সকাল থেকে এক ধরনের সাঁজ সাঁজ রব। জাহাজ পোর্টে যাচ্ছে ৩ দিন নোঙরে অপেক্ষা করার পর। সকালেই জানানো হয়েছে সাড়ে তিনটায় পাইলট, সাতটায় বার্থিং। মনে মনে অনেকে বাইরেও ঘুরতে চলে গেছে। কিছু সাপ্লাই আসবে, তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের বার্থিং সন্ধ্যায়, যাতে তারা সব আগামীকাল আসে। কিছু ইকুইপমেন্ট ক্যালিব্রেশনের কাজ আছে। বাৎসরিক ভাবে এটা করতে হয়, নাহলে মেয়াদোত্তির্ন।
টেকনিশিয়ান এসে এসব চেক করে এক বছরের সার্টিফিকেট দিয়ে যাবে। জাহাজে ফায়ার ফাইটিং এর জন্য ফায়ারম্যানরা ব্রিদিং এপারেটাস ব্যাবহার করে। এর জন্য প্রচুর এয়ার বোতল আছে। এসব চার্জ করে রাখতে হয় গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডারের মত। এজন্য রয়েছে এয়ার কমপ্রেসর। এ কম্প্রেসরের আবার এয়ার কোয়ালিটি টেস্ট করতে হয় প্রতি বছর। সেটা টেস্ট করার জন্যও লোক আসবে। এরকম অনেক কিছু লাইন আপ করা।দুপুরের আগেই বন্দরে যাওয়ার ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে গেল। যে জাহাজ জেটিতে আছে, তার লোডিং শেষ
হলেই আমরা যেতে পারব, কিন্তু তার নড়াচড়ার কোন লক্ষ্মণ দেখা গেল না। পোর্ট গতবাধা উত্তর দিতে লাগল যে পাইলট তোলার জন্য তিন ঘন্টা নোটিশ দেবে। পাইলট তুলতে হলে আমাদের প্রস্তুতি দরকার দু ঘন্টার। আধা ঘন্টায় ইঞ্জিন প্রস্তুত, আধা ঘন্টা নোঙর তুলতে, বাকিটা পাইলট গ্রাউন্ডে যেতে। একটু তাড়াহুড়া করলে দেড় ঘন্টায়ও করা যায়। লাঞ্চের পর একটু গড়াগড়ি, কখন ডাক আসবে কে জানে। তিনটা বাজেও যখন ডাক এলনা, নিশ্চিত হয়ে গেলাম আজকে আর ভেতরে যাওয়া হবে না। এমন সময় উইলিয়ামের ফোন, আমাদের ভেতরে নেবার চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে অন্য একটা জেটিতে। কিন্তু সে জেটিতে আমরা ফুল কার্গো লোড করতে পারব কিনা সেটা জানতে চাচ্ছে।
বললাম আমিতো জেটির মালিক নই যে আমি বলব। এটা টার্মিনালকে জিজ্ঞেস করো ওদের ওখানে গভীরতা কত এবং লোড করতে পারব কিনা।
ক্যাপ্টেন সেটাই সমস্যা, পোর্ট শুধু চ্যানেলের গভীরতার গ্যারান্টি দেয়, জেটির না। জেটির পাশে পানি কতটুকু গভীর তার একটা সার্ভে রিপোর্ট এজেন্ট পাঠিয়েছে, শুধু এতটুকুই আছে আমার কাছে।
বললাম সেটা আমাকেও পাঠিয়েছে, এবং সেটা আমার কাছে মূল্যহীন। রিপোর্টের নীচে লিখা আছে এর গভীরতা যে কোন সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে, এ জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন দায়ভার বহন করবে না। রিপোর্ট অনুযায়ী গভীরতা পর্যাপ্ত হলেও কয়েকটি স্পটে পানি একটু কম, সে হিসেবে জাহাজের তলা মাটিতে লেগে যাবে। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী জাহাজের নীচে ন্যূনতম ২ ফিট পানি থাকতে হবেই। সুতরাং আমি আইন মেনে লোড করতে পারিনা।
এমেরিকান এসব প্রাইভেট পোর্টগুলোর এক অদ্ভুত অবস্থা, বিশেষ করে নূতন নূতন যেসব টার্মিনাল হয়েছে। যে কোম্পানি অপারেট করে, তারা এর গভীরতা রক্ষা করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু চ্যানেলের গভীরতা বজায় রাখে। রাজউক যেমন প্রধান সড়কের দেখভাল করে, হাউজিং এর ভেতরের দায়িত্ব আবাসন কোম্পানির। আর হাউজিং কোম্পানির অবস্থা সেই খাটি সরিষার তেল দেয়া এশিয়ান হাউজিং এর মতই, ভাবখানা হলো আমাদের যা আছে তাই, পারলে ব্যাবহার করো। উইলিয়াম বেচারা পেরেশান, যে জাহাজ ভাড়া করেছে সে বলছে ক্যাপ্টেনরে জিজ্ঞেস করো, ক্যাপ্টেন বলছে আমি কিছু জানিনা। এদিকে বিপি আমাদের গুরুত্বপুর্ন ক্লায়েন্ট, পর পর তিন ট্রিপ ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম ভাড়া করেছে আমাদের। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি জানি গভীরতা হয়ত ঠিক আছে, কিন্তু কোন ভ্যালিড ডকুমেন্ট ছাড়া আমি বলতে পারিনা যে পারব।
আমি গনি মিয়াঁ, নিজের জমি নাই, অন্যের জমি চাষ করি। মানে আমি উবার ড্রাইভার, গাড়ি মালিকের। মালিক কাস্টমার যোগার করছে। কাস্টমার হলো এক বড় কোম্পানি, তাদের মাল উঠাতে হবে এক গেরাম থিকা, সেখানে কাঁচা রাস্তা আছে। এখন আমার মালিক বলতাসে তুমি এই ট্রাক নিয়া পাঁচ টন মাল ভরে আসতে পারবে কিনা।
আমি বললাম রাস্তা শক্ত কিনা সেটা আমি কেমনে জানব। যে ভাড়া করছে তাদের জিজ্ঞেস করো। মালিক উইলিয়াম বলে ওরা জানেনা, ওরা মাল কিনছে যে লোকের কাছ থিকা সে জানেনা তার রাস্তা পাঁচ টন ট্রাকের উপযুক্ত কিনা, খালি রাস্তার ছবি দিছে, মাটি কত শক্ত বলার উপায় নাই। এ হলো আমার অবস্থা।
উইলিয়ামকে বললাম, আমি একটা কাজ করতে পারি। আমি জাহাজ নিয়ে যাব। নিজে গভীরতা মেপে দেখব। তার উপর ভিত্তি করে জানাবো আমি লোড করতে পারব কিনা, এর চেয়ে বেশী কিছু করার নেই। জাহাজের নীচে পানির গভীরতা মাপার জন্য ইকো-সাউন্ডার থাকে। জাহাজের সামনে পেছনে দুটো ট্র্যন্ডিউসার লাগানো থাকে, এখান থেকে শব্দ ট্র্যান্সমিট করা হয় নিচের দিকে। এর প্রতিধ্বনি ফিরে আসতে কতটা সময় লাগে সেটা হিসাব করে মাপা হয় গভীরতা কত। কিন্তু এটা শুধু দুটো পয়েন্টের গভীরতা বলতে পারে, মাঝে যদি কোন চর থাকে বলার উপায় নেই। তদোপরি এটা শুধুই একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র, এর এরর থাকতে পারে, গ্যারান্টি নেই। যখন এমন জেটির ব্যাপার আসে, তখন সেই আদিকালে চলে যেতে হয়, এক বাও মেলে না…। লগি দিয়ে পানির গভীরতা মাপতে হয়। কিন্তু ৬০-৭০ ফিট লম্বা লগি তো আমাদের নাই, চেতনার সৈনিক আর সোনার ছেলেরা সব লগি বৈঠা নিয়ে গেছে। আমাদের আছে হ্যান্ড লেড লাইন। একটা রশির মাথায় ভারী সীসার ওজন লাগানো, সেটা পানিতে নামিয়ে দেই। তারপর উপর থেকে বুঝার চেষ্টা করি কখন সেটা মাটিতে লাগল। এরপর টেনে উপরে তুলে দেখি রশি কতটা ভিজে আছে, সেটাই পানির গভীরতা।
উইলিয়াম মনে হয় হাতে স্বর্গ পেল। ঠিক আছে ক্যাপ্টেন, এটা মনে হয় সবচেয়ে ভালো। আমি বিপিকে বলি।
জানি ভালো, তবে এভাবে চলবে না, লিখিত লাগবে। আমি মেইল পাঠাচ্ছি, সেখানে সব লিখে দেব। তুমি সেটা ওদের পাঠিয়ে আলাপ করো। ওরা আমার শর্তে রাজি হলে আমি যাবো। অন্যথা আমি কোন নিশ্চয়তা দেবনা কতোটা লোড করতে পারব।
মেইল করে দিলাম যা আমার কাছে জেটির গভীরতার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। যে সার্ভে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে, সে অনুযায়ী কয়েক জায়গায় গভীরতা কম দেখাচ্ছে, আর রিপোর্টেই লিখা আছে গভীরতা হেরফের হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন দায়ভার নেবেনা। সেক্ষেত্রে আমি জাহাজ ভেড়ানোর পর লেড-লাইন দিয়ে মেপে দেখব। যে গভীরতা পাই, তার ভিত্তিতে জানাব কত লোড করতে পারব।
কিছুক্ষণ পর মেসেজ চলে এল জাহাজ ভেতরে যাবে, নূতন জেটিতে, পাইলট রাত সাড়ে ন’টায়। দুপুর থেকেই ক্রুদের ছুটি দেয়া ছিল। কারন বন্দরে যাওয়া মানে হুলুস্থুল, সবাই ব্যাস্ত হয়ে যাবে। সন্ধ্যা সাতটায় জানান হলো পাইলট ন’টায় আসবে, তাই সাড়ে সাতটায় নোঙর তুলে রওনা দিলাম, কাঁটায় কাঁটায় ৯’টায় পাইলট অন-বোর্ড, যাত্রা শুরু যাত্রা বাড়ি।
এবার যাচ্ছি করপাসের একটু ভেতরে। করপাস বিল থেকে নদীতে ঢুকার মুখেই একটা ব্রিজ, আর ব্রিজ পার হলেই আমার পার্কিং। পাইলটকে বললাম আমরা ব্রিজের আগে জাহাজ উলটা ঘুরিয়ে ব্যাক গিয়ারে পিছনে যাব?
নাহ ক্যাপ্টেন, ব্রিজ পার হয়েই গাড়ি ঘুরাব।
বলো কি? নদী কতোটা চওড়া।
৮০০ ফিট।
ধুর মিয়াঁ, আমাদের গাড়িই তো আটশ ফিট, ঘুরবে কেমনে?
ভয় পাইয়ো না, এটা হলো গভীর চ্যানেলের প্রস্থ, এর বাইরে টার্মিনালের জায়গা আছে, জাহাজ ঘুরে যাবে।
এক পাইলট আগের পরিচিত, বৃদ্ধ মানুষ। সে জাহাজ ভেড়াবে বা বার্থিং করবে। খুবই হাসি খুশী মজার একজন মানুষ। সে হাসতে হাসতে বলতেছে তুমি বেশী টেনশন নিয়ো না, কারন আমি নিজেই টেনশনে অস্থির। জাহাজ ব্রিজ পার হবার পর ঘুরানো হলো, সামনে পিছনে দুই টাগ আসল কাজটা করল, সাথে আমাদের ইঞ্জিন। আমার মনে হয় না পৃথিবীর কোন পোর্টে এরকম পাগলামি করা হয়। এমনকি পানামা ক্যানেলেও এরকম উদ্বিগ্ন হইনি। কিন্তু জাহাজ ঘুরানো হয়ে গেল খুব আয়েশে। জাহাজ ঘুরানোর পর পাইলট কে বললাম, আসলে খুবই সুন্দর ঘুরে গেছে, আমার একটুও ভয় লাগে নি।
পাইলট হেসে বলল, আমার লাগছে, এবং প্রতিবার ঘুরানোর সময়েই লাগে।
জাহাজ বাঁধা হতে হতে মধ্যরাত। এবার টার্মিনালের লোকজন আসার পালা, লোডিং এর প্রস্তুতি। আজকের মত শুভরাত্রি। ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪