প্রেক্ষিত “নদীর কথা তিতাস”

0
648
তিতাস নদী

তিতাস নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে প্রবাহমান নদী বিশেষ বাংলাদেশ ভারতের আন্তঃসীমানা সংশ্লিষ্ট নদী হিসেবে এটি পরিচিত। নদীটির উৎপত্তি হয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরায়। সেখানে বাংলা ভাষায় হাওড়া নদী এবং স্থানীয় কোকবোরোক ভাষায় সাঈদ্রা নদী নামে তিতাস নদীর নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঐ নদীটি তিতাস নদী হিসেবে পরিচিতি পায়।


তিতাস ভারতের আগরতলা এবং বাংলাদেশের আখাউড়া উপজেলা ও শাহবাজপুর টাউন অঞ্চল অববাহিকার বৈশিষ্ট্যক্রম বৃদ্ধি মেঘনা নদী প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দৈর্ঘ্য ৯৮ কিলোমিটার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত শাহবাজপুর টাউন অঞ্চলের লঞ্চঘাট থেকে তিতাস নদীর দক্ষিণাংশের দৃশ্যমালা।

দেখা যায় ভারতীয় অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা দিয়ে নদীটি প্রবেশ করে শাহবাজপুর টাউন অঞ্চলের সীমানা ঘেঁষে এটি আরো দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে ভৈরব-আশুগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে বহমান অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনার সাথে একীভূত হয়ে যায় তিতাস নদীটি। জেলাজুড়ে তিতাসের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৮ কিলোমিটার।

তিতাস ও মেঘনা নদীকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে একটি উপকথায় বলা হয়েছে যে, তিতাস নদী মেঘনার কন্যা বা মেয়ে।।

নদীমার্তৃক বাংলার মানুষের জীবন সংগ্রাম, সংস্কৃতি, সুখ-দুঃখ, অধিকার, বঞ্চনা ও ক্ষমতার দাপট ইত্যাদি নিয়ে যেখানে মানুষের ভাবনার শেষ নেই সেখানে ভাষাহীন বৃক্ষ, জলা, পাহাড়, নদী, সাগর আর পশু-পাখির অস্তিত্ব পরিবেশ এর ভাল-মন্দ এতটা নিয়ে মানুষের ভাবার সময় কই? আর আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় ছুটতে গিয়ে মানুষ যেখানে তার মানবিক গুণাবলিই বিসর্জন দিতে কুণ্ঠা বোধ করছে না, সেখানে প্রকৃতি, পরিবেশ আর বন্যপ্রাণীর উপেক্ষিত হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র? প্রকারান্তে পরিবেশ ধ্বংসকারী জানার পরও সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ই আমাদের মধ্যে খুব একটা চেতনার উদ্রেক করছে না।

প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসের অজস্র ঘটনার জন্ম দিয়ে নির্বিকারভাবে দিন কাটিয়ে চলেছি তো চলেছি-ই আমরা, পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটি ধরাধরি করেই সময়ক্ষেপণ করে চলেছি। বলা যায় বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ চার কোটি মানুষের বসবাস উপযোগী হলেও এখানে এখন প্রায় সাড়ে সতের কোটি লোকের বাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সরকারের সব উদ্যোগকে পেছনে ফেলে এখনো যা আছে তাতেই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আশু সমাধানের পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

জনগণের জন্য খাদ্য জোগানে, অধিক খাদ্য উৎপাদনে, প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের নীতি গ্রহণ করার ফলে বিলের মতো জলাধারগুলো পোল্ডারে বেঁধে রেখে ধান চাষের ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আমাদের ভূ-উপরিস্থ পানির রিজার্ভার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাত যে একমাত্র খাদ্য নয়! এটাই বোধকরি আমাদের পরিকল্পকরা ভুলে গেছেন। তাই দেশে যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার জন্য প্রকৃতির চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম দায়ী নই।


বিশ শতকের শুরুতে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল দুই বিলিয়ন আর একুশ শতকে এসে বিশ্বের জনসংখ্যা হয়েছে সাত বিলিয়ন। এই এক শতাব্দীতে বেড়েছে ছয় বিলিয়ন মানুষ। জাতিসংঘের হিসাবমতে, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে নয় বিলিয়ন। এ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি বিশ্বের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জনসংখ্যার হার কমলেও মৃত্যুর হার কমে গিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। মানুষ বেশি দিন বাঁচতে পারছে বলে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশের ওপর চাপ বাড়ার কারণে সার্বিক বিপর্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে।


বিপর্যস্ত এ পৃথিবীতে তাই ইট, পাথরের গুদাম থেকে সবুজের কোলে পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পাখির কাকলি আর রঙের বাহারের সঙ্গে তার পায়ের নাচন, ফুলের গন্ধ, বাঘের রাজকীয় ভঙ্গি, ভোরের আলোয় সবুজের সমারোহ মানুষের হূদয়কে স্পর্শ করছে। মানবিক মানুষ পারমাণবিক স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে ধ্বংসের প্রাক্কালে আজ একবার পেছনে তাকানোর নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করছে। অনুভব করছে একা বাঁচার কোনো পথ নেই। মানুষের সঙ্গে অন্যদের বাঁচিয়ে না রাখতে পারলে নিজেদের রক্ষা করা যাবে না। পরিপূরক হিসেবে সবাইকে রক্ষা করার নৈতিক দায়িত্ব মানুষকেই নিতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য সর্বধ্বংসী ক্ষমতা অর্জন করে লাভ নেই। সবকিছু নিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।


পরিবেশ নিয়ে এ ভাবনা বিশ্বমানুষের কাছে খুব পুরনো নয়। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে পরিবেশ ভাবনার ব্যাপকতা লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর মানুষ একটু একটু করে পরিবেশ সচেতন হয়ে উঠছে। পরিবেশগত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা নিরসনের জন্য সমাধানের পথ খুঁজে ফিরছে নোঙর, বাংলাদেশ। নোঙর দলবদ্ধভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণে বিশ্বব্যাপী কর্মচাঞ্চল্যও দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ উন্নয়নে এ কর্মচাঞ্চল্য আগামীতে পরিবেশের কী উপকার করবে তা এখন বলা না গেলেও আশা করা যাচ্ছে, পৃথিবীর মানুষ সচেতনভাবেই এগিয়ে আসবে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে আজকের কিছু সুুখকে বিসর্জন দিয়ে অন্তত নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবে। সে ভাবনা থেকেই উঠে আসছে নদী রক্ষা, বনায়ন, জলাভূমি রক্ষা, বনভূমির উন্নয়ন, দূষণমুক্ত পরিবেশ, পানি সুরক্ষা, জ্বালানি ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, লবণাক্ততা নিরসন ইত্যাদি বিষয়। বিশ্বমানবের এ সচেতন ভাবনায় নোঙর এর পতাকাতলে আমাদের অংশগ্রহণ কতটা সফল হবে সেটাই বিবেচ্য।


বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে নদীর বিস্তার এবং প্রবল প্রভাব। যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকা, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর থেকে শুরু করে অনেক কিছুই নির্ভর করে নদীর ওপর। নদীর পানিপ্রবাহ, পলিপ্রবাহ, ঢাল, চ্যানেলের গভীরতা, প্রশস্ততার মধ্যে নদী একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। একটার পরিবর্তন ঘটলে বা ঘটানো হলে অন্যটির পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আমাদের অপরিকল্পিত নদী শাসন নদীর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের একতরফা নদীর পানি প্রত্যাহারে চর পড়ে আর শুকিয়ে নদী আর নদী থাকছে না—ছোট খাল আর ফসলের ক্ষেতে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের প্রাণ ছিল নদীগুলো। অথচ আজ যথার্থ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে নদী আমাদের কাছে সম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হয়েছে। নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে এক রকম আর শীতকালে আরেক রকম চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


ভূগোলবিদদের মতে, বাংলাদেশের গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলার কারণে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর গতিপথ অবিশ্বাস্যভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। তথ্য মতে, চাঁদপুরের দক্ষিণে মেঘনা প্রতি বছর ১ হাজার ৪০০ ফুট করে ভাঙছে, অগ্রসর হচ্ছে পূর্বদিকে। পদ্মা নদী ভাঙার গতি বছরে গড়ে ২০০ ফুট পূর্বদিকে। আবার ভূমি গঠন প্রক্রিয়া চলায় অনেক নদী হারিয়েও যাচ্ছে। জানা যায়, এককালে যশোর জেলায় ৩৬টি নদী ছিল বলে হান্টার উল্লেখ করেছিলেন। সংস্কারের অভাবে ও পরিকল্পনাহীন রেলসড়ক নির্মাণের ফলে এসব নদী মরে গেছে।

ইউরোপ আমেরিকায় রেলপথগুলো নদীপথের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে আর আমাদের দেশে রেলপথ নদীগুলোর জন্য কাল হয়েছে। বর্তমান সময়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও একই ভূমিকা রেখে চলেছে। জঙ্গল কেটে, বাঁধ দিয়ে, বেড়িবাঁধ দিয়ে আমরা নদীর স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করছি। নদীতে নানা দূষণ এখনো তুঙ্গে। নদীর উভয় তীরে অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও নদীতে চলাচলরত নৌযানগুলো অবিরাম বর্জ্য ফেলে তাকে দূষিত করছে। বিষয়টি নদীর মাছ ও অন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ৫৪টা আন্তর্জাতিক নদী আছে, তার ৫৩টির পানি ভারত সরকার আটকানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে ভারত সরকার নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে পানির ঘাটতি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলোয় নিয়ে যেতে চায়। একটা মাত্র নদী গঙ্গা বা পদ্মা নদীর পানি প্রত্যাহার করার ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও সামাজিক যে করুণ পরিণতি ঘটছে, তা দিয়ে বর্তমানের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ভয়াবহতা অনুমান করা যায়। ফারাক্কার কারণে আমাদের অঞ্চলের নদীগুলো প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। পদ্মা নদীর শাখা মাথাভাঙ্গা নদীতে পানি না থাকার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ভৈরব, কুমার, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা, হরিহর, ভদ্রা, চিত্রা ইত্যাদি নদী ফসলের ক্ষেত আর দখলের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে বেঁচে আছে।


নদীমাতৃক বাংলাদেশের ৫৬ হাজার ৪৯৮ বর্গমাইল আয়তনের মধ্যে জলভাগের আয়তন ৩ হাজার ৬৬১ বর্গমাইল। দেশকে জালের মতো ঘিরে রাখা নদীর দৈর্ঘ্য ৮ হাজার ৪৬৫ মাইল। নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে নানা মতামত থাকলেও তা ২২৫ থেকে ৩০০-এর কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। চীন, ভুটান, নেপাল ও ভারতের ১ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অববাহিকার পানি নিষ্কাশনের আধার বাংলাদেশের এ নদীগুলো। প্রায় ছয় মিলিয়ন কিউসেক পানি এ নদীগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে।

প্রতি বছর প্রায় আড়াই বিলিয়ন টন পলি বহন করে নদীগুলো। অধিকাংশ নদীর উৎসমুখ আমাদের দেশের না হওয়ায় ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ভারত এসব নদীর উজানে কৃত্রিম বাঁধ ও তীর বরাবর গ্রোয়েন নির্মাণ করার ফলে ভাটিতে মৌসুমবিশেষে পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এক অঞ্চলে খরা দেখা দিলে পাশাপাশি আবার অন্য অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখা যায়। পরিবেশগত কারণের সঙ্গে ভাটিতে পানি প্রত্যাহারের ফলে নদীগুলো স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে পারছে না, পলি নদীতে থেকে যাচ্ছে।


নদী স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলায় বহুবিধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ কম হওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের পানি কমে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানি অনেকাংশে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে গাছপালা মরে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের সবুজ-শ্যামল কৃষিক্ষেত্র ও প্রাকৃতিক অপরূপ বনাঞ্চল ক্রমে ধূসর মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেশের সামগ্রিক নদী রক্ষায় এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই।


নদীর সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। নদী বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। জীবনের প্রাণশক্তি নদীর সঙ্গে নিহিত। বাংলাদেশের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নদী ঘিরে। আমাদের কৃষিনির্ভর জীবন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, হাটবাজার সবকিছুই নদীকে কেন্দ্র করে বিকশিত। এক কথায়, বাংলাদেশের মানুষের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতার সব স্মৃতি নদীকে নিয়ে। এমন প্রাণচঞ্চল নদীকে প্রাণহীন কে দেখতে চায়? নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়, ঐতিহ্য রক্ষায় নদীর নিজের চলার পথে মানবসৃষ্ট সব বাধা অপসারণ আজ কালের দাবি। দেশে নদীর সংখ্যা অগণিত হলেও কোনোটাই বিচ্ছিন্ন নয়। একে অন্যের সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে সুশৃঙ্খলভাবে সংযোজিত। তাই আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করে বলাই যায়, যশোরের পরিবেশ রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ভৈরব নদ যেমন গুরুত্ব বহন করে, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বৈচিত্র্যময় মনোহর রূপে ছড়িয়ে থাকা দেশের সামগ্রিক নদীগুলো।


যশোর-খুলনা এলাকার দীর্ঘতম নদ ভৈরব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় শ্রুতকীর্তি যেখানে পদ্মায় পড়েছে, তারই অন্য পাড়ে ভৈরবের জন্ম। বাংলাদেশে ভৈরব মেহেরপুর জেলার সুবলপুরে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে বের হয়ে চলা শুরু করে। বর্তমানে উৎসমুখের ক্ষীণধারার অবস্থা এতই করুণ, যা কোনো নদীর উৎস বলে মনে করা যায় না, প্রমত্ত ভৈরব তো নয়ই। এখন ভৈরব নদের উৎস চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের এক বিলে। এ বিলের পর থেকে এসে যশোরে প্রবেশ করে কোটচাঁদপুর পর্যন্ত পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে পরে দক্ষিণাভিমুখী হয়েছে। মেহেরপুর, দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, যশোর, বসুন্দিয়া, ফুলতলা, দৌলতপুর, খুলনা ইত্যাদি নদী তীরবর্তী জনপদ। দর্শনার বিলের পর থেকেই ভৈরবের চিহ্নটা আছে।

এলাকার মানুষের কাছে এককালের প্রমত্ত ভৈরব আজ শুধু স্মৃতিচিহ্ন। ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা নদী থেকে পানি মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রবেশের কোনো পথ না থাকায় ভৈরবের উৎসমুখ পানিশূন্য। বছরের সিংহভাগ সময়ই মাথাভাঙ্গা নদীর উৎসমুখ পদ্মা নদীর সর্বোচ্চ পানির লেভেলের প্রায় ৮-১০ ফুট উপরে থাকে। এমন অবস্থায় ভৈরবের উজানে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের আশা করা বাতুলতা মাত্র। এখন স্থানীয় বৃষ্টি ও নিম্নাঞ্চলের চুয়ানো পানি নদীর পানির একমাত্র উৎস।

২৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভৈরব নদ যশোরের বসুন্দিয়া থেকে ভাটিতে এখনো জীবিত। সেখানে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হয়। এর পর থেকে উজানের পুরো ভৈরব নদ প্রায় মৃত। ফসলের জমি আর দখলের রাজত্বে নদের প্রাণহীন কঙ্কাল পড়ে আছে। সংশ্লিষ্ট জনপদের মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নদের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে বারবার। কারণ সরকার নদী শাসনের নামে নদী হত্যা করে মানবসৃষ্ট প্রতিবন্ধতা তৈরি করেছে। ভৈরব নদে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প হিসাবে কারিগরি ভিত্তি ছাড়াই ৪৫টি ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছে।

যশোর শহরের এমাথা থেকে ওমাথা পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে দেখা যায় বিচিত্র কারিগরি স্থাপনাগুলো। হাউজিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট, সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ত্রাণ বিভাগ তাদের কারিগরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ৮০ থেকে ২০ ফুটের ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসনের দেশপ্রেমিক মাহাত্ম্য, রাজনৈতিক দাপট আর এদের সঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহারকারীদের অপকর্মে নদী দখলের পর ফসলের ক্ষেত ও পাকা স্থাপনা তৈরির ফলে নদের প্রশস্ততা আজ ২০ থেকে ২৫ ফুটে সীমাবদ্ধ। জাল যার, জলা তার কর্মসূচির আওতায় মৎস্য চাষের জন্য আড়ি বাঁধ কিছু লোকের উপকার করলেও নদের চরম সর্বনাশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে ভৈরবসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে।

মৃতপ্রায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রাণ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় জনগণ। জেলা প্রশাসনের দেশপ্রেমিক মাহাত্ম্য, রাজনৈতিক দাপট আর এদের সঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহারকারীদের অপকর্মে নদী দখলের পর ফসলের ক্ষেত ও পাকা স্থাপনা তৈরির ফলে নদের প্রশস্ততা কোথাও কোথাও আজ ২৫ থেকে ৩০ ফুটে সীমাবদ্ধ। কথায় আছে, জাল যার, জলা তার কর্মসূচির আওতায় মৎস্য চাষের জন্য আড়ি বাঁধ কিছু লোকের উপকার করলেও নদীর চরম সর্বনাশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসকে সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে তিতাসের প্রাণ ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ও শেষ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারী, বেসরকারী সংগঠন ও নোঙর যে কাজ করছে, তাতে কিছু জায়গায় কিছুদিনের জন্য পরিচ্ছন্ন তিতাস নদীকে পাওয়া গেলেও তা যে স্থায়ী হবে না, সে লক্ষণও এখনই দেখা যাচ্ছে। তিতাসে নৌকা ভ্রমণ করা গেলেও কচুরিপানা ভর্তি হয়ে থাকে অনেকাংশ। তিতাসে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ছাড়া নদীকে বহমান রাখা কঠিন।


আমরা জানি, ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ফারাক্কা ব্যারেজের বিকল্প হিসেবে পদ্মা ব্যারেজের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ থেকে ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে স্থান স্থির করে। ১৯৮০ সালে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করা হয়। এরপর মাঝেমধ্যে আলোচনার টেবিলে এলেও প্রকল্পটি এখন ডিপ ফ্রিজে আছে বলে মনে হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যায় কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ব্যারেজ নির্মাণ করা যায় না।


আজও পদ্মা ব্যারেজের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের এ অঞ্চলের নদীগুলোকে বাঁচাতে গড়াই ও মাথাভাঙ্গা নদীতে পানি প্রবেশের পথ সৃষ্টি করতে হবে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোয় প্রাণের সঞ্চার হবে। মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমার, নবগঙ্গা ইত্যাদি নদ-নদীর পানি পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে নির্মিত ব্যারেজে পানির উচ্চতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে মাথাভাঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য একটা নিমজ্জিত বাঁধের প্রয়োজন পড়তে পারে। পদ্মা ব্যারেজ নির্মাণ করতে পারলে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে প্রতি বছরের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করলে পদ্মা ব্যারেজ নির্মাণের অর্থ সংস্থান সহজ হয়ে যাবে।


আমাদের দেশে নদীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার মালিকানা নিয়ে। নদীকে ব্যবহার করে অনেকেই, কিন্তু তার কোনো মালিক নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী শাসনের কাজ করে, বিআইডব্লিউটিএ নদীতে নৌযান চালায়, স্থানীয় প্রশাসন দখলে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, সবাই ভোগে ব্যস্ত, লালনে কেউ নেই। ফলে নদীর ক্ষীণ হয়ে যাওয়া কেউ রোধ করতে পারছে না। এ অবস্থায় সরকার কর্তৃক নদী রক্ষা কমিশনকে দায়িত্বশীলভাবে সচল করা অত্যন্ত জরুরি। নদী রক্ষা কমিশনই নদী কোথায় কেমন ছিল এবং এখন কী আছে তা নিশ্চিত করতে পারবে। মালিকানা নির্ধারণ ছাড়া নদী রক্ষার উদ্যোগ হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো।


মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল নদীর তীরে। নদীর স্রোতধারায় মানুষ বিকশিত হয়েছে। আড়াই হাজার বছর আগের বাংলাদেশের তিন প্রাচীন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় ও লালমাই-ময়নামতি নদীর পাড় ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু সভ্যতা, চীনের সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতার মতো অনেক সভ্যতা বিশ্বে এসেছে নদী কেন্দ্র করে। নদীর বিবর্তনের কারণে অনেক সভ্যতা হারিয়েও গেছে। জনগণের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি লক্ষণীয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকা, চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখবে তা জোর দিয়েই বলা যায়। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী অবৈধ দখলের অজুহাতে সময়ক্ষেপণ নয়, বর্তমান স্রোতধারাকে ড্রেজিং করে উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। বহমান নদী তার চলার পথ নিজেই পরিষ্কার করে নেবে।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; চট্টগ্রামে কর্ণফুলী, সিলেটের সুরমা, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা, কুমিল্লার গোমতী, ঢাকার বুড়িগঙ্গা ইত্যাদি নদীর কাজ ও পরিস্থিতি একই। সে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসকে আলাদা করে দেখার খুব বেশি সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নদ-নদীর কথা বলে শেষ করা যাবে না। পরিবেশ রক্ষায় নদীর ভূমিকা, মানুষের জীবন-জীবিকায় তার ভূমিকা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে তার ভূমিকা অনন্য।

বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হিসাবের মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় নদীর ভূমিকা, মানুষের জীবন-জীবিকায় তার ভূমিকা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে তার ভূমিকা অনন্য। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হিসাবের মধ্যে এনেও নদী মানুষের প্রকৃত উপকারী, তা বলতে দ্বিধা থাকার কোনো কারণ নেই। তাই সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার স্বার্থেই শুধু নয়, এ বিস্তীর্ণ ব-দ্বীপের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই দেশের সব নদীকে বহমান রাখা দেশবাসীর কাম্য। (তথ্য সংগৃহীত)।

লেখক: মোঃ মিজানুর রহমান, নোঙর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে