ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উড়াল গ্যাসের গ্রাম বাকাইল

0
378

রাস্তার দুই পাশে গাছের ওপরে ঝুলছে গ্যাসের প্লাস্টিকের পাইপ। সেই পাইপ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ঘর-বাড়িতে। এই চিত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের বাকাইল গ্রামের।

মোঃ রাসেল আহাম্মেদ, নোঙর ব্রাক্ষণবাড়িয়া প্রতিনিধি: কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাছের ওপর এই গ্যাসের পাইপের কারণে গ্রামটিকে এখন উড়াল গ্যাসের গ্রাম হিসেবেই বেশি চেনে মানুষ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব উড়াল গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পরে আবারও সংযোগ দেয়া হয়। ফলে গ্যাসের এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার রোধ করতে না পারায় যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা। জানা গেছে, এক যুগেরও বেশি সময় আগে বাকাইল গ্রাম সংলগ্ন তিতাস নদীর কয়েকটি স্থানে গ্যাসের উদগীরণ শুরু হয়।

মূলত তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ৩নং কূপ খননের সময় লিকেজের কারণেই এই গ্যাসের উদগীরণ হয় বলে জানা গেছে। কূপের গ্যাস মাটির উপরের স্তরে চলে আসে এবং মাটির ফাঁক-ফোকর দিয়ে নলকূপ, নদীর পাড়, জমির আইল এবং বাড়ির আঙিনা দিয়ে গ্যাস উদগীরণ হতে থাকে। গ্যাসের এই উদগীরণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৭ সালে ৩নং কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)।

এরপর থেকে গ্যাসের উদগীরণও কমে আসে। বাকাইল গ্রামের বাসিন্দারা উদগীরণ হওয়া এই গ্যাস তাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেয়ার দাবি জানালেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসপ্রবাহ না থাকায় বিজিএফসিএল এ গ্যাস সংরক্ষণ বা উত্তোলনে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, উদগীরণ হওয়া এই গ্যাস কূপের গভীরের লিকেজ হওয়া পকেট গ্যাস। এই পকেট গ্যাস এক সময় শেষ হয়ে যাবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এই গ্যাসের ব্যবহার বৈধ নয়। এই গ্যাস দিয়ে বাণিজ্যিক কোনো প্ল্যান্টও করা সম্ভব নয়। কারণ নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসপ্রবাহ না থাকলে কোনো প্ল্যান্ট করা যাবে না। যেখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস থাকবে সেখানেই প্ল্যান্ট হবে।

বাকাইল গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসপ্রবাহ নেই। উদগীরণ হওয়া গ্যাস সাধারণত নলকূপ স্থাপনের জন্য যতটুকু গভীরতা প্রয়োজন সেটুক গভীরের গ্যাস। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে বিজিএফসিএল’র উৎপাদিত যে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তা অনেক গভীর এবং প্রেসারের। সরেজমিন বাকাইল গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, তিতাস নদীর যেসব স্থানে গ্যাস উদগীরণ হচ্ছে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ড্রামে করে পানিসহ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এরপর একটি পাইপ দিয়ে পানি বের করে আরেকটি পাইপ দিয়ে উত্তোলন করা গ্যাস বিভিন্ন ঘর-বাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে।

গ্রামের কয়েকশ ঘরবাড়িতে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি চুন ও চুড়ি কারখানাও চলে বিজিএফসিএল’র এই পকেট গ্যাস দিয়েই। তবে এই গ্যাসের প্রেসার ওঠানামা করে। যেখানেই পকেট গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে সেখানেই নলকূপ বসিয়ে পানিসহ গ্যাস উত্তোলন করে ড্রামে সংরক্ষণ করছে একটি চক্র। এরপর ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস সরবরাহ করছে ওই চক্রটি। উদগীরণ হওয়া এই গ্যাস দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রমরমা ব্যবসা করে আসছে ওই চক্রের সদস্যরা। তবে গ্রামের বাসিন্দারা অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে মুখ না খোলায় তাদের শনাক্ত করতে পারছে না প্রশাসন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না তবে প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ গাছের ওপর দিয়ে নেয়া পাইপগুলো অপসারণ করেন।

কিন্তু অভিযানের পর রাতের আঁধারে আবারও গ্যাস সংযোগ দেয় চক্রটি। এভাবে গ্যাস ব্যবহারে ঝুঁকি আছে জেনেও গ্যাস সংযোগ নিচ্ছে গ্রামের মানুষ। মূলত সরকারিভাবে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার কারণে ঝুঁকি নিয়েই তারা গ্যাস ব্যবহার করছে। তারা সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে গ্যাস সংযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।বাকাইল গ্রামের বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান বলেন, আমাদের গ্রামে চতুর্দিকে গ্যাস রয়েছে। গ্রামের অনেকেই এই গ্যাস ব্যবহার করছে। কিন্তু আসলেই এই গ্যাস ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ।

যে কোনো সময় বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু সরকারিভাবে গ্যাস না পেয়ে বাধ্য হয়ে অবৈধভাবে এই গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে গৃহবধূ তাহমিনা আক্তার বলেন, গ্যাস ছাড়া তো আর চলা যায় না। রান্না করার সময় অনেক সতর্ক থাকি। এরপরও ভয়ে থাকি কখন আগুন লাগে। যে কোনো মুহূর্তে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে যেত পারে। সরকারিভাবে গ্যাস দিলে তো আমাদের আর ঝুঁকি নিয়ে গ্যাস ব্যবহার করতে হতো না। আলমগীর মিয়া নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আগে আমরা সব সময় এই গ্যাস ব্যবহার করতাম। প্রশাসনের লোকজন বিভিন্ন সময় এসে গ্যাসের সংযোগ কেটে দিয়ে যায়। তখন বাড়িতে রান্না করতে গিয়ে নারীদের কষ্ট করতে হয়। আমরা চাই আমাদের এলাকায় যেন সরকারিভাবে গ্যাস দিয়ে আমাদের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা হয়।

গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিতে গ্রামে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু গ্রামের লোকজন সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মুখ না খোলায় তাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আমরা নিয়মিত সেখানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছি। অচিরেই অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে এবং গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার রোধ করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে সতর্কতামূলক সভা করা হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তবে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. শফিকুল হক বলেন, বিজিএফসিএল’র একটা কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। পরে তারা সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চলে আসে। তবে উদগিরণ হওয়া এই গ্যাস কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। কোথা থেকে গ্যাস বের হচ্ছে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে