করোনা: নদী এখন শতভাগ নিরাপদ

0
389

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব ইতিমধ্যে আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে, দেখিয়ে দিয়েছে। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সকল নৌযান বন্ধ থাকার কারণে এ বছর ঈদুল-ফিতর উপলক্ষে নদীতে একটি নৌযানো ভাসবে না।

এ বছর নদীপথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। সেদিক থেকে নদী এখন শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু প্রতি বছর মে মাস বা বর্ষা আসলেই আমাদের মনের মধ্যে যে ভয় জাগে, তা কেবল একবছরের নিরাপত্তা দিয়ে কাটানো সম্ভব নয়।

এখনো  ঘুমের মধ্যে ভেসে ওঠে মেঘনা নদীর উত্তাল দৃশ্য। মেঘনা নদীর তীরে শতশত মানুষের কান্নার শব্দে আকাশ পাতাল ভারি হয়ে উঠছে। মেঘনা নদীর জলে কচুরিপানার সাথে ভেসে যাচ্ছে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরীর উল্টে থাকা মৃত দেহ। কেউ নদীর পারে গগণবিদারি চিৎকার করে ‘মা’ বলে কাঁদছে। কান্না জড়ানো চোখে শতশত মানুষ ভীড় করে জমাট হয়ে নিরুপায় চোখে তাকিয়ে আছে মেঘনার দিকে। বলছিলাম ২০০৪ সালের ২৩ মে গভীর রাতে যাত্রীবহনে অযোগ্য লঞ ‘এমভি লাইটিং সান’ নামে যাত্রীবহনে অযোগ্য একটি লঞ্চ ডুবে যাওয়া ঘটনার কথা।

আমার গর্বধারিনী মা আছিয়া খাতুন মাদারীপুর আড়িয়াল খাঁ নদীবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গ্রামের ফসল তোলা শেষে ঢাকার পথে ফিরছিলেন মা আছিয়া খাতুন। মাদারীপুরের খাশেরহাট বন্দর থেকে ‘এমভি লাইটিং সান’ লঞ্চের ক্যাবিনের যাত্রী ছিলেন তিনি। আড়িয়াল খাঁ নদীতে চলন্ত অবস্থায় মেঘলা আকাশের মধ্যে লঞ্চটি ছেড়ে আসার সময় নদীতে উত্তাল ঝড় শুরু হয়।

যাত্রীদের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যাবার ভয় সৃষ্টি হলে লঞ্চের মাস্টারকে নোঙর করতে বলেও কাজ হয়নি। লঞ্চটি বিপদজনক পরিস্থিতির মধ্যে আড়িয়াল খাঁ নদী পার হয়ে মেঘনায় পৌছালে ঝড় আরো বেড়ে যায়। যাত্রীদের চিৎকার থামাতে বরং লঞ্চ স্টাফরা ধমক দিয়ে লঞ্চটি চালাতে থাকে।

মেঘনার বাঁকে চাঁদপুরের কাছে আনন্দবাজার এলাকার কাছাকাছি যেতেই শুরু হয় ভয়ঙ্কর ঝড়। একশ’ যাত্রী ধারণ ক্ষমতার দেড়তলা ছোট লঞ্চটি তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে প্রায় এক ঘন্টা নদীর মধ্যে যুদ্ধ করছিল। যাত্রীরা কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে উত্তাল নদীর স্রোতে লাফিয়ে পড়ে, কেউ অজ্ঞান হয়ে যায়, কেউ আল্লার নাম নিতে থাকেন। তারপর রাত ২টা ২০ মিনিটে লঞ্চটি মেঘনার ঘূর্ণিস্রোতে উল্টে যায়। মেঘনার পাড়ে তিন শতাধিক যাত্রীসহ ডুবে যাওয়া সেই লঞ্চ উদ্ধার করার মতো তখন কেউ ছিলো না। আমার জননী এবং সহোদর মিলন আকন একটি ক্যাবিনের যাত্রী ছিলেন।পরিস্থিতি দেখে ঘুমন্ত ছেলেকে ডেকে মহাবিপদের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, নদীতে অনেক ঝড় উঠেছে মনে হয় লঞ্চটি ডুবে যাবে। ঘুমন্ত ভাই আমার জানালায় গিয়ে নদীর ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভেবেছে এখন কি করা যায়, ঠিক তখন আমার জননী নিজের জীবনের চেয়ে ছেলের জীবনের কথা ভেবে আমার ভাইকে রক্ষা করার জন্য নদীতে ফেলে দেয়। তার পরেই উল্টে যায় লঞ্চটি। আমার মায়ের সকল স্বপ্ন নিভে যায়। অন্ধকার হয়ে আসে সমগ্র পৃথিবীর আলো।

সেই রাতে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা একটি লবনবাহী জাহাজ ঠিক সেই সময় মেঘনা নদী পাড়ি দিচ্ছিল। নদীর মধ্যে মানুষের আর্তনাদে কাছাকাছি গিয়ে জাহাজের নোঙর বাধা শেকল নদীতে নিক্ষেপ করলে আমার সহোদর শেকল ধরে। এরপর জাহাজের শ্রমিকরা তাকে টেনে তোলে। একই সময় ‘লাইফ বয়া’ ধরে কেউ কেউ ভেসে থাকার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। একটি সকাল আমাকে এমন সংবাদ দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে ছিল। তারপর আর ঘুম আসে না দুই চোখের পাতায়। জেগে থেকে ভাবছিলাম, বাংলাদেশ নদীমাতৃক অথচ এই নদীপথের নিরাপত্তা নেই কেন?

সেই থেকে নদী পথের যাত্রী নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার শপথ গ্রহণ করে ‘নোঙর’ নামের একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। আমাদের অনুসন্ধানে দেখেছি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বিভিন্ন নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত নদী পথে প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরো শতশত মানুষ। পরিবারের প্রিয় মা-বাবা, ভাই-বোন হারিয়ে আজ পর্যন্ত আমার মতো অনেকেই দিশাহারা হয়ে বেঁচে আছেন; তাদের জন্য আমার সমবেদনা।

কেন এই নৌদুর্ঘটনা? প্রতি বছর ঈদে ঘরমুখী দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের জন্য স্পেশাল সার্ভিস নামে প্রস্তুত করা হতো চলাচলের অযোগ্য, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা তালি দেওয়া শতাধিক লঞ্চ। ত্রুটিপূর্ণ নকশায় নির্মাণ করা আর অদক্ষ চালকের মাধ্যমে এসব আনফিট লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন হয় অধিক মুনাফার জন্য। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও অদক্ষ চালকের কারণে।

লঞ্চ মালিকরা বিআইডব্লিউটিএ থেকে লঞ্চ নির্মাণের জন্য নকশা পাস করিয়ে নিলেও ডকইয়ার্ডে গিয়ে নিজেদের মতো করে লঞ্চ তৈরি করেন। দেড়তলার অনুমোদন নিয়ে তৈরি করেন তিন থেকে সাড়ে তিনতলা লঞ্চ। ত্রুটিপূর্ণ এসব লঞ্চ সামান্য দুর্যোগে একটু কাত হলেই ডুবে যায়। গত ১৫ বছরে ত্রুটিপূর্ণ নকশায় নির্মাণ করা আর অদক্ষ চালকের কারণে শতাধিক লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সহস্রাধিক মানুষ।

বাংলাদেশের ১৩ হাজার লঞ্চের মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযান ২ হাজার ২২৫টি। যাত্রীবাহী নৌযানের মধ্যে বছরে ফিটনেস পরীক্ষা বা সার্ভে করা হয় মাত্র ৮৫০ থেকে ৯০০টির। সার্ভে না করার কারণে ফিটনেসবিহীন নৌযান চলাচল করায় প্রতিবছরই ঘটে নৌদুর্ঘটনা, মৃত্যু হয়েছে হাজার মানুষের। ফলে সারাবছরই নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা থাকেন চরম ঝুঁকির মধ্যে। ঈদ উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল, চাঁদপুর, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে নিয়মিত যতগুলো লঞ্চ চলাচল করে।

প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে আনফিট লঞ্চগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে রং করার মাধ্যমে চাকচিক্যের কাজ শেষ করে প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু ঈদের আনন্দে ঘরমুখী দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ঘরে ফেরা কতটা নিরাপদ হয় তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

নদী পথে নিয়ম নীতি মেনে না চলায় প্রতি বছরই ঘটছে এমন নৌদুর্ঘটনা। মেঘনা নদীর মোহনায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে একটি মহল অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। নদীতে এলোপাতাড়িভাবে বাল্কহেড ও ড্রেজার চলাচল ও রাখায় দেশের প্রধান নৌ-রুটটির এ স্থানটিতে নৌযান চলাচলে মারাত্মক হুমকি দেখা দিয়েছে। এছাড়া দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সরঞ্জামাদি ও জনবল না থাকায়, গাফলতির কারণে প্রাণহানি ও সলিল সমাধির সংখ্যা বাড়ছে।

এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও অধিকাংশ সময়ই এসব কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। ১২ বছরের লঞ্চ দুঘর্টনায় প্রায় ২০০টি তদন্ত কমিটি করা হলেও মাত্র ৫/৭টি কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

নোঙর গত ১৫ বছর ধরে বহুবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে ‘২৩ মে’ দিবসটি নৌ-নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করছে। নদীমাতৃক দেশে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ নৌপথে নিহত হয়েছেন তাদের স্মরণে একটি জাতীয় নৌ-নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা করা জরুরি। কারণ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ২০০৪ সালের ২৩ মে তারিখ পর্যন্ত দেশের কোথাও কোন প্রতিবাদ করেনি কেউ। নদী পথেরর জানমাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নোঙর আন্দোনের ফলে দেশের নৌপথ আজ নিরাপদ রাজপথ হিসেবে গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও নৌ-দূর্ঘটনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন নদীতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন এমনকি কোথাও কোথাও এখনো ঘটছে নৌদুর্ঘটনা। তাই নোঙর ২৩ মে দিনটাকে ‘মাইল স্টোন’ হিসেবে ধরে নিয়ে এ বছর ১৬ বছরে পদার্পণ করেছে।এ বিষটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবার পরেও নৌপথের জানমালের নিরাপত্তা জোরদার করতে সমগ্র পৃথিবীর কোনো দেশে নৌ-নিরাপত্তা দিবস পালন করা হয় না। তাই গত ৪৮ বছরে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথে দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে ২৩ মে জাতীয় নৌ-নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা করা হলে আগামী দিনের নৌপথের যাত্রীদের মধ্যে স্থায়ী সচেতনতা গড়ে উঠবে এবং একদিন সারা বিশ্বে এই দিবস পালিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: সভাপতি, নোঙর

shumanshamsbd@gmail.com           

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে