নদীর পরিবেশ সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করতে হবে

1
534

শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০১৯,(নোঙরনিউজ) : আজ সকাল ১১ ঘটিকায় বছিলা বারৈখালীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নদী নিরাপত্তারর সামাজিক সংগঠন নোঙর “নদীর পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের করণিয়” শীর্ষক এক মত বিনিময় সভার আয়োজন করে।

নোঙর সভাপতি সুমন শামস এর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন দেশের বিশিষ্ট পরিবেশ কর্মীরা।

সুমন শামস বলেন, মাতৃক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে নদীর পানিতে বয়ে আনা ক্ষুদ্র পলিমাটি দিয়ে। লক্ষ লক্ষ্ বছরের প্রক্রিয়ায় পলি সঞ্চয় করে নদী নিজেই গড়ে তুলেছে ‘ব’ আকৃতির বাংলাদেশ।

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের প্রধান নদীগুলো তার যৌবন হারাচ্ছে, শাখা নদী, উপনদীগুলো মরে বিলীন হয়েছে। কারণ নদীর বুকে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে সম্পদের মালিক হেয় নদীকে দূষণ করে নদীকে হত্যা করা।

অথচ বাঙালীর জীবনধারণ, ইতিহাস-ঐহিত্য, সংস্কৃতি সবই নদী মিশ্রিত, নদী আশ্রিত। নদীর ভাঙ্গাগড়ার ভেতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে বাঙালীর জীবনধারা, পেয়েছে নিজস্বতা।

নদীর জলে অবগাহন-পরিশুদ্ধি, নদীর জলে চাষাবাদ, মিঠা পানির মাছ, নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ যুগে যুগে বাংলাকে করেছে আনেক সমৃদ্ধ। নদী নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়েছে, আমরা শুধুই নিয়েছি আর নদী বিলীন হয়েছে!

তিনি আরো বলেন, যেসব কারণে নদী মরে যাচ্ছে এবং দখল হচ্ছে তা প্রতিরোধ করতে হবে শক্তভাবে। যত্রতত্র উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিয়ে নদীবান্ধব প্রকল্প নিতে হবে। নদীর দূষণ ঠেকাতে হবে। উজানে যেসব নদীর ওপর ভারতসহ অন্য দেশ বাঁধ দিয়েছে ও দিচ্ছে আলোচনা করে সেসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। নদী শাসনের বদলে নদীর সঙ্গে সহাবস্থান করার পদক্ষেপ নিতে হবে। যত্রতত্র বাঁধ, পোল্ডার, স্লুইচ গেট দিয়ে নদী শাসনের নামে নদী হত্যা বন্ধ করতে হবে। নদীর দখলবাজি শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক মিহির বিশ্বাস বলেন, নদী রক্ষায় ‘নদী নীতি’ করা এখন সময়ের জোরালো দাবি। এই দেশে বহু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নীতি থাকলেও নদী নিয়ে এখনো নীতিমালা নেই! শুধু নীতি করলেই চলবে না, সেই নীতি বাস্তবায়নে সংসদে আইন পাস করতে হবে। সরকার শক্ত হলে নদী রক্ষা পাবে। কারণ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী দখল করে থাকেন সাধারণত সরকারী দলের স্থানীয় নেতারা।

পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি আমির হোসেন মাসুদ বলেন, নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আমাদের দেশে আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন। কিন্তু তা দিয়েও নদী রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, নদী রক্ষায় কমিশনের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। আইনটিও অত্যন্ত দুর্বল। নদীর দখল, দূষণ ও অবকাঠামো নির্মাণ হলে তা ঠেকাতে শুধু সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে নদী রক্ষা কমিশন। দোষীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। দ্রুত আইন সংশোধন করে নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি ওই আইন বাস্তবায়নে নদী আদালত গঠন করতে হবে।

সচেতন নগরবাসীর সভাপতি জনাব রুস্তুম খান বলেন, গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সবখানেই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে, অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধের সব ব্যবস্থা নিতে হবে পরিবেশ অধিদফতরকে। আর জলাভূমির লিজ বন্ধ করতে হবে ভূমি মন্ত্রণালয়কে। সেইসঙ্গে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে মৎস্য অধিদফতরকে। আর আন্তঃদেশীয় নদীতে পানির প্রবাহ বাড়াতে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।

পরিবেশবাদী জনাব মোহাম্মদদ সেলিম বলেন, যারা নদী দখল ও দূষণ করছে তারা প্রভাবশালী। ওই প্রভাব ভেঙ্গে দিয়ে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে নদী দখল বন্ধ হবে। তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। নদী রক্ষায় সরকারকে সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

নদী ভরাটের অন্যতম কারণ উজান থেকে নেমে আসা পলি। তাই নদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্য রক্ষা করতে হবে। সেইসঙ্গে প্রতিবছর সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করতে হবে। গঙ্গা ব্যারাজ করতে পারলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পানি বর্ষায় জমিয়ে রাখা সম্ভব হবে। সেই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে শুল্ক মৌসুমে নদীর নাব্য কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব হবে।

নোঙর এর ঢাকা মহানগর সদস্য জনাব শাজাহান বলে মনে রাখতে হবে, নদীগুলো মরে যাওয়ায় শুধু অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব পড়ছে না, একই সঙ্গে জনজীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভিঘাত নেমে আসছে। নদীহীন জনপদে নদীর জন্য শুধু হাহাকারই নয়, বহুমাত্রিক সঙ্কটও তৈরি হচ্ছে। বাংলার নদ-নদীগুলোর অপমৃত্যু জীবনের ওপর শুধু ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে না, জাতীয় জীবনের সব অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেবে।

নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা এবং দখল রোধের দায়িত্ব দেয়া আছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। আবার নদীর দূষণ ঠেকানোর দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের। এভাবে নদী রক্ষার সঙ্গে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনও। তবুও রক্ষা পাচ্ছে না নদী।

তাই নদী সুরক্ষায় গণজাগরণ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। পরিবেশ ও অর্থনীতি উভয়ক্ষেত্রেই নদীর যে গুরুত্ব সে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিজ বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদী সম্পর্কে শিক্ষার ব্যবস্থার পাশাপাশি দখলদার এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

আব্দুস সালাম সময় এর সঞ্চালনায় এ ছাড়াও সভা উপস্থিত ছিলেন শিশুস্বর্গের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দর্পন জামিল, নদী ঘোরাও নদীর পথে’র ইফতেখার, রবিউল ইসলাম সোহেল, নীড় সেবা সংস্থার সম্মানিত চেয়ারম্যান মো: আবু সাঈদ, ব্রাদার্স পরিবহন ও সাউথ-ওয়েস্ট ডেভেলার্স লি: এর সম্মানিত চেয়ারম্যান মো: সামসুদ্দীন, নোঙরের মো: আনোয়ার হোসেন, মো: আমিনুল হক চৌধুরী, মো: বাহারুল ইসলাম টিটু, মো: সজিব সরকার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার মো: মাকসুদুল ইসলাম, দৈনিক সমকাল পত্রিকার এস. এম. মাহাদি হাসান, অত্র অঞ্চলের প্রতিনিধি শামস উদ্দীন মিন্টুসহ বছিলা অঞ্চলের সর্বস্তরের স্থানীয় মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে