আবার ভাসার সময় হল-৬

0
39
করোনা কালে নাবিকের সমুদ্রযাত্রায় ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ

করোনা কালে নাবিকের সমুদ্রযাত্রা : ৬

ঘুমিয়েছিলাম অনেক রাতে, সকালে ঘুম ভাঙল টেলিফোনের আওয়াজে। ঘুমন্ত অবস্থায় অন্ধকারে হাতরিয়ে রিসিভার পেতে পেতে কল কেটে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ৬:১৫। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ভুলে কেউ ডায়াল করেছে, এত সকালে কোন ফোন আসার কথা না। চোখ বন্ধ করে পরে রইলাম, কিন্তু কিছুক্ষন পর আবার বেজে উঠল ফোন, রিসেপশন। সাড়ে সাতটায় উইলিয়াম মরিস আসবে পিক আপ করতে, কভিড টেস্ট। মানে আজকেই জাহাজে উঠতে হবে। শুয়ে শুয়ে মাথার ভেতরে পায়চারি করলাম, কিছুক্ষন ফেসবুক আর হোয়াটসএপ মেসেজ চেক করে বাকি সময়টা কাটিয়ে প্রস্তুত হয়ে নীচে পৌঁছে গেলাম লবিতে। গিয়ে দেখি শুক্রবার হিউস্টনে আমরা যে চারজন এসেছিলাম, তার পরে আরও দুজন এসেছে, মানে মোট ছয়জন যোগদানকারী।

ফিলিপিন থেকে এসেছে চীফ অফিসার, আর মালায়শিয়া থেকে ট্রেইনি ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। নুতন দুজনের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে গাড়ি চলে এল, রওনা দিলাম ক্লিনিকের দিকে।প্রায় ৮০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পৌঁছলাম একটি ক্লিনিকে, কিন্তু তখনও ক্লিনিক খোলেনি। ড্রাইভার ফোন করল ক্লিনিকের কাউকে, বলল আমি মাইকেল বলছি উইলিয়াম মরিস থেকে। শুনে অবাক হয়ে গেলাম, মাইকেল মানে উইলিয়াম মরিসের কর্নধার।

উইলিয়াম মরিস হিউস্টন শিপিং জগতে বেশ উল্লেখযোগ্য নাম। হিউস্টন এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারদেরও দেখেছি ফোনে যখন মাইকেলের সাথে কথা বলে, বেশ বিনয়ের সাথে বলে এবং কথা শেষ করার সময় স্যার বলেই সম্বোধন করে। জাহাজের নাবিকদের সাইন অফ-সাইন অন, লজিস্টিক, সাপ্লাই, স্টোর, টাকা পয়সা, সব কিছুই সে করে এবং এ ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় তেমন কেউ নেই। আর এই মাইকেল সাহেব রবিবার সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে বিশাল মাইক্রোবাস বা ভ্যান নিয়ে বেড়িয়েছেন কয়েকজন ক্রুকে মেডিক্যাল টেস্ট করানোর জন্য। এবং শুরু থেকেই সে এমন ভাবে আচরন করেছেন সে অন্যান্য যে কোন ড্রাইভার, এবং ফোনের কথপোকথন না শুনলে কখনোই জানতাম না সে কে। তার সাথে ফোনে কথা হয় অহরহ, কিন্তা দেখা হয়নি কোনদিন। তার অধীনে অনেক লোক চাকরী করে, মাল্টি মিলিয়ন ডলারের ব্যাবসা তার, কিন্তু এখন সে একজন ড্রাইভার।

বললাম আমার লাগেজ এর কথা। বলল চিন্তা করোনা, টার্কিশ এয়ারের অফিস খুলে বিকেলে, আমি লোক পাঠিয়ে দেব, লাগেজ নিয়ে আসবে। বললাম যদি লাগেজ না আসে, জাহাজে নেবার আগে আমাকে অবশ্যই কয়েক ঘন্টা সময় দিতে হবে। জরুরী ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদি কেনার জন্য। বলল তার মনে থাকবে।ক্লিনিকের মেয়েটি চলে এল মিনিট পাচেকের মধ্যেই, আর পরবর্তি পাঁচ মিনিটে নমুনা নেয়া শেষ, এবং আরও পাঁচ মিনিটের মাথায় র‍্যাপিড টেস্টের রেজাল্ট ও দিয়ে দেয়া হল। আবার ৮০ কিমি ড্রাইভ করে আমাদের নামিয়ে দেয়া হল ১০ টার মধ্যে। জাহাজের এখনও কোন নিশ্চিত খবর নেই, আজকে বিকেলে আসতে পারে, আবার না ও আসতে পারে। সে হিসেবে জানানো হবে আমাদের কখন হোটেল থেকে তোলা হবে।

হোটেলে নেমেই ইগর বলল চলো ওয়ালমার্টে যাই, আমি ও সৌরভ দুজনেই রাজী হয়ে গেলাম। উবার ডেকে ছুটলাম ওয়ালমার্টের উদ্দেশ্যে। লাগেজ পাই আর না পাই, জরুরী কিছু কেনাকাটা করে নিলাম। এরন এর জন্য কয়েকটা গাড়ি, আরুবার পুতুল, আর কিছু খেলনা দুজনের জন্যই একটা করে। ঝটিকা শপিং সেরে চলে এলাম হোটেলে এবং লাঞ্চ করে অপেক্ষার পালা, নেট এ ঘুরাঘুরি। এমন সময় এল পুলকের ফোন। ও গতকাল মেসেজ দেখেনি, তাই কল ব্যাক করেনি। বললাম গতকাল ফ্রি ছিলাম, ভাবলাম দেখা হবে, কিন্তু হলোনা। আজকে চলে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। যদি যাওয়া না হয় তাহলে জানাব। দু রাত্রই ঘুম হয়েছে এলোমেলো, নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম হচ্ছেনা। ছটা বাজে ডিনার করেই ঘুমিয়ে পড়েছি নিজের অজান্তে। আবার ফোনের আওয়াজে ভাঙ্গল ঘুম, রিসেপশন থেকে জানালো সাড়ে দশটায় গাড়ি আসবে জাহাজে নেবার জন্য, মানে সমন হাযির। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র ৩৫ মিনিট বাকি, মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

মাইকেল কে ফোনে করে বললাম, ব্যাগেজ না পেলে অবশ্যই আমাকে শপিং করার সুযোগ দিতে হবে, সে কিভাবে মাত্র আধা ঘণ্টার নোটিশে গাড়ি পাঠাচ্ছে? মাইকেল হেসে ফেলল আমার মেজাজ দেখে, ক্যাপ্টেন আমি লাগেজ পেয়ে গেছি, চিন্তা করোনা। খবর শুনে মন ভালো হয়ে গেল, দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে সাড়ে দশটায় নীচে নেমে এলাম।সাড়ে দশটায় গাড়ি ছুটল হিউস্টন পোর্টের দিকে, গাড়িতে বসে পুলক কে জানিয়ে দিলাম যে আর দেখা হচ্ছেনা, চলে যাচ্ছি জাহাজে। ড্রাইভার জানালো পথে তাদের ওয়্যারহাউসে থামতে হবে, তোমাদের ব্যাগেজ সেখানে রাখা আছে।

পথিমধ্যে ব্যাগেজ তুলে নিয়ে জাহাজে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত ১১৫০, হিসেবে ১৩ তারিখ থেকেই আমাদের দিন গননা শুরু হয়ে গেল, মানে একদিন এগিয়ে গেলাম। ১২টা ১ মিনিটে পৌছলে ১৪ তারিখ থেকে হিসেব করা হত। এসব আসলে তেমন কিছুনা, তারপরেও একধরনের আত্মতৃপ্তি। বলা চলে কারাগারে ঢুকার সাথে সাথে শেষ হল আরেকটি দিন আর শুরু হল জলে ভাসার নুতন অধ্যায়।

লেখক: ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ১৩ সেপ্টেম্বার, ২০২০

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে