ভারতের করোনা উৎসব

0
307

রোববার মোমবাতি জ্বেলে চিকিৎসকদের সম্মান জানানোর কথা ছিল। কিন্তু দেশ জুড়ে যা হল, তাতে শ্রদ্ধার থেকে বেশি ছিল উৎসবের মেজাজ। স্বাস্থ্যকর্মীরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।

কোনও ভূমিকায় না গিয়ে রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কয়েকটি টুকরো টুকরো ঘটনা দিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়া যাক লেখায়। ১৩০ কোটির ভারতে রোববার ছিল বিশেষ একটি দিন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে এ দিন রাত নয়টায় হিমালয় থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিপুল ভারত প্রদীপ জ্বালিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। সংহতি প্রকাশ করেছেন। সত্যি সত্যি করেছেন কি? ঘটনা পরম্পরা কিন্তু সে কথা বলছে না।

দিল্লির সাকেত অঞ্চলে রোববার সকাল থেকেই একটি গোলযোগের খবর আসছিল। সরাসরি সেখানে পৌঁছে জানা গেল, উচ্চ মধ্যবিত্ত একটি হাউজিং সোসাইটিতে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন এক বিখ্যাত হাসপাতালের বেশ কয়েকজন নার্স। তাঁদের মাধ্যমে সোসাইটিতে করোনা ভাইরাস ঢুকে যাবে এই ভয়ে তাঁদের বাসা ছাড়া করা হয়েছে। না, শুধু বাসা নয়, একেবারে পাড়া ছাড়া। কথায় কথায় কমপ্লেক্সের এক তরুণ শিক্ষিত জানালেন, ওই নার্সদের মধ্যে কয়েকজন ‘চিঙ্কি’ও ছিল। অনেক আগেই তাঁদের বার করে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, ‘চীনা ভাইরাস’ তাঁরাই ছড়াচ্ছেন। ভারতবর্ষে ‘চিঙ্কি’ শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের মঙ্গোলয়েড চেহারার সকলকেই ওই নামে ডাকা হয়। শব্দটি যে খেউড়, তা বহু বছর আগেই বিস্মৃত হয়েছে মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ ভারতবাসী। এবং তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, মঙ্গলয়েড চেহারা মানেই চীনা এবং চীনা মানেই করোনা।

বাড়ি থেকে কার্যত এক কাপড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া ওই নার্সরা এখনও নতুন বাড়ি পাননি। বন্ধুদের আশ্রয়ে আছেন। প্রবল অসম্মান এবং অপমান সত্ত্বেও রোববার তাঁরা কাজে গিয়েছিলেন। সেবা ধর্ম থেকে বিচ্যূত হননি। আর যাঁরা সকাল সকাল নার্সদের তাড়িয়ে ছাড়লেন, ঠিক রাত ন’টায় প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মেনে তাঁরা কেবল বারান্দায় চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি সংহতি জানানোর মোমবাতিই জ্বালালেন না, ছাদে উঠে ধুঁয়াধার বাজিও ফাটালেন। যে কোনও দিওয়ালিতে দূষণ উপেক্ষা করে প্রতি বছরই তাঁরা যা করে থাকেন।

বস্তুত, শুধু দিল্লি নয়, রোববার রাতে কার্যত উৎসবের চেহারা পেয়েছিল গোটা দেশ। মাঝ রাত পর্যন্ত বাজি ফেটেছে। সোশ্যাল আইসোলেশনকে বৃদ্ধঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মশাল হাতে রাস্তায় নেমে মিছিল হয়েছে। থালা, বাসন, করতাল সহযোগে চিল চিৎকার সহযোগে স্লোগান উঠেছে– ‘গো, করোনা গো’। কেউ কেউ আরও উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিয়েছেন, ‘জয় মোদী, শাহের জয়’, এমনকী, ‘জয় শ্রীরাম’ও।

কলকাতার একটি সরকারি হাসপাতালের এক জুনিয়ার ডাক্তারের ফোনও এসেছিল রোববার রাতেই। জানালেন, গোটা দেশ যখন ‘করোনা উৎসবে’ মত্ত, তাঁরা তখনও হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন করোনার সঙ্গে লড়াই করার ন্যূনতম পোশাক। পাননি। সরকারের তরফ থেকে তাঁদের ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সস্তা রেনকোট। সেটা পরেই নাকি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরতে হবে এবং করোনার রোগী দেখতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই জুনিয়র ডাক্তারও দিন কয়েক আগে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। বাড়িওয়ালা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, চিকিৎসককে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাল কেটে করোনা ঢোকাতে পারবেন না।

কলকাতার ওই ডাক্তার রোববার যা বলছিলেন, তা যেন কপি-পেস্টের মতো মিলে গেল দিন কয়েক আগে দিল্লির এক গর্ভবতী চিকিৎসকের বয়ানের সঙ্গে। গর্ভবতী অবস্থাতেই নিরন্তর পরিষেবা দিতে গিয়ে ওই চিকিৎসকও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আইসোলেশনে যাওয়ার আগে একটি কথাই কেবল বলেছেন তিনি, হাততালির দরকার নেই, মোমবাতিরও দরকার নেই, চিকিৎসকরা যেন ন্যূনতম সরঞ্জাম গুলি পান।

শুধুই কি তাই? এই চিকিৎসকরাই গত শুক্রবার মার খেয়েছিলেন না মধ্যপ্রদেশে? তাঁদের দোষ ছিল, ইন্দোরের এক মহল্লায় করোনা সংক্রমণ হয়েছে এই আশঙ্কায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষা করতে যাওয়া। এলাকায় ঘিরে ধরে তাঁদের উপর ইটবৃষ্টি হয়েছে। রড, লাঠি, উইকেট দিয়ে তাঁদের পেটানো হয়েছে। যাঁরা পিটিয়েছেন, রোববার রাতে পরম যত্নে তাঁরা করোনা উৎসব করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁরাই আগামী দিনে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের উপর চড়াও হবেন। ডাক্তারকে মেরে কোমায় পাঠিয়ে দেওয়া তাঁদের অধিকার বলে মনে করেন এই ভদ্রমহোদয়কূল।

তা হলে কীসের উৎসব হল রোববার? সত্যি সত্যি সংহতি জানানো হল তো?

কালোয়াতি গান চালিয়ে হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালানো তুমুল নৃত্যরত এক দিল্লিবাসীকে প্রশ্ন করাতেই সটান উত্তর এলো,”করোনা তাড়ানোর উৎসব।” না, তিনি অশিক্ষিত, গরিব নন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। সংহতি টংহতি তাঁরা জানেনও না, মানেনও না। ও সব কথার কথা। বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর কথা মেনে বাতি জ্বেলে, বাজিয়ে পুড়িয়ে ‘গো, করোনা গো’ বললে কোনও এক অজ্ঞাত অতিপ্রাকৃতিক শক্তি দেশ থেকে করোনা ভাইরাসকে ফুসমন্তরে তাড়িয়ে দেবে। সে জন্যই তো রোববার গোটা দেশ জুড়ে করোনা নিধন হোম হয়েছে, যজ্ঞ হয়েছে। তাতে অংশ নিয়েছেন বর্তমান শাসক দলের বহু নেতা-কর্মীও। জনগণকে তাঁদের অনেকেই বুঝিয়েছেন, রীতিমতো পাঁজি পঞ্জিকা দেখে রোববার রাত ন’টার তিথি নির্বাচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ন’মিনিটের উৎসব সমস্ত রোগ নির্মূল করে দেবে। ওই নেতাদেরই তো অনেকে রাস্তায় নেমে করোনার মশাল মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন! রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্দুক ফাটিয়ে উল্লাস করেছেন! জনগণও মেনে নিয়েছেন। নেতাদের পদাঙ্ক অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কার্যত অকাল দিওয়ালি পালন হয়েছে রোববার। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কেবল কলকাতাতেই ৬ কোটি টাকার বাজি ফেটেছে।

গোটা পৃথিবী জুড়েই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি সম্মান জানাতে, সংহতি প্রকাশ করতে হাত তালি দেওয়া হচ্ছে। মোমবাতিও জ্বালানো হচ্ছে। গান গাওয়া হচ্ছে। সেই উদযাপনে উৎসব নেই, শ্রদ্ধা আছে। উল্লাস নেই, সহমর্মিতা আছে। কারও নির্দেশে নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁরা সে কাজ করছেন। বস্তুত, সরকারের কাজও নয় এ সব। এই মুহূর্তে সরকারের কাজ অর্থ দিয়ে, সরঞ্জাম দিয়ে চিকিৎসা কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। অভিযোগ, সরকার সেই আসল কাজে ফাঁকি রেখে উৎসবের রঙে ভুলিয়ে রাখছে দেশের জনগণকে। স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে