ভারতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন এবং দেশ জুড়ে নাগরিকপঞ্জী তৈরির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দিল্লিতে আজ যে বৈঠক ডেকেছিল, অনেক বিরোধী দলই তা বয়কট করেছে।
মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি ওই বৈঠকে যোগ না-দেওয়ার পর যথারীতি প্রশ্ন উঠছে, বিরোধীরা কি আদৌ ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারবেন?
পর্যবেক্ষকরা অবশ্য অনেকেই বলছেন, ভারতে নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদে আগাগোড়াই নেতৃত্ব দিচ্ছে নাগরিক সমাজ – রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা সেখানে বেশ গৌণ।
গত প্রায় এক মাস ধরে ভারতে নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে যে তুমুল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে, তাতে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ভূমিকা একেবারেই নিষ্প্রভ ছিল – এই অভিযোগ বারে বারেই উঠছে।
এই আন্দোলনকে বিজেপি সরকার যেমন কড়া হাতে দমন করতে চাইছে, কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী কিছুদিন আগে অবশ্য তার নিন্দা করেছিলেন – তাও সেটা রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায়।
আর যখন তিনি যৌথ অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করার লক্ষ্যে দিল্লিতে সব বিরোধী দলকে আমন্ত্রণ জানালেন, দেখা গেল মমতা ব্যানার্জি-মায়াবতী-কেজরিওয়ালের মতো অনেকেই সেখানে অনুপস্থিত।
অথচ এই মায়াবতীই কিছুদিন আগে নাগরিকত্ব আইনকে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী ও অসাংবিধানিক’ বলে বর্ণনা করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন, “বিজেপি জেদ ধরে থাকলে তাদের পরিণতি হবে জরুরি অবস্থার পরের কংগ্রেসের মতো।”
সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাও বলেছেন, “আমাদের আন্দোলনের ফলে সরকার অবশ্যই চাপের মুখে পড়েছে – এবং তারা সম্পূর্ণ নতি স্বীকার না-করা পর্যন্ত এই আন্দোলন জারি থাকবে।”
লোকসভায় রাজীব গান্ধী চারশোরও বেশি এমপি নিয়েও যা পারেননি, শ’তিনেক এমপি নিয়ে বিজেপি কীভাবে এই চাপ সামলাবে সে প্রশ্নও তুলেছেন মিস ব্যানার্জি।
কিন্তু যখন বিরোধী ঐক্যের প্রশ্ন এল, তখন দেখা যাচ্ছে এই নেতা-নেত্রীরা সবাই লড়ছেন নিজের নিজের জায়গা থেকে – কোনও যৌথ প্ল্যাটফর্ম থেকে নয়।
দিল্লির বৈঠকে যোগ দেওয়া বামপন্থীরা তো সরাসরি মমতা ব্যানার্জিকে বিজেপির বি-টিম বলেও আক্রমণ করছেন।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “দিল্লিতে বিজেপির বিরুদ্ধে বৈঠক তিনিই বয়কট করবেন, যিনি বিজেপির বিরোধিতায় আসলে বিশ্বাস করেন না।”
“পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ডাকা ধর্মঘট কেন সফল হয়েছে, এই দু:খে কেউ যদি বলেন আমি বিরোধীদের বৈঠকে দিল্লি যাব না – তাহলে সেটাকে ছেলেমানুষি বলবেন না সেয়ানাগিরি বলবেন আপনারাই ঠিক করুন!”, বলেছেন তিনি।
রবিবার কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার পর মমতা ব্যানার্জিকে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ‘মোদীর দালাল’ বলে গালিগালাজও শুনতে হয়েছে।
কিন্তু বিরোধীদের মধ্যে এই ধরনের তিক্ত বিভক্তি আন্দোলনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোমা চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “দেশের মানুষ যেভাবে সংবিধানের পক্ষে দাঁড়িয়েছে সেই নাগরিক আন্দোলনের দৃষ্টিতে এটা অবশ্যই পরিতৃপ্তির – কিন্তু এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা আগাগোড়াই ছিল হতাশাব্যঞ্জক।”
“পার্লামেন্টেও তারা এর বিরুদ্ধে তেমন কোনও প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। বস্তুত বিরোধী দলগুলি সিএএ নিয়ে খুবই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে – এমন কী তাদের ভোটও ছিল বিভক্ত।”
“এনআরসি বিরোধিতার প্রশ্নে এখন মোটামুটি একটা ঐকমত্য হলেও নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তাদের অনেকের মধ্যেই এখনও বিভ্রান্তি বা সংশয় আছে,” বলেন সোমা চৌধুরী।
মিস চৌধুরীর মতে, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধিতা তারা করছে না – শুধু মুসলিমদের এর বাইরে রাখার বিরোধিতা করছেন – বিরোধীরা যতক্ষণ না এই ন্যারেটিভ সফলভাবে পেশ করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস পাবে, ততক্ষণ এই আন্দোলনে ‘সঠিক রাজনৈতিক মোমেন্টাম’ যোগ হওয়া খুব মুশকিল।