ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহাসিক টাউন খাল রক্ষায় নোঙর’র ৫ দফা দাবিতে মানববন্ধন

0
205

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টাউন খাল রক্ষার দাবিতে ‘নোঙর’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার আয়োজনে মানববন্ধনের মাধ্যমে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।

শনিবার সকাল ১১ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টি এ রোডে ঘোড়াপট্টির ব্রিজের উপর ‘নোঙর’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা শহরের টাউন খাল রক্ষার ৫ দফা দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করে। ‘নোঙর’ এর কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন শামস এ মানববন্ধনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গসহ ‘নোঙর’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার রাজঘাট ইউনিট, কালাইশ্রী পাড়া ইউনিট, কান্দিপাড়া ইউনিট, সুহিলপুর ইউনিট এবং খৈয়াসার ইউনিটের সাথে সাধারণ জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এই মানববন্ধনে সংহতি ও সমর্থন প্রকাশ করেন স্থানীয় এমপি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান লায়ন ফিরোজুর রহমান ওলিও তার বক্তব্যে বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক খাল। এটি আমরা নিজেরাই ধ্বংস করে দিচ্ছি। এমপি সাহেবের একার পক্ষে এই খাল রক্ষা করা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রশাসনই পারে এই খাল রক্ষার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘নোঙর’ কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন শামস বলেন, সারাদেশে নদী ও খাল রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনিক কিছু কর্মকর্তাদের কারণে খাল পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। এই বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সাধারণ জনগনকে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

‘নোঙর’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার সভাপতি শামীম আহমেদ লিখিতভাবে ৫ দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, শহরের এই ঐতিহ্যবাহী টাউন খাল রক্ষার দাবিতে আমি আবারও সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। আমি আজকের এই মানববন্ধন থেকে ৫ দফা দাবি তুলে ধরছি__

১. খালের সীমানা নির্ধারণ ও পিলার স্থাপন।

২. দখলদারদের তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদ।

৩. নদীর গভীরতা সমান খাল খনন ও নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা।

৪. সিসি ব্লক অপসারণ ও রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ।

৫. দুই পাড়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধন।

তিনি আরো বলেন, এই বিষয়ে কাজ করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং নদী কমিশনের একটি কমিটি রয়েছে। আমি অতিসত্বর তাদের কার্যকর ভূমিকা ও পদক্ষেপ আশা করছি।

এর আগে মানববন্ধনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডঃ আবু সাঈদ খাল সুরক্ষার বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। এই খালকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন জেলা খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন সরকার, সাংবাদিক দীপক চৌধুরী বাপ্পী, সাংবাদিক ও আবৃত্তিশিল্পী মনির হোসেনসহ একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ।

এছাড়াও মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি ইব্রাহিম খান সাদাত, সুজনের সদর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক মোশারফ হোসেন, পিস ভিশন সভাপতি এড. জাহাঙ্গীর শেখ, শিল্পী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি শফিকুল ইসলাম তৌসির, কমরেড নজরুল ইসলাম, নোঙর জেলা সাধারণ সম্পাদক খালেদা মুন্নী।

নোঙর’র ৫ দফার দাবিতে সংহতি প্রকাশ করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আহবায়ক আবদুন নূর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ আকরাম হোসেন, জেলা নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা রতন কান্তি দত্ত, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক পরিষদের সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা দেলোয়ার, সমাজ কর্মী ও সাংবাদিক সুমন রায়, প্রথম আলো জেলা প্রতিনিধি শাহাদাত হোসেন, ডেইলি স্টার জেলা প্রতিনিধি মাসুক হৃদয়, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম, বিডি ক্লিন এর সমন্বয়ক সোহান মাহমুদ, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিকুল ইসলাম, আইনজীবি শফিকুল ইসলাম, লেখক রোকেয়া রহমান, কমরেড নজরুল ইসলাম, ইউনেস্কো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার ফারুক, অঙ্কুর শিশু-কিশোর সংগঠনের সদস্য জয়নাল আবেদীন, লেখক ও গীতিকার গাজী তানভীর আহমদ, সাংবাদিক ফরদাদুল ইসলাম পারভেজ, তোফাজ্জল হোসেন জীবন, মাদক মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংগঠনের সভাপতি মাহফুজুর রহমান পুষ্প, স্পার্ক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সভাপতি শাহাদত হোসেন, প্রাউড অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি কোহিনুর আকতার, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাথী চৌধুরী, ভরসা সভাপতি আলমগীর হোসেন, নোঙর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সদস্য ও মানববন্ধন বাস্তবায়ন উপকমিটির আহবায়ক কামরুজ্জামান খান টিটু, মনিরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, শিপন কর্মকার, সোহেল খান প্রমূখ। মানববন্ধন পরিচালনা করেন নোঙর জেলা সদস্য নির্জয় হাসান সোহেল।

উল্লেখ যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় খালটিকে শহরবাসী ‘টাউন খাল’ নামেই চেনেন। প্রতিনিয়ত আবাসিক বাসিন্দাদের ময়লা আবর্জনা ছাড়াও বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরা এবং আশপাশের একাধিক বাজারের বর্জ্য ফেলায় টাউন খালটি দিন দিন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। এতে খালটি সংকোচিত হয়ে ক্রমেই বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষের অযত্ন ও অবহেলায় খালটি আবর্জনার স্তূপে পরিণত হলেও দেখার যেন কেউ নেই। স্থানীয় এমপি, পৌরসভা মেয়র এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাগণ খাল সুরক্ষার ব্যাপারে বছরের পর বছর ধরে শুধু প্রতিশ্রুতির কথাই শুনিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় সচেতন বাসিন্দা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর।

শহরের টানবাজার ও কান্দিপাড়া এলাকা দিয়ে তিতাস নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে খালটি শহরের কাজীপাড়া, মধ্যপাড়া, পৈরতলা, ছয়বাড়িয়া ও গোকর্ণঘাট গ্রামের পাশ দিয়ে আবার তিতাস নদীতেই গিয়ে মিলিত হয়েছে। এক সময় এই খালের পানিতে গোসল করতেন খালপাড়ের আশপাশের বাসিন্দাগণ। বর্ষাকালে এই খাল দিয়ে যাত্রী এবং পণ্যবাহী নৌকা ও লঞ্চসহ চলাচল করতো একাধিক বাহারি নৌকা। একসময় শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকা দিয়ে পণ‌্য এনে এই খালের টান বাজার এলাকায় নৌকা বেড়াতেন। এখন আর খালের আগের জৌলুস নেই। খালটি এখন মৃতপ্রায়। এই খালে এখন আর নৌকা চলে না। ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধের কারণে এখন কেউ আর গোসলও করে না।

জানা যায়, খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় চার দশমিক ৮০ কিলোমিটার। তবে জেলা পরিষদের মানচিত্র ও খতিয়ান অনুযায়ী ২০৫ ও ২৬২ দাগে খালের আয়তন আট দশমিক ৩৫ একর। খালটি জেলা পরিষদের হলেও এর গভীরতা ও প্রশস্ততার কোনো হিসাব জেলা পরিষদের কাছ থেকে পাওয়া যায় নি। পৌরসভার উদ্যোগে ২০০৮-২০১২ সাল পর্যন্ত সৌন্দর্য বর্ধনের নামে শহরের কান্দিপাড়া এলাকা থেকে ঘোড়াপট্টির পুল (ফকিরাপুল) পর্যন্ত খালের দুই পাড়ে সিসি ব্লক, ফুটপাত ও রেলিং স্থাপন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক যে, সৌন্দর্যবর্ধনের পরে জেলা পরিষদ কিংবা পৌরসভার কেউ আর এই খালের পরিচর্যা কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার এক প্রকৌশলী জানান, একসময় শহরের খালের গভীরতা ছিলো ২২/২৩ ফুট। কিন্তু আবাসিক এলাকা, খাবার হোটেল ও বাজারের পরিত্যক্ত বর্জ্যের কারণে এখন প্রায় ১৫ ফুট হয়ে গেছে। আর মধ্যপাড়া থেকে সরকারপাড়া পর্যন্ত খালের গভীরতা আছে প্রায় ৮-১০ফুট। প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরা ও বাজারের বর্জ্য এনে খালের মধ্যে ফেলা হয়। এছাড়া শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ২০টি ড্রেনের সঙ্গে রয়েছে খালটির সংযোগ। ড্রেন দিয়েও প্রতিদিন প্রচুর ময়লা এই টাউন খালে এসে পড়ে।

অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক সংগঠক ও কণ্ঠশিল্পী হৃদয় কামাল জানান, প্রায় ৫ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের উদ্যোগে ও গত প্রায় দুই বছর আগে জেলা পরিষদের উদ্যোগে খালের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছিলো। এরপর আর খালে কোন সংস্কার বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে