রাজঘাট

0
775
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসের পূর্ব পাড় বিজয়নগর। ছবি: শিপন কর্মকার

আমার শৈশব-কৈশোর স্মৃতির সাথে নিবিড় ভাবে বিজড়িত তিতাস নদীর পাড় ঘেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিমরাইলকান্দি নামক স্থানে অবস্থিত “রাজঘাটের” কথা বলছি।প্রাণবন্ত এই ঘাট কে এখন আর “রাজঘাট” নামে চিনে না নতুন প্রজন্ম।

ঘাট থাকলেও নেই সেই আগের ব্যস্ততা। সারাদেশের মতো এখানেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।তিতাসের বুকচিরে চলছে ব্রিজের কাজ, ব্রিজের সাথে ফসলী জমির বুকে পুরোদমে কাজ চলছে শেখ হাসিনা সড়ক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিমনা সড়ক) ব্রিজ আর সংযোগ সড়কটি বিজয়নগর উপজেলাকে সংযুক্ত করবে সদরের সাথে, এটা ছিলো বিজয়নগরবাসীর প্রাণের দাবী।

তিতাসের পূর্ব পাড় বিজয়নগর নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা সড়কছবি: শিপন কর্মকার

মাত্র কয়েক বছর আগেও নৌকাযোগে মালামাল আসতো এই রাজঘাটে। বিশেষ করে তিতাস পূর্বাঞ্চলের শাক-সবজি, ফলমূল রাজঘাট থেকে ঠেলাগাড়িযোগে চলে যেতো শহরের বিভিন্ন বাজারে। এলাকার অনেকেরই জীবিকা ছিল এ ঠেলাগাড়ি। অনেক সময় ঘাট থেকে সড়কে উঠতে গেলে আমারাও ঠেলে দিতাম শখ করে।

তিতাসের পূর্ব পাড়েই ছিলো বেশ কয়েকটি ইটভাটা আর ইটভাটার শ্রমিকদের জন্য ছিলো তাদের নিজস্ব খেয়া পারাপার। এই ছোট্ট নৌকা দিয়ে আমরাও ইটভাটা দেখতে যেতাম। পাশেই ছিলো ফসলী জমি। ধান কাটা শেষ হলে শুরু হতো আমাদের ফুটবল খেলা, ইটভাটা গুলো বিলুপ্ত হয়েছে বেশ আগেই।

তিতাস নদীর পূর্ব পাড়ে বিজয় নগর নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা সড়ক।ছবি: শিপন কর্মকার

আমি তখন প্রাইমারির ছাত্র। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরে বই-খাতা রেখেই সেই চিরচেনা রাজঘাটে, তখন এলাকার সবাই গোসল করতো তিতাসেই। আমরা তো ঘন্টা তিনেকের আগে উঠতাম-ই না।একজন আরেক জনকে চোখ দেখাতাম, দেখ তো আমার চোখ লাল হয়েছে কিনা।

পানির খেলা গুলো ছিলো খুবই মজার। তখন তিতাসে বৈশাখে পানি কম থাকলেও বর্ষায় কিন্তু সাগরের রূপ নিতো, বর্ষায় তো নদীতে নামাই যেতো না ঢেউ আর স্রোতের কারনে। কখনো কখনো শুশুকের খেলা দেখা যেতো। রাতে কিন্তু তিতাসের ঢেউয়ে সাগরের ঢেউয়ের মতো গর্জন শোনা যেতো। এ সবই এখন অতীত।

বিজয়নগর শেখ হাসিনা সড়কের পাশে ছোটো একটি শাখা নদী। ছবি: শিপন কর্মকার

রাজঘাটে ছোট্ট একটা সংযোগ খাল ছিলো। বর্ষায় পানি থই থই করতো। তখন নদীতে নামার সাহস পেতাম না আমরা খালেই গোসল করতাম, গামছা দিয়ে মাছ ধরতাম। নদীর মতোই খালের পানি ছিলো স্বচ্ছ। তখন যাত্রী আর মালবাহী নৌকা গুলো খালেই নোঙর করতো।

খালের উপর ছিল ছোট্ট একটি রেলসেতু, তখন রেলযোগে মালামাল আসতো খাদ্য গোদামে, রেল লাইন আর সেতুটি এখন পরিত্যক্ত।সেতু আর নোঙর করা নৌকা থেকে অনেক লাফালাফি করেছি। শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার সময় খালের প্রবেশ মুখে করা হয়েছে সুইস গেইট।

শিমরাইলকান্দি রাজঘাটে নির্মাণাধীন সেতু। ছবি: শিপন কর্মকার

খালে আর পানি আসে না খালের জায়গাগুলো কয়েক বছরেই বেদখল হয়ে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। খালের পাশেই ছিল আমাদের খেলার মাঠ ।এখন আর খেলাধুলার কোন সুযোগ নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে বিশাল মাদ্রাসা। আমরা সেখানে বছরে দুটো ঈদের জামাত আর কেউ মারা গেলে জানাযার নামাজ আদায় করি। আমার জানাযাও হয়তো সেখানেই হবে। চারিদিকে কাঁটা তারের বেড়া, যদিও জায়গাটির মালিকানা বাংলাদেশ রেলওয়ে।

তিতাস নদীর পূর্ব পাড়ে এতো বসতি ছিলো না কয়েকটি বাড়িঘর ছাড়া। শুকনো মৌসুমে এপাড় ওপাড় উভয় পাড়েই ছিলো নৌকা তৈরি আর মেরামতের কাজ, শেষে দেয়া হতো আলকাতরার প্রলেপ আলকাতরার গন্ধটা বেশ ভালো লাগতো আমার। ভাঙ্গা নৌকা গুলোতে খেলাধুলা করতাম আমরা মাঝেমধ্যে নৌকার কারিগরদের হুক্কায় দিয়েছি টান এ জন্য মার খেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার।

রাজঘাট ঘেষা খাল, শিমরাইলকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ছবি: শিপন কর্মকার

আমি এখনো স্বপ্ন দেখি সেই রাজঘাট, ছোট্ট খাল, তিতাসের স্রোত, ঢেউ, শুশুকের খেলা, আমার খেলার মাঠ। সভ্যতা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয় বরং প্রকৃতিকে ভালোবেসেই গড়তে হবে সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

ভালো থাকুক বাংলাদেশ, ভালো থাকুক প্রিয় তিতাস, ভালো থাকুক আমার রাজঘাট।

লেখক : শামীম আহমেদ
সভাপতি, নোঙর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে