্রষ্টা। নিজে খুব বেশি টাকা দিতে না পারায় পেয়েছিলেন মাত্র ৪ দশমিক ৫ ভাগ শেয়ার। সেটাও শেষ পর্যন্ত থাকতে দেয়নি টেলিনর। তাকে পরিচালনা পর্ষদে তো নেয়াই হয়নি উল্টো তার শেয়ার কেড়ে নিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। ক্ষোভে দুঃখে দেশ ছেড়ে চলে যান ইকবার কাদির। টেলিনর গ্রুপ এই কাজ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর। টেলিনরের এই কাজে সায় ছিল ড. ইউনূসেরও।

শুধু ইকবাল কাদির নয়, শুরু থেকে গ্রামীণফোনে জাপানের মারুবিনি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছিল ৯ দশমিক ৫ ভাগ। তাদেরও এই ব্যবসায় থাকতে দেয়নি টেলিনর। এক পর্যায়ে ইকবাল কাদিরের সঙ্গে মারুবিনিকেও চলে যেতে হয়। সে সময় এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে শেখ হাসিনার কাছ থেকে লাইসেন্স পেলেও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর টেলিনরের প্রভাব বেড়ে যায় কয়েকগুন। তখন থেকেই তারা গ্রামীণফোনে একচ্ছত্র মালিকানা নিতে মরিয়া হয়ে উঠে।

ড. ইউনূস টেলিনরকে প্রাথমিক অবস্থায় কোম্পানিটিকে দাঁড় করানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এক সময় এই কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক হবে গ্রামের দরিদ্র নারীরা। কিন্তু টেলিনরের পুঁজির দাপটে কিছুই হয়নি। ড. ইউনূস তার শেয়ার ধরে রাখতে পারলেও কাদিরকে বিদায় নিতে হয় খালি হাতেই।

জানা গেছে, ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে প্রকল্পের প্রাথমিক ভাবনা ভাবনা দাঁড় করান যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা ইকবাল কাদীর। তিনি সে সময় ছিলেন এটরিয়ারম ক্যাপিটালের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। দেশে ফিরে কিছু একটা করার পরিকল্পনায় হাত দেন তিনি। সেলফোন হতে পারে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধের লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার—এটা তারই ভাবনা। ড. ইউনূস যখন ওহাইয়োতে সম্মানসূচক ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলেন, তখন তার কাছে নিজের এ ভাবনার কথা তুলে ধরেন ইকবাল কাদীর। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে দু’জনের মধ্যে আবার দেখা হয়। ইকবাল কাদির কীভাবে তারবিহীন ফোন বাংলাদেশে উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে পারে সে চিন্তা তুলে ধরেন অধ্যাপক ইউনূসের কাছে।

শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করলেও ১৯৯৪ সালে কাদিরের লিখিত পরিকল্পনা পাওয়ার পরে তিনি নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু প্রাথমিক লগ্নি করার জন্য তেমন একটি আগ্রহ দেখালেন না। কিন্তু কাদির ছিলেন নাছোড়বান্দা। নিজের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে আবারও ফিরে গেলেন নিউইয়র্কে। মার্কিন এক ধনী ব্যক্তিকে বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন গণফোন। কিছু অর্থ হাতে আসার পর তিনি ফিনল্যান্ডের টেলিকন কোম্পানিকে পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এই পরামর্শক কোম্পানির মাধ্যমে স্ক্যান্ডনেভিয়ান দেশগুলোর সেলফোন অপারেটদের সম্পর্কে নেটওয়ার্ক স্থাপন। ১৯৯৪ সালের শেষদিকে তিনি সুইডিশ কোম্পানি টেলিয়া, গণফোন ও গ্রামীণ ব্যাংকের একটি কনসোর্টিয়াম স্থাপন করতে সফল হলেন।

পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ সরকার নতুন লাইসেন্স এর জন্য দরপত্র আহবান করলেই তাতে অংশগ্রহণ করা। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা হলে একটি লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেওয়া হবে। যে প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে টেলিফোন অপারেটর হিসাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে। পাশাপাশি আরেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান খোলা হবে, যারা এই কোম্পানির কাছ থেকে পাইকেরি দামে কথাবলার সময় কিনে তা গ্রামের দরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কাছে ফোন ও কল সময় বিক্রি করবে। অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে গ্রামীণ টেলিকম। কিন্তু ছয় মাস পর টেলিয়া এই কনসোর্টিয়াম থেকে নিজেদের থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কাদীরের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় রাজি হলো টেলিনর। কিন্তু পুঁজি জোগানের লড়াইয়ের টেলিনরের কাছ হার মানলেন সকলেই। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের লগ্নিতে ৫১ ভাগ শেয়ারের মালিক হলো টেলিনর, ৩৫ ভাগ গ্রামীণ টেলিকম, ৯ দশমিক ৫ ভাগ জাপানের মারুবিনি আর ৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার দিয়ে মাত্র ৪ দশমিক ৫ ভাগ শেয়ারের মালিক হলেন মূল উদ্যোক্তা ইকবাল কাদীরের গণফোন।

এত অল্প শেয়ারে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে জায়গা হলো না তার। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ গ্রামীণ তার যাত্রা শুরু করে। প্রথম বছর ৭০ লাখ ডলার, পরের বছর ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার লোকসান হয় গ্রামীণফোনের। ২০০০ সালের পর থেকে সাফল্যের মুখ দেখতে থাকে। সে বছর প্রতিষ্ঠানটি ৩০ লাখ ডলার মুনাফা করে। ২০০১ সালে দেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকের ৬৯ শতাংশ চলে যায় গ্রামীণফোনের দখলে। ২০০২ থেকে ২০০৪ এ শুরু হয় টেলিনর ও গ্রামীণ টেলিকমের নিয়ন্ত্রণের লড়াই। এই পরিস্থিতিতে ইকবাল কাদির ও মারুবিনি তাদের অংশের শেয়ার ছেড়ে দিয়ে কোম্পানি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন। পুরো শেয়ার চলে যায় টেলিনরের হাতে।

২০০৬ সালে ড. ইউনুস প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে টেলিনরের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, কনসোর্টিয়ামের সমঝোতা চুক্তিতে টেলিনর ৬ বছরের মধ্যে তাদের শেয়ার ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে-এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল। আর এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের যে কোন পক্ষের শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে প্রাথমিক আপত্তি জানানোর অধিকার পাবে গ্রামীণ টেলিকম। কিন্তু সমঝোতা চুক্তি মেনে শেয়ার ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে অস্বীকৃতি জানায় টেলিনর। এ নিয়ে উভয় পক্ষে বাকবিতণ্ডা এবং চিঠি চালাচালি হলেও, টেলিনর গ্রামীনফোনে নিজেদের নিয়ন্ত্রন ছাড়েনি।

গত ১৫ বছরের এসব পুরনো দলিল ও কাগজপত্র পরীক্ষা করে টেলিনরের এসব প্রতারণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান মামুন উর রশিদ তখন বলেছিলেন, সে সময় গ্রামীণ কনসোর্টিয়ামকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল সরল বিশ্বাসে। লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় যোগ্যতার বিচারে বাদ পড়েছিল টেলিনর। তারপরও তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয় এবং তারা যথারীতি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে সবার সঙ্গেই।
ইত্তেফাক/নূহু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে