তুরাগ নদীর প্লাবনভূমিতে দেশের প্রথম পানি-ভিত্তিক শহর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক।

0
593

ঢাকার অন্যতম নিম্নাঞ্চল ও ‍তুরাগ নদীর প্লাবনভূমিতে দেশের প্রথম পানি-ভিত্তিক শহর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ২০০০ সালের জলাধার আইনের লঙ্ঘন হবে। কারণ ওই আইন অনুযায়ী, প্লাবনভূমিতে কোনো প্রকার অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ, সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণের সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করতে গত ১৯ নভেম্বর চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনের (সিআরবিসি) সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে রাজউক। এই কাজের জন্য তারা কোনো অর্থ নেবে না।

সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, কনজারভেশন অব ফ্লাড ফ্লো জোন অ্যান্ড কমপ্যাক্ট টাউনশিপের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণের কাজ আগামী নভেম্বরের মধ্যে রাজউকের কাছে জমা দেওয়া হবে। এই তথ্য বেনারকে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম।

তিনি জানান, রাজধানীর আমিনবাজার থেকে শুরু করে আশুলিয়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে দেশের দ্বিতীয় স্মার্ট শহরটি নির্মিত হবে। আর এটিই হবে দেশের প্রথম পানি-ভিত্তিক শহর।

প্রকল্পটির আয়তন ও বাজেট সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন পাওয়ার পর নির্ধারণ করা হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “প্রকল্পটির মোট আয়তনের ৬২ ভাগ জমিতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকবে, ১০ ভাগ থাকবে আবাসিক সুবিধা। আর বাকি এলাকায় পানি-ভিত্তিক বিভিন্ন বিনোদন ব্যবসা গড়ে তোলা হবে।”

আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ওই সমীক্ষা অনুযায়ী আমরা দরপত্র আহ্বান করে স্বচ্ছ উপায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করব বলে আশা করছি।”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রথম স্মার্ট শহর পূর্বাচল বাস্তবায়ন করছে রাজউক। সেখানকার পানি ব্যবস্থার কাজ করছে চীনারা।

জলাধার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক শাহ আলম খান বেনারকে বলেন, “২০০০ সালে সংসদে পাশ হওয়া জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী আমাদের প্লাবনভূমিতে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। সেই আইন বিবেচনা করলে সরকারের পূর্বাচলসহ অন্যান্য আবাসন প্রকল্পগুলো আইনের লঙ্ঘন। সরকার নিজেই জলাধার আইন মানছে না।”

তিনি বলেন, “ঢাকার আশপাশের ফ্লাডপ্লেইনগুলো রক্ষা করা খুব প্রয়োজন। এখানে অবকাঠামো নির্মিত হলে ঢাকার পানিগুলো বের হতে পারবে না; জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে।”

“তুরাগ নদী দিয়ে ঢাকা ও আশপাশের পানি চলে যায়। এখানে যদি কোনো শহর নির্মাণ করা হয় তাহলে সেটি একটি বড় বিপদের কারণ হতে পারে,” যোগ করেন অধ্যাপক শাহ আলম।

তবে জলাধার আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “তুরাগ তীরে প্লাবনভূমি রক্ষার জন্যই এই প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “বালু দিয়ে প্লাবনভূমি ভরাট থেকে তুরাগকে রক্ষা করতে আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি।”

“কারণ এই প্লাবনভূমি ব্যক্তিমালিকানাধীন। আমরা জমিগুলো কিনে না নিলে তারা বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হবে। আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো বালু দিয়ে সেগুলো ভরাট করবে। ফলে একসময় পুরো ঢাকা জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হবে,” যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক।

তাঁর মতে, আইন লঙ্ঘন করে ইতিমধ্যে তুরাগ তীরের ২০ হাজার একরের মতো জমি বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। প্রতিদিনই এই কাজ চলছে। এভাবে চলতে থাকলে পুরো তুরাগ প্লাবনভূমি দখল হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, “তুরাগ তীরের মানুষদের একটি বড় অংশের জীবিকা মাছ ধরা। নতুন শহরটির জলাধারে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ব্যবস্থা থাকবে। এর ফলে সেখানকার মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”

“আবার সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকল্পটি টেকসই হবে” যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক।

বিনা খরচে সমীক্ষা বিতর্ক

চীনা কোম্পানি দিয়ে বিনা পয়সায় সম্ভাব্যতা যাচাইর কাজ করানোতে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, বিনা খরচে কোনো কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করালে মনে হতে পারে যে সমীক্ষা শেষে ওই কোম্পানিকেই প্রকল্পের কাজ দেয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “রাজউক বিনা পয়সার কাজটি করাবে কেন? বিনা খরচে কোনো কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করালে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে যে ওই কোম্পানিকেই কাজ দেয়া হবে।”

“কাজটি স্বচ্ছভাবে করা উচিত,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রাজউক সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণের কাজটি নিজে করতে পারত অথবা অর্থ ব্যয় করে অন্য কাউকে দিয়ে কাজটি করাতে পারত।”

“রাজউক যদি তুরাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় তাহলে সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণের কাজটি তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হতে হবে,” বলেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর।

এদিকে বিনা খরচে সম্ভাব্যতা যাচাই করার পর সিআরবিসিকে প্রকল্পের কাজ দেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক বেনারকে বলেন, “তাদের কাজ দেবো এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি।”

তবে “এটি একটি বিশাল প্রকল্প হবে,” মন্তব্য করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন বেনারকে বলেন, “চীনারা বিনা পয়সায় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি করে দিচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে তারা কাজটি পেতে পারে এই আশায়।”

এদিকে বেনারের পক্ষ থেকে সিআরবিসি’র ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করেও তুরাগ নদীতে সমীক্ষা বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে