ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র মহা প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

0
234
আজ ৬ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববরেন্য সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর ৪৯তম মৃত্যু বার্ষিকী

আজ ৬ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববরেন্য সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর ৪৯তম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৮৬২ সালে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর থানার শিবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন তিনি।

বিশ্ববরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীত জগতের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তিনিই প্রথম বাঙালি সুরসাধক যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রচার করেন। ধ্রুপদী সঙ্গীতের বোদ্ধাগণ সংশয়হীনভাবে স্বীকার করেন, অতি উচ্চমানের সঙ্গীত কলাকার ছিলেন তিনি। বিশিষ্ট সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারে মৃত্যুবরণ করেন। ক্ষণজন্মা এই বাঙালি শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তাঁর জন্মের সঠিক কোন দিন তারিখ খুঁজে পাইনি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালে মতান্তরে ১৮৮১ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে এক সঙ্গীত পিপাসু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে ‘সংগীত কলাকার আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন’ বলে উল্লেখ পেলাম। সঠিক জন্মসাল ও তারিখের সত্যতা যাচাই করার অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছি। কালজয়ী সঙ্গীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে অসাধারণ একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিককুমার ঘটক। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবন-সাধনাকে খুঁজে পেতে সেটি দেখার কোন বিকল্প নেই বলেই মনে করি।

২.
প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাবা আলাউদ্দিন খান নামেও পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ইতিহাসে বহুদিন কোনো বাঙালির নাম ছিল না। এই শূন্যতা পূরণ করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে আলাউদ্দিন খাঁ। সঙ্গীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় তিনি শৈশবেই বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। তারপর নিরন্তর সাধনার সুদীর্ঘ, যন্ত্রণাকাতর পথ বেয়ে তিনি বাংলার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় এক গৌরব। মূলত সরোদ-বাদক হলেও ধ্রুপদী সঙ্গীতের নানা ক্ষেত্রে এক অনুসরণীয় গুরু। তাঁর হাতেই সৃষ্টি হয়েছে প্রসিদ্ধ মাইহার ঘরানা। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ভারতীয় চিরায়ত সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের যন্ত্র তিনি কুশলতার সাথে বাজাতে পারতেন। তাঁর শিষ্যদের দিকে তাকালে, বাদ্যযন্ত্রের সমাহার যে দেখা যায়, তাঁর বিচারে তাঁকে অতিমানবীয় গুণের অধিকারী বলে মনে হয়। তিনি তাঁর পুত্র ওস্তাদআলী আকবর খানকে সরোদ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও নিখিল বন্দোপাধ্যায়কে সেতার, কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণাকে সুরবাহার, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ ও বিজনাথ ঘোষ কে বাঁশি, পণ্ডিত রবীন ঘোষকে বেহালা শিখিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এঁরা সবাই জগৎবিখ্যাত হয়েছেন। তিনি বলতেন, সঙ্গীত আমার জাতি আর সুর আমার গোত্র। মাইহার রাজ্যে, ‘মাইহার কলেজ অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা তাঁর সঙ্গীত জীবনের এক শ্রেষ্ঠ অবদান। তিনি ছিলেন কলেজের সর্বেসর্বা পরিচালক। 

৩.
জন্মভূমি এবং দেশের সঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তিনি জন্মভূমিকে ভুলতে পারতেন না। দেশের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এর মাটিকে আমি প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি। এ মাটিতে মরতে পারলে আমার জীবন ধন্য মনে করব।’ কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। নিয়তির নির্দেশে বাংলায় নয়, ভারতের মাইহার রাজ্যেই তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আমাদের ভাষা ও সাহিত্যকে সর্বপ্রথম বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছেন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁও তেমনি আমাদের রাগ-সঙ্গীতকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার অনুসরিত পথ ধরেই পরবর্তী প্রতিনিধিরা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার কারণে সারা-জীবনে কোনো শিষ্যের কাছ থেকেই তিনি কোনো প্রকার অর্থকড়ি কিংবা গুরুদক্ষিণা নেন নি। তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে সঙ্গীত শেখানোর জন্য প্রায় শ’খানেক অতি সাধারণ মানুষ জোগাড় করেছিলেন। তাঁর শিষ্যদের ধরে রাখার জন্য তিনি এদের সকলের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। এদের দিয়েই সূত্রপাত ঘটেছিল ‘মাইহার ঘরানা’। এদের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন মনোহরা, চন্দ্রসারং, কাষ্ঠতরঙ্গ নামক যন্ত্র। এই সূত্রে তিনি ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাইহার সঙ্গীত কলেজ (Maihar College of Music) প্রতিষ্ঠা করেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আগে মাইহারে যে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারা প্রচলিত ছিল, তিনি তা নতুন রূপে সাজালেন এবং সেই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল মাইহারের নবতর ঘরানা। যদিও মাইহার ঘরানার প্রাথমিক রূপটি গড়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতকে, কিন্তু তাতে কোনো সুসংহত রূপ ছিল না। আলাউদ্দিন খাঁ এই ঘরানাকে এতটাই সুবিন্যাস্ত করেছিলেন যে, তাঁকে এই ঘরানার স্রষ্টা বলা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর এবং তাঁর শিষ্যকূলের দ্বারা এই ঘরানা ভারতীয় সঙ্গীতের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত করেছে।

৪.
আমরা জানি, সঙ্গীতের ধারা নদীর মতো সতত বহমান। কালের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে তা থেমে থাকে না। এ ধারার অগ্রগতিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। কারণ সঙ্গীত সাধকরা শিষ্য পরম্পরায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে সময়ের বিবর্তনের ধারায় এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাই, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তথা সামগ্রিকভাবে সঙ্গীতে গুরুশিষ্য-পরম্পরা তালিমের পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতপক্ষে, গুরু-শিষ্য-পরম্পরা সঙ্গীতবিদ্যা শিক্ষাই সঙ্গীতের ভুবনকে চলমান রেখেছে। এই চলমান গতিই ভবিষ্যতের পানে সঙ্গীতের অগ্রসর হওয়ার মূল স্রোতোধারা। এক সময় সঙ্গীত এই উপমহাদেশে কেবল রাজা বাদশা এবং সামন্তপ্রভুদের দরবারেই সীমাবদ্ধ ছিল। আলাউদ্দিন খাঁ-ই এই রাগসঙ্গীতকে রাজ দরবার থেকে বের করে আনেন এবং সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে গণমুখী করে তোলেন। ওস্তাদজী অসংখ্য রাগ সৃষ্টি করে গেছেন। সঙ্গীতের অসাম্য অবদানের জন্য ওস্তাদজী একদিকে যেমন সংগীত প্রেমিক জনগোষ্ঠীর গভীর ভালবাসা পেয়েছিলেন অপরদিকে তেমনি রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে পেয়েছিলেন বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি।

৫.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ মতান্তরে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুরে এক সঙ্গীতপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিনের ডাক নাম ছিল ‘আলম’। তাঁর পিতার নাম সাবদার হোসেন খান। স্থানীয় লোকেরা তাঁকে সাধু খাঁ নামে ডাকতেন। তাঁর পিতাও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। তাঁর সঙ্গীত গুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। তাঁর অপর দুই ভাই হলেন―ওস্তাদ আফতাব উদ্দীন খাঁ (তবলা ও বংশীবাদক) এবং ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ (সুরবাহার বাদক)। তাঁর জন্মের সঠিক কোন দিন তারিখ খুঁজে পাইনি। ( তবে ৮ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত জীবনীতে ‘সংগীত কলাকার আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।’ বলে উল্লেখ পেলাম। সঠিক জন্মসাল ও তারিখের সত্যতা যাচাই করার অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছি)। প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ‘আলম’শিরোনামের স্মৃতিচারণমূলক রচনায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মদিন ও সাল অনুসন্ধান নিয়ে লিখেছেন, ‘আলাউদ্দিন খান সাহেবের জীবন নিয়ে গল্পের অন্ত নেই। অথচ ওঁর জীবনের একটা বড় অংশের ঘটনাবলির কোনও সন-তারিখের বালাই নেই। ১৯৭২-এ ওঁর প্রয়াণ হলে ওঁর জন্ম সন নিয়েও কম তোলপাড় হয়নি। দেখা গেল ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ যখন ওঁকে পদ্মভূষণ অর্পণ করলেন (১৯৭১-এ ওঁকে পদ্মবিভূষণও দেওয়া হয়) তখন পরিচয়-পত্রাদিতে ওঁর বয়স উল্লেখ করা হয় ৯২ বছর। সেক্ষেত্রে খান সাহেবের জন্মসন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল ১৮৬৬! মাইহার থেকে ১৮ মে, ১৯৫৬-য় এক শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথকে লেখা চিঠিতে খান সাহেব তাঁর তখনকার বয়স জানিয়েছিলেন ৯০। তাতেও তাঁর জন্মসন দাঁড়াচ্ছিল ওই ১৮৬৬। তবে শেষ অবধি যে সনটি মান্যতা পেল, তা ১৮৮১; যে়টি হরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং আরও কেউ কেউ অজস্র তত্ত্বতল্লাশি করে ধার্য করতে পেরেছেন।’

৬.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তবলায় হাতে খড়ি হয় তাঁর বড় ভাই ফকির আফতাবুদ্দীন খাঁর কাছে। একই সাথে তিনি তাঁর পিতার কাছে সেতারের তালিম নেন। দশ বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বরিশালের ‘নাগ-দত্ত সিং’ যাত্রাদলে যোগ দেন। তৎকালীন যাত্রাগানে বাংলার লোকসঙ্গীতের উপাদানে ভরপুর ছিল। যাত্রাদলের সাথে থাকার সময় তাঁর হার্মোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, বেহালা, সারঙ্গী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র এবং রাগসঙ্গীতের প্রাথমিক পর্যায়ের তালিম হয়েছিল। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক ফকির আফতাবুদ্দীন খানের কাছে পাওয়া সঙ্গীতজ্ঞান বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল। কিন্তু যাত্রাদলের গান-বাজনা তাঁকে তাঁকে বেশিদিন পরিতৃপ্ত করতে পারে নি। যাত্রাদলের সাথে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কলকাতায় আসেন। এরপর বড় কোনো গুরুর কাছে তালিম নেবেন এই আশায়, যাত্রাদল ত্যাগ করে কলকাতায় ঘুরতে থাকেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন মানুষকে গান শোনাতেন এবং একরকম ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবন নির্বাহ করতেন। এই অবস্থায় একদিন তিনি পাথুরিয়াঘাটার সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে গান গেয়ে মুগ্ধ করেন। পরে তাঁর গান শেখার ইচ্ছার কথা জানতে পেরে, সৌরীন্দ্রমোহন রাগসঙ্গীত শিক্ষার জন্য পণ্ডিত গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী (নুলো গোপাল)-এর কাছে পাঠান। এই গুরুর কাছে তিনি ৭ বৎসর কণ্ঠসঙ্গীত, মৃদঙ্গ এবং উচ্চতর তবলা প্রশিক্ষণ নেন। সাত বৎসর এখানে শিক্ষাকাল কাটানোর পর, ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্লেগ রোগে পণ্ডিত গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি কলকাতার ‘স্টার থিয়েটার’-এর সংগীত পরিচালক হাবু দত্তের কাছে যান―’স্টার থিয়েটার’-এর বাদ্যযন্ত্রী হওয়ার জন্য। হাবু দত্ত তাঁর সঙ্গীতে দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন এবং থিয়েটারে যন্ত্রসঙ্গীত দলের সদস্য হিসাবে নেন। থিয়েটারে তিনি তবলা, মৃদঙ্গ ও সেতার বাজাতেন। এই সময় অন্যান্য যন্ত্রীদের কাছ থেকে তিনি বেহালা, বাঁশী ও পাখোয়াজ বাদনে পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরে তিনি এই যন্ত্রদলে এসকল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। এর কিছুদিন পরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁকে তবলা বাদক হিসাবে মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়ে যান। এই সময় গিরিশচন্দ্র তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রসন্ন বিশ্বাস। এর পাশাপাশি তিনি কলকাতার মেছোবাজারের হাজারী ওস্তাদ নামক একজন সানাই বাদকের কাছ থেকে সানাই বাজানো শেখেন। এই সময়ে গোয়া থেকে আগত ফোর্ট উইলিয়ামের ব্যান্ডের ব্যান্ডমাস্টার লোবো’র কাছে ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল বেহালা বাজানো শেখেন।

৭.
এর কিছুদিন পর, পালিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে তাঁর বড় ভাই ফকির আফতাবুদ্দীন খাঁ কলকাতায় আসেন। তিনি বহু সাধ্যসাধনা করে, আলাউদ্দিন খাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। তাঁকে ঘরে সংসারি করার জন্য, ৯ বৎসর বয়সী মদিনা বেগমের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। বাসর রাতে ঘুমন্ত নববধূকে রেখে তিনি যৌতুকের টাকা এবং গহনাদি নিয়ে পালিয়ে কলকাতা আসেন। এই টাকা দিয়ে দিয়ে তিনি বেহালা এবং ক্ল্যারিওনেট কেনেন। এই সময় অর্থের সাশ্রয়ের জন্য তিনি ছাতুবাবুর লঙ্গরখানায় একবেলা আহার করতেন এবং অতি অল্প ভাড়ার একটি মেসে থাকতেন। সঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন স্থানে যন্ত্রী হিসাবে বাজাতেন। তাঁর বাজনায় মুগ্ধ হয়ে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর তাঁকে তাঁর সঙ্গীতসভার জন্য নিয়ে যান। ওস্তাদ আহমদ আলী খানের সরোদ (ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের দাদামশাই এবং ওস্তাদ আশগর আলী খানের পিতা) শুনে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং সরোদ শেখার জন্য তিনি তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেন। কথিত আছে নিজের ঘরানা অন্যের কাছে চলে যাবে, এই আশঙ্কায় ওস্তাদ আহমদ আলী খান, তাঁর নিজের ঘরানার বিষয়গুলো শেখাতেন না। কিন্তু সঙ্গীত সভায় তাঁর বাদন শুনে শুনে আলাউদ্দিন খাঁ ওস্তাদের বাদন শৈলী রপ্ত করে ফেরেন। এরপর ওস্তাদ আহমদ আলী খান তাঁকে সাথে নিয়ে রামগড়ে (উত্তর প্রদেশ, ভারত) আসেন। সেখানে ওস্তাদজি তাঁকে গান শেখানোর পরিবর্তে বেশিরভাগ সময় গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত রাখতেন। কিন্তু ওস্তাদের অবর্তমানে আলাউদ্দীন খান ওস্তাদজির বাদনশৈলীর অনুশীলন করতেন। একদিন ওস্তাদ আহমদ আলী খান তাঁর গোপন চর্চা শুনে ফেলেন এবং তাঁর ঘরানার বাদনশৈলী অন্যের কাছে চলে যাচ্ছে দেখে, তিনি আলাউদ্দিন খাঁকে বিদায় দেন। উল্লেখ্য এই সময়ে তিনি সরোদের ‘দিরি দিরি’ স্বরক্ষেপণের কৌশল ত্যাগ করে প্রথাবিরুদ্ধ ‘দারা দারা’ স্বরক্ষেপণ প্রয়োগ করা শুরু করেন। উল্লেখ্য, আলাউদ্দিন খাঁ প্রচুর গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানে তিনি ‘আলম’ ভনিতা ব্যবহার করেছেন।

৮.
ওস্তাদের আশ্রয় হারনোর পর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন নিরাশ্রয় হয় ইতস্তত ঘুরে বেড়ান। পরে একটি নাইটক্লাবের ব্যান্ড মাস্টারের চাকরি পান। এই চাকরিতে তিনি আর্থিক ও মানসিকভাবে অস্বস্তির মধ্যে কাটান। পরে তিনি এই চাকরি ত্যাগ করেন এবং তিনি ওস্তাদ উজীর খাঁর (তানসেন বংশীয় বীণাবাদক) কাছে বীণা শেখার চেষ্টা করেন। প্রাথমিকভাবে এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে, তিনি রামপুরের নবাব হামিদ আলী খাঁর কাছে যান। উল্লেখ্য নবাব হামিদ আলী খাঁর ওস্তাদ ছিলেন ওস্তাদ উজীর খাঁ। পরে নবাবের সুপারিশে ওস্তাদ উজীর খাঁ তাঁকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু ওস্তাদ উজীর খাঁ তাঁকে বীণার পরিবর্তে সরোদ শেখাতে রাজি হলে, আলাউদ্দিন খাঁ তাতেই রাজি হন। ওস্তাদ উজীর খাঁ তাঁকে শুরুতেই কিছু শর্ত দিয়ে দেন। এই শর্ত সাপেক্ষে অঙ্গীকার করিয়ে আলাউদ্দিন খাঁর হাতে নাড়া বেঁধে দেন। এই অঙ্গীকার ছিল― ‘এ বিদ্যা কুপাত্রে দেব না, কুসঙ্গে যাব না, বিদ্যা ভাঙিয়ে ভিক্ষা করব না, বাঈজী বা বারাঙ্গনাদের সঙ্গীত শেখাব না।’ নবাব হামিদ আলী খাঁ বিশেষভাবে আলাউদ্দিন খাঁকে শতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন ‘এ বিদ্যা অর্থের বিনিময়ে কেউ উজীর খাঁর কাছে থেকে পাবে না। তাঁকে খিদমত করে অর্জন করতে হবে।’ এরপর ওস্তাদ উজীর খাঁ’র বাড়িতে থেকে, আড়াই বৎসর তাঁর সেবা করেন। পরে তাঁর নিষ্ঠা দেখে আড়াই বৎসর পর, ওস্তাদ তাঁকে শিক্ষাদান শুরু করেন। ১২ বৎসর পর, ওস্তাদ তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। এই সময় কলকাতার শ্যামলাল ক্ষেত্রীর উদ্যোগে মধ্য প্রদেশের মাইহারের জমিদার মহারাজা ব্রজনাথ সিং-এর দরবারে যান। তাঁর সঙ্গীত শুনে রাজা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সভা-সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে নিয়োগ দেন। একই সাথে রাজা তাঁকে দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজারের দায়িত্ব দেন। মাইহারের রাজা ব্রিজনারায়ণ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীতগুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা হয়, ১৯১৮ সালের দিকে তিনি মাইহারে স্থায়ী হন।বেরিলির পীরের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রাণায়াম ও ধ্যান শেখেন। এভাবে জীবনের একটা বড় অংশ আলাউদ্দিন শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। এরপর শুরু হয় তাঁর কৃতিত্ব অর্জনের পালা। ১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের নিকট পরিচিত করান। তিনি নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক ‘কল্পনা’ শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিকধর্মী ছায়াছবিতে আবহসঙ্গীতে সরোদ পরিবেশন করেন।

৯.
১৯২০-২১ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিবার পরিজনের সাথে বেশ কিছুদিন কাটান। ১৯২২ সালে তাঁর প্রথম পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খান-এর জন্ম হয় শিবপুরে। এরপর তিনি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে মাইহারের চলে আসেন। এখানে ফিরে আসার পর তাঁর গুরু ওস্তাদ উজীর খাঁ তাঁকে ডেকে পাঠান। ইতিমধ্যে গুরুপুত্র পিয়ার মিঞা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাই ওস্তাদ তাঁর অধীত সকল বিদ্যা তাঁর প্রিয় শিষ্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে দান করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই পর্যায়ে তিনি ওস্তাদ উজীর খাঁর কাছে পুনরায় শিক্ষা শুরু করেন। তিন বৎসর পর ওস্তাদ উজীর খাঁ মৃত্যুবরণ করলে, তিনি মাইহারের ফিরে আসেন। সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখেছেন,‘রবিশঙ্কর তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, কী সৌভাগ্য আমাদের যে, বাবার মধ্যে এই বিচিত্র তন্ত্রকারির শিক্ষা আমরা এক জায়গায় পেলাম! সারা জীবনের শেখা বিদ্যা তিনি বাকি জীবন কাজে লাগালেন অন্যদের শেখাতে। গুরুমহিমায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন বাবা আলাউদ্দিন যে গোটা জীবন নিজের সব গুরুদের বন্দনা গেয়ে গেছেন। ওঁর শিষ্য রেবতীরঞ্জন দেবনাথের সেতারিকন্যা অঞ্জনা রায় তাঁর আলাউদ্দিন-জীবনী ‘মিউজিসিয়ান ফর দ্য সোল’ বইতে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। উস্তাদ আলি আকবরের পিতা ও একমাত্র গুরু বাবা আলাউদ্দিন ছেলেকে নাড়া বাঁধিয়েছিলেন ওস্তাদ দবীর খানের কাছে। কারণ? দবীর খান ছিলেন ওস্তাদ উজির খানের বংশধর। এভাবেই উজির খানকে সম্মান ও ভক্তি জানানোর সুযোগ নিয়েছিলেন ভারতের সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরু।’

১০.
ওস্তাদ উজীর খাঁ’র কাছে শিক্ষাগ্রহণ কালে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর গুরুভাইদের কাছে বলেন যে, যা তা বাম হাত বাজাতে পারে, তা তার ডান হাতও বাজাতে পারে। এরপর তিনি তিনি সেতার উভয় হাতে বাজিয়ে দেখান। এরপর থেকে তিনি তারের যন্ত্র বাজাতেন ডান হাতে এবং চামড়াচ্ছাদিত বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বাম হাতে। কিছুদিন পণ্ডিচেরীতে শ্রী অরবিন্দ-এর আশ্রমে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। শ্রীঅরবিন্দ তাঁর বাদনে মুগ্ধ হয়ে- আলাউদ্দিন খাঁকে ‘সুরের ভিতর দিয়ে ঈশ্বরের সাধক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেন।

১১.
আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। সহজাত প্রতিভাগুণে তিনি সরোদবাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ-পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদনপ্রণালী প্রয়োগ করে সেতারবাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীতজগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা শ্রেণী ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলির মধ্যে ‘চন্দ্রসারং’ ও ‘সুরশৃঙ্গার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিণীও সৃষ্টি করেন, যেমন: হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরী, মোহাম্মদ (আরাধনা), মান্ঝ খাম্বাজ, ধবলশ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার মান্ঝ, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি। তিনি স্বরলিপিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর বহুগানের স্বরলিপি সঙ্গীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা গ্রন্থে নিয়মিত প্রকাশ হতো।

১২.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সৃষ্ট কতিপয় রাগরাগিনীর পরিচয়।-
মদন মঞ্জরী: সহধর্মিনী মদিনা বেগমের নামে এই রাগ পরিবেশনের সময় প্রাতঃকাল। আরোহী: সা গা ক্ষা ধা নি ধা নি র্পা। অবরোহী: র্সা নি ধা পা মা গা রে সা।।
রাগ মোহাম্মদ (আরাধনা): এই রাগ পরিবেশনকাল প্রাতঃকাল। ভ্রাতুষ্পুত্র মোবারক হোসেন খানের অনুরোধে রচিত। আরোহী: সা রে গা মা পা নি র্সা। অবরোহী: র্সা নি পা মা গা রে সা।
রাগ শোভাবতী : সন্ধ্যাকালীন রাগ। আরোহী: সা, গা মা ধা নি র্সা। অবরোহী: র্সা নি ধা মা গা সা।
রাগ ধবলশ্রী : সন্ধ্যাকালের রাগ। আরোহী: সা খো মা পা নি র্সা। অবরোহী র্সা নি ধা পা ক্ষা গা ঋে সা।।
রাগ ভুবনেশ্বরী : প্রাতঃকালের রাগ। এই রাগটি স্ত্রী মদিনা বেগমকে উৎসর্গ করেন। আরোহী: সা রে গা মা পা ধা র্সা। অবরোহী: সা ধা পা মা গা রে সা।।
রাগ হেম বেহাগ : গভীর রাত্রিতে পরিবেশনের রাগ। আরোহী: সা গা মা পা নি র্সা। অবরোহী: র্সা নি ধা পা মা গা রে সা।।
রাগ স্বরস্বতী : রাত্রিবেলা পরিবেশনের কাফি ঠাটের রাগ। আরোহী: সা রে জ্ঞা মা ধা মা ধা র্পা। অবরোহী: র্সা নি ধা মা জ্ঞা মা জ্ঞা, রে সা।।

১৩.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ দেশিয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রার স্টাইলে একটি যন্ত্রীদল গঠন করে নাম দেন ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। অতঃপর ভারত সরকার তাঁকে একে একে ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমী সম্মান’ (১৯৫২), ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৫৮) ও ‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৭১); বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ‘দেশিকোত্তম’ (১৯৬১) এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডক্টর অব ল’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক আকাদেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল তাঁকে আজীবন সদস্যপদ দান করে। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসব দুর্লভ সম্মান ও খেতাব সঙ্গীতবিদ্যায় আলাউদ্দিন খাঁর অসাধারণ কীর্তি ও সাফল্যকেই সূচিত করে।

১৪.
বহুসংখ্যক যোগ্য শিষ্য তৈরি তাঁর অপর কীর্তি। তাঁর সফল শিষ্যদের মধ্যে তিমিরবরণ, পুত্র আলী আকবর খান, জামাতা পন্ডিত রবিশঙ্কর, ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খান, কন্যা রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা), ফুলঝুরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশেম খান, পন্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌত্র আশীষ খান ও ধ্যানেশ খান, খুরশীদ খান, শরণরাণী, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য, দ্যুতিকিশোর আচার্য চৌধুরী, যামিনীকুমার চক্রবর্তী, রণেন দত্ত রাজা রায়, শচীন্দ্রনাথ দত্ত, শ্যামকুমার গাঙ্গুলী, শ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ প্রামাণিক এবং রাজা ব্রিজনারায়ণ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

১৫.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সমাজসেবামূলক কাজও সম্পাদন করেছেন। আপন জন্মস্থান শিবপুর গ্রামে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং পানি পানের জন্য একটি পুকুর খনন করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নির্মিত মসজিদটি এখনও তাঁর স্মৃতিবহন করে চলছে।

১৬. 
বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনের নানান জলছবি পাওয়া যায় বিভিন্নজনের রচনায়, স্মৃতিতে। প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘বাবা আলাউদ্দিনের স্বভাব ও চরিত্রের দুটি সেরা শব্দচিত্র রেখে গেছেন রবিশঙ্কর আনন্দবাজার পূজাবার্ষিকীর জন্য লেখা ‘বেণীমাধবের ধ্বজা থেকে আইফেল টাওয়ার’ রচনায়। সেখান থেকে দুটো ছবি তুলে দিচ্ছি। প্রথমটা উদয়শঙ্করের নৃত্যদলের সঙ্গে বাবার ইউরোপ যাত্রার প্রাকমুহূর্ত— ‘বোটে যখন উঠছে সবাই – মা, আমি আর বাবা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা তো মা’কে মা মা করতেন। রত্নগর্ভা, আপনার গর্ভে শিবশঙ্কর আইসে। দাদার কথা আর কী। ‘মা’র হঠাৎ কী যে হল premonition, perhaps she knew.আমার হাতটা বাবার হাতে দিয়ে বললেন, উনিও বাবাই বলতেন। বাবা, আপনাকে একটা কথা বলব? – ‘বলেন মা বলেন’, বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলেন— আদেশ করেন— ‘না, আপনি তো জানেন, এর বাবা মারা গেছেন— বড় দুরন্ত ছেলে, এখন তো কেউ নেই। আপনি একটু দেখবেন একে। ভুলটুল মাপ করে দেবেন। কারণ মাও তো বাবার মূর্তি দেখেছিলেন, উনি চাইতেনও যে আমি বাবার কাছে শিখি। আমিও চাইতাম, কিন্তু সাহস হত না। মা বলার সঙ্গে সঙ্গে, বাপরে! বাবাও highly emotional. একেবারে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন— মা আপনে বলসেন কী, আপনে রত্নগর্ভা — আজ থিক্যে আলি আকবর আমার ছোট ছেলে— রবু আমার বড়ো ছেলে। আপনায় কথা দেলাম। মা আর বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কেন জানি না, ভেউ ভেউ করে কাঁদছি — বড় বিশ্রী পরিস্থিতি কান্নার মধ্যেই মা’কে আমি শেষ দেখছি। হাত নাড়ছি। মা দাঁড়িয়ে আছেন চশমা পরে। পরনে ঢাকাই শাড়ি, সেই শেষ দেখা।’

১৭.
‘আর বাবার অন্য ছবিটা কেমন রবিশঙ্করের স্মৃতিতে? শুনুন … ‘‘কয়েক মাস পরেই প্যারিসে খবর পেলাম— মা মারা গেছেন। বাবও কেমন যেন বদলে গেলেন— মানে আমার সম্পর্কে তাঁর মনোভাব। তবু উনি মাঝে মাঝে খুব রেগে যেতেন। কিন্তু আমাকে ঠিক বকতেন না। তখন আমরা প্যালেস্টাইনে ছিলাম (ইজরাইল হয়নি তখন)। তখন একটু একটু শেখাতে শুরু করেছেন আমাকে। গান শেখাচ্ছেন। গত শেখাচ্ছেন, আমাকে আর দুলালকে। আমরা ভাবলাম, বাবাকে একটা কিছু দেওয়া যাক। কী দেওয়া যায়? ‘‘বাবা হুঁকোটা খুব miss করতেন। কড়া সিগারেট খেতেন। আমি আর দুলাল খুব ভেবেচিন্তে, খুব ভাল পাইপ, একেবারে best available, আর ভাল টোবাকোর পাউচ নিয়ে গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে রাখলাম। ‘‘সেদিন ওঁর মুডটা কী কারণে যেন খারাপ ছিল। আর যায় কোথায়, দুর্দশা একেবারে – ‘আমার মুয়ে আগুন দিতে আইসে। কী ভাবস আমারে ঘুষ দিয়া শিখবা? আমি ওসব নিই না। আমি কারও পয়সা নিই না, আমি কারও পান খাই না।’ ‘‘আমরা বুঝলাম এঁকে এসবেতে ফাঁসানো যাবে না। আর তার প্রয়োজনও ছিল না। উনি যে ভেতরে ভেতরে আমাকে একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন। বলতে গেলে he depended on me। আমার এক নতুন জীবন শুরু হল।’’

১৮.
‘আলাউদ্দিন খাঁ : আমার লাল জেঠা’ স্মৃতিচারণমূলক লেখায় মোবারক হোসেন খান বলছেন, ‘লাল জেঠার সঙ্গীত জীবনের পরিণতকালের ঘটনা হলো পৃথক সঙ্গীত ঘরানার প্রবর্তন। সারা জীবন সঙ্গীত সাধনার বন্ধুর পথ অতিক্রম করার পর তার জীবনে সাফল্য এসেছিল। সাফল্যে তিনি উচ্ছ্বসিত হননি। বরং তাকে আরও ধ্যানী করে তুলেছিল। তার নিজের সঙ্গীতের ভান্ডারকে তিনি শিষ্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার ব্রত নিলেন। জীবনে অনেক কষ্ট, দুঃখ, পরিশ্রমকে অতিক্রম করে যে ঐশ্বর্য তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন, ভরা কলসির সেই জল, তিনি শিষ্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে লাগলেন। মাইহারের মতো এক অজ শহরে পরবর্তী জীবনে বহু শিল্পী কাটিয়েছেন বহুদিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অজপাড়াগাঁ শিবপুর যেমন আলাউদ্দিনের সঙ্গীতের জাদুর স্পর্শে পৃথিবী বিখ্যাত হলো, মধ্যপ্রদেশের অজ শহর মাইহারও তারই অস্তিত্ব ধারণ করে বিশ্বখ্যাত হয়ে রইল। বহু শিল্পী মাইহারে তার কাছে এসেছেন সঙ্গীতের তালিম নিতে। থেকেছেন, শিখেছেন, পারদর্শিতা লাভ করছেন। লাল জেঠার সে দান ছিল অবারিত। অর্থের বিনিময়ে তিনি সঙ্গীতকে বিক্রি করেননি। শিখেছেন বিনা অর্থে। কারণ, তিনি জেনেছিলেন, অর্থ দিয়ে এ বিদ্যা কেনা যায় না। কিংবা অর্থের বিমিয়ে বিক্রি করা যায় না। তার শিষ্যরা যে যেভাবে পেরেছেন তার কাছ থেকে উজাড় করে নিয়েছেন। বিনিময়ে তাদের ভাগ্যে হয়তো গুরুর তিরস্কার জুটেছে, কিন্তু সেই তিরস্কার সহ্য করে যারা শেষ পর্যন্ত আহরণ করতে পেরেছেন আজ দুনিয়া জোড়া তাদের নাম। অজপাড়াগাঁয়ের এবং অজ শহরের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাই হয়ে আছেন সঙ্গীতের কিংবদন্তি। শিষ্য গড়ায় পাশাপাশি ‘ঘরানা’ সৃষ্টি করে সাত শ বছরের সঙ্গীতে তিনি যোগ করলেন এক নতুন মাত্রা। সুদীর্ঘকাল তালিমের নির্যাস দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ঘরানার তাজমহল। সেনী ঘরানার সঙ্গীতের সঙ্গে সেই ঘরেরই ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছ থেকে যে তালিম নিয়েছিলেন তাকে নতুন সাজে ভূষিত করে সৃষ্টি করলেন ‘আলউদ্দিন ঘরানা’ সঙ্গীত।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে