আদি বুড়িগঙ্গার স্রোতধারা বাস্তবে প্রায় বিলীন

0
34

বুড়িগঙ্গা নদীরই একটি পুরনো স্রোতধারা বাস্তবে প্রায় বিলীন। পুরনো মানচিত্র ঘাঁটলে ইতিহাসের ছাত্ররা এখনো খুঁজে পাবে আদি বুড়িগঙ্গার পথরেখা। তবে তিন বছর আগে ঢাকা জোনাল সেটলমেন্ট যে নকশার খসড়া করেছে, তা চূড়ান্ত হলে সেই সম্ভাবনাও ঘুচে যাবে বলে আশঙ্কা নদীসংশ্লিষ্ট আরেকটি সরকারি সংস্থার।

১৯২৪ সালের মানচিত্রে পূর্ণরূপে দেখা মেলে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের। চর কামরাঙ্গী, চর ইউসুফ তখন বিচ্ছিন্ন জনপদ। চ্যানেলের প্রশস্ত দিকটা বুড়িগঙ্গার সঙ্গে, অন্য দিকটা সরু হয়ে এঁকে-বেঁকে ধলেশ্বরীতে গিয়ে পড়েছে। ১৯৪৩ ও ১৯৬৭ সালের মানচিত্রেও চ্যানেলটির স্রোতধারা মোটামুটি একই রকম দেখা যায়। এরপর ২০১০ সালের মানচিত্রে চ্যানেলের প্রায় অর্ধেকটাই অস্পষ্ট, যা ২০১৭ সালে এসে ক্ষীণ একটি রেখায় রূপ নেয়।
নির্বিচার দখলের কারণে আদি বুড়িগঙ্গা যেখানে থমকে গেছে, সেটিকে শেষ সীমানা ধরে একটি খসড়া নকশা তৈরি করেছে ঢাকার জোনাল সেটলমেন্ট অফিস। তবে গত বছর নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক জরিপ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) খসড়া নকশায় দেখিয়েছে, চ্যানেলটি ওখানে শেষ হয়ে যায়নি, বরং দুটি ধারায় ভাগ হয়ে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিশেছে।
২০১৫ সালের আগস্টে এক রায়ে হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীর চর এলাকায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সরেজমিন সীমানা নির্ধারণ ও নকশায় সীমানা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরপর সিএস, আরএস ও মহানগর জরিপের নকশার আলোকে সুপার ইম্পোজড ম্যাপ তৈরি করে আদি চ্যানেলের অবস্থান সরেজমিন চিহ্নিত করে ঢাকার জোনাল সেটলমেন্ট অফিস। তারা কেল্লার মোড়ে লোহার ব্রিজ থেকে উত্তরে সাড়ে তিন কিলোমিটার ও দক্ষিণে সাড়ে তিন কিলোমিটার চ্যানেলটির প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘কালুনগর মৌজার মাহাদীনগর সিটি পর্যন্ত এসে চ্যানেলটির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে বিধায় বন্ধ স্থান থেকে বুড়িগঙ্গা নদীসহ ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চ্যানেলটির প্রবাহ বিদ্যমান নেই।’
চ্যানেলটির পথচলা এখন যেখানে থেমে গেছে, তার নিরিখে নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেলে আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ আইনগত প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানালেন বিআইডাব্লিউটিএর সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক।
তবে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল সরেজমিন পরিদর্শন করে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে বিআইডাব্লিউটিএর একটি টিম। এতে বলা হয়েছে, কালুনগর মৌজা থেকে আরো একটি চ্যানেল ডানদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ ও উত্তর সোনাটেঙ্গর, রাজমুশুরী, সুলতানগঞ্জ, বারৈখালী ও শ্রীখণ্ড মৌজার ওপর দিয়ে বুড়িগঙ্গায় মিলেছে। এ ছাড়া কালুনগর, শিকারীটোলা, শিবপুর ও উত্তর সোনাটেঙ্গর মৌজার সংযোগস্থল থেকে আরেকটি চ্যানেল বাঁ দিকে (পশ্চিম) প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। ওই চ্যানেলের ওপর এখন একটি বক্স কালভার্ট রয়েছে।
দুটি চ্যানেল চিহ্নিত করে তাদের খসড়া নকশা আদালতে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান কমোডর মোজাম্মেল। সংস্থার প্রধান হিসেবে চার বছরের দায়িত্ব শেষ করে নৌবাহিনীতে ফিরে যাওয়ার আগে গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, লোহার ব্রিজ থেকে বসিলা পর্যন্ত আদি চ্যানেলের দৈর্ঘ্য সাড়ে ছয় কিলোমিটার। বন্দর সীমানা লোহার ব্রিজ পর্যন্ত। এর পরে জেলা প্রশাসনের এখতিয়ার। নদীর অংশে রাস্তা তৈরি হয়েছে, বড় বড় হাসপাতাল, কারখানা হয়েছে।
যারা বরাদ্দ দিয়েছে, জমি উদ্ধারের উদ্যোগ তাদের নিতে হবে। আর যদি আদালতের আদেশে পোর্ট লিমিটের ভেতরে দিয়ে দেয়, তাহলে বিআইডাব্লিউটিএ উদ্ধারকাজ করতে পারবে। এ বিষয়ে তাদের প্রাথমিক জরিপ করা আছে। সিএসের আলোকে আদি চ্যানেলের হারিয়ে যাওয়া অংশ যাতে নকশায় অন্তর্ভুক্ত হয় সে লক্ষ্যে তারা আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি। এরই মধ্যে আইনজীবীর সঙ্গে তাঁদের কথাও হয়েছে।

দোষ এখন বেড়িবাঁধের!

১৯৮৭-৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকা শহর রক্ষার জন্য কেল্লার মোড় থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তীর ঘেঁষে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কাজ শেষ হয় ১৯৯০ সালে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) করা এই বাঁধের ওপর দোষ চাপানো হয়েছে ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনে।
অধিদপ্তরের স্পেশাল সার্ভে টিমের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর আদি চ্যানেল অনেকাংশে ভরাট হয়ে গেছে এবং কোথাও কোথাও সিটি করপোরেশন কর্তৃক রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁধের পাকা অংশ ছাড়া অন্যান্য অংশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অস্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছে এবং বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী দোকানপাটও রয়েছে। নির্মিত হয়েছে হাসপাতাল, মসজিদ।
কিছু কিছু এলাকায় সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় বাসিন্দারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলছে। এতে করে প্রবাহমান ফোরশোর প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে।’ এতে মন্তব্য করা হয়, আদি চ্যানেলের প্রবাহমান অংশ ও ভরাট অংশের মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি থাকায় সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন হবে।
তবে ১৯৫০ সালের স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট (এসএটিএ) অনুসারে নদীর জমি ব্যক্তিমালিকানায় যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই বলে জানান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার। আইনের ধারা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘নদীর জমি শাশ্বত, নন-ট্রান্সফারেবল। শুকিয়ে গেলেও নদীর জমি রাষ্ট্রের। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যাবে না’

চলছে দখলমুক্তির অভিযান

২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর অপমৃত্যু রোধ করে ঢাকা মহানগরকে রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নদীর মধ্যে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পাশাপাশি জরিপ কাজের পর সীমানা নির্ধারণ করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার নির্দেশও ছিল। ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। জানুয়ারির শেষ দিকে বিআইডাব্লিউটিএ শুরু করেছিল আদি চ্যানেল দখলমুক্তির অভিযান। চার দফায় বহুতল ভবনসহ প্রায় দেড় হাজার অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করেছে সংস্থাটি।
পাউবো বেড়িবাঁধের দুই পাশে তাদের অধিগ্রহণ করা জমি থেকে ১৪১টি স্থাপনা সরিয়েছে। পাউবোর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘এ দফায় আমরা চার দিন অভিযান চালাব। দু-এক দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় দফা শুরু করব।’ তিনি জানান, অভিযান চলবে গাবতলী থেকে কেল্লার মোড় পর্যন্ত। ওই ১০ কিমি এলাকায় ৮৩৯ অবৈধ স্থাপনা তাঁরা চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো সরানো হবে এবারের অভিযানে।
এর আগে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও। কেরানীগঞ্জের মীর চাদেরবাগ এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে ৩৩টি ডকইয়ার্ড সরানো হয়েছে। পর্চা, ম্যাপ, দলিলপত্র যাচাই করে ধলেশ্বরীতে স্থাপিত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও অপসারণ করে কমিশন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে