ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র-তরুণরা প্রতিবাদ- বিক্ষোভ করছেন, তারা আসলে আইনটা না বুঝেই তা করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য কোনও মহল থেকে তাদের ভুল বোঝানো হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন মি. মোদী।
কলকাতারা প্রাণকেন্দ্রে যখন শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রী – যুবক এবং বহু সাধারণ মানুষ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিক্ষোভে রাত জাগছে, তার মধ্যেই মি. মোদী এক ভাষণে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পক্ষে নিজের মত আবারও জানানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন জাতীয় যুব দিবসের ভাষণ মঞ্চ।
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে কলকাতার কাছেই বেলুড় মঠে ওই ভাষণে তিনি বলেন, “দেশে, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে এখন একটা চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ। এই আইনটা কী, কেন এই আইন আনা জরুরি ছিল – সে ব্যাপারে যুবসমাজের মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যুবসমাজের বহু মানুষ এটা বুঝেছেন।”
“কিন্তু এরকমও অনেকে আছেন, যারা ভুল বুঝছেন, গুজবের শিকার হয়েছেন। তাদের বোঝানোটাও আমাদের সবার দায়িত্ব। সেজন্যই দেশের – বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপূর্বের যুবসমাজকে কিছু জরুরি বিষয় বলা উচিত তার নিজের,” বলছিলেন মি. মোদী।
এরপরেই তিনি একে একে ব্যাখ্যা করেন যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে তৈরি হওয়া পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে ৭০ বছর ধরে কীভাবে অত্যাচার হয়েছে।
সে দেশের সংখ্যালঘু মা বোনেদের কীভাবে ইজ্জতহানি হয়েছে এবং শুধু যে সেইসব কথিত অত্যাচারের শিকার হওয়া মানুষদেরই ভারতের নাগরিক হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে, কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার জন্য এই আইন নয়, সেটাও বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মোদী ভাষণ শুনতে হাজির হওয়া মানুষদের প্রশ্ন করেন, “দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানে যেসব মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের কী মরার জন্য সেদেশে ফেরত পাঠানো উচিত?”
কয়েক হাজার ছাত্র-যুবক সমস্বরে তার বক্তব্য সমর্থন করেন।
তারপরেই নরেন্দ্র মোদী বলেন, “যেটা আপনারা বুঝতে পারছেন, কমবয়সী ছাত্ররাও বুঝে গেল। কিন্তু সেটাই রাজনীতির খেলোয়াড়রা বুঝেও বুঝতে চাইছে না। এত কিছু স্পষ্ট করে বারবার বলা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে লাগাতার ভুল ছড়াচ্ছেন।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই মি মোদী কী কী বলেছেন বেলুড় মঠে, তা জানতে পেরে যান এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে রাতভর বিক্ষোভরত ছাত্র-যুবরা।
তারা তখনও মোদীবিরোধী এবং নাগরিকত্ব আইন বিরোধী স্লোগান দিয়ে অবরোধ করে রেখেছিলেন এসপ্ল্যানেড অঞ্চল।
শনিবার দুপুর থেকে প্রায় ২৪ ঘন্টা ধরে বিক্ষোভ অবস্থান করেছেন তারা শীতের রাতে। কিন্তু তাদের কথায় আর স্লোগান দেওয়ায় ক্লান্তি ছিল না।
এক ছাত্রী বলছিলেন, “শীতের রাতে রাজপথে বসে থাকাটা কষ্টকর তো বটেই, কিন্তু নাগরিকত্ব আইন সম্পূর্ণভাবে চালু হয়ে গেলে বা এন আর সি শুরু হলে যে কষ্টে পড়ব, তার থেকে রাস্তায় রাত জাগাটা কম কষ্টের।”
এক ছাত্রী অন্বেষা রায়ের কাছে মি. মোদীর ভাষণের প্রসঙ্গে তুলতেই তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথা বলছেন উনি, তাই ওঁর কাছে আমি জানতে চাই পাকিস্তানের আহমেদিয়ারা বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা তাহলে কী দোষ করল? তাদের কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না! তারাও তো ওইসব দেশে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত।”
“আসলে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই ওদের কাছে। যেখানে গোটা ভারতের লাখ লাখ লোক প্রতিবাদ করছে, সবাই একসঙ্গে ভুল বুঝেছে বলতে চান তিনি?” প্রশ্ন অন্বেষা রায়ের।
বিক্ষোভরত এক ছাত্র প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের ওই প্রসঙ্গটি তুলে ধরলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন যে রাজনৈতিক কারণে ছাত্র-যুবদের ভুল বোঝানো হচ্ছে।
“কাল থেকে যে আমরা রাস্তায় বসে আছি, সেখানে কোনও রাজনৈতিক দলেরই পতাকা নেই। আমরা উপলব্ধি করেছি বলেই রাস্তায় নেমেছি। কোনও রাজনৈতিক দল আমাদের ভুল বোঝাবে আর আমরা রাত জেগে রাস্তায় পড়ে থাকব?” বলছিলেন ওই ছাত্র।
পাশেই দাঁড়ানো এক ছাত্রী বলছিলেন, “আমরা সিএএ আইনটা পড়েছি। এনআরসি-টা জেনেছি। আর ইতিহাসটাও পড়েছি। সব জেনে বুঝেই প্রতিবাদে নেমেছি। কেউ আমাদের ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামায় নি।”
সুদূর নদীয়া থেকে কলকাতার বিক্ষোভে যোগ দিতে এসেছিলেন এক ছাত্র মইদুল শেখ। তিনি ব্যঙ্গ করে বললেন, “দেশের বড় বড় আমলা, অফিসার, অক্সফোর্ড, হার্ভাড, জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এত ছাত্র-ছাত্রী-অধ্যাপক সবাই ভুল বুঝেছে – শুধু ভক্তরাই ঠিক বুঝেছে!”
ওদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলগুলির ছাত্রদের একাংশ সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন যে চিরকাল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও নরেন্দ্র মোদীর মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে কী ভাবে মঠে রাত্রিবাস করতে দেওয়া হল, তা নিয়ে।
ঘটনাচক্রে, ৬০এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অল্পবয়সী নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের এক রামকৃষ্ণ মিশনে হাজির হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু সেই সময়ে মিশনের সিনিয়র সন্ন্যাসীরা তার সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। সূত্র: বিবিসি