৫৯ জেলায় ৪৫ হাজার নদী দখলদার চিহ্নিত হয়েছে!

0
534
তুরাগ নদের অনেক জায়গায় এভাবে বালু উত্তোলন মেশিন বসিয়ে মাটি ভরাট করছে সংঘবদ্ধ মহল। ছবিটি মিরপুর বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন তুরাগ নদ থেকে তোলা —সামসুল হায়দার বাদশা

দখলমুক্ত করতে এক বছরের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে জেলা প্রশাসন সর্বাধিক দখল হয়েছে চট্টগ্রামে ৩৫ নদনদীতে তিন ধরনের দখল

শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, (নোঙরনিউজ) : জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৫৯ জেলায় ৪৫ হাজারেরও বেশি নদী দখলদার ব্যক্তি, রাজনীতিক ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী শিগগির এই তালিকা সর্বসাধারণের জন্য কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি প্রতি জেলায় দখলদারদের নাম-ঠিকানা উম্মুক্ত স্থানে টাঙিয়ে দেওয়া হবে। তবে রাজধানীর চারপাশের নদী দখলদারদের নাম-পরিচয় এখনো চিহ্নিত করা হয়নি বলে জানা গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৪০৩টি। নদী রক্ষা কমিশন বলছে, প্রায় সব নদীই এখন দখল-দূষণের কবলে। নদী দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসকদের অধীনে হাতে নেওয়া হচ্ছে এক বছরের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান বলেছেন, কমিশন থেকে সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা নদী দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহে আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে।

সূত্র জানায়, নদীকে জীবন্তসত্তা ঘোষণা দিয়ে দখল ঠেকাতে গত ফেব্রুয়ারিতে রায় দেয় উচ্চ আদালত। দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তা প্রকাশ করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দখলদারদের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেয় নদী রক্ষা কমিশন। সেই তালিকায় এখন পর্যন্ত ৫৯ জেলায় ৪৫ হাজার ১৪৮ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি, রাজনীতিক ও প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে দখলদার তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংখ্যাই বেশি বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু তাদের নাম জানায়নি। সূত্র বলেছে, জেলায় জেলায় উন্মুক্ত করে দেওয়া তালিকায় বিস্তারিত পরিচয় থাকবে। তালিকায় সবচেয়ে বেশি দখলদার চট্টগ্রাম বিভাগে।

ঢাকার চারপাশের নদী দখলদারদের নাম চিহ্নিত না করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নদী রক্ষা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে। শুধু ঢাকা নয়, বাকি চার জেলার দখলদারদের তালিকাও শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে নদ-নদীকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে নির্দেশ দেওয়ার পর প্রশাসন থেকে সারাদেশেই বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। তবে প্রভাবশালী মহলের দখলে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদে বাধা পাচ্ছে প্রশাসন। মামলা করে স্থাপনা উচ্ছেদ ঠেকিয়ে রাখছে অনেকে। এসব মামলা মোকাবেলায় এই প্রথমবারের মতো কমিশন নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ করেছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান ইত্তেফাককে জানান, কমিশন নদী বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দর্শন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের তালিকা জেলায় জেলায় প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি উচ্ছেদ অভিযান চলবে। তার মতে, নদীর জমি নির্ধারণ করা বড় সমস্যা। দখলদাররা সীমানা পর্যন্ত মুছে দিয়েছে। তাছাড়া মাঠ প্রশাসনে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নেই। চর পর্যন্ত দখল করে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। মামলা করে তারা অবৈধ দখল টিকিয়ে রাখছে। তবে কমিশন এ ব্যাপারে তত্পর রয়েছে।

বেশি দখল-দূষণের শিকার যে ৩৭ নদী : দেশের ৪০৩ নদ-নদীর মধ্যে ৩৭টি সবচেয়ে বেশি দখল-দূষণের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে: রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদী, কুমিল্লা অঞ্চলের ডাকাতিয়া, চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী, হালদা, নেত্রকোনার মগড়া, খুলনার ময়ূর, হবিগঞ্জের খোয়াই ও সোনাই, সিলেট অঞ্চলের সুরমা, পিয়াইন, বিবিয়ানা, খাসিয়া চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ অঞ্চলের নবগঙ্গা, টাঙ্গাইলের লৌহজং, লাঙ্গুলিয়া, ঢাকা অঞ্চলের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বংশী, কক্সবাজারের বাঁকখালী, ময়মনসিংহ অঞ্চলের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, রংপুরের ঘাঘট, ইছামতী, দিনাজপুরের পুনর্ভবা, বগুড়ার করতোয়া, নওগাঁ-জয়পুরহাটের ছোট যমুনা, নাটোরের নারদ, কুড়িগ্রামের সোনাভরি, বরিশাল অঞ্চলের সন্ধ্যা, ফরিদপুরের কুমার, সাতক্ষীরার আদি যমুনা, যশোরের কপোতাক্ষ ও ভৈরব; নরসিংদী অঞ্চলের হাড়িধোয়া এবং গাজীপুরের চিলাই।

এই ৩৭ নদ-নদীতে তিন ধরনের দখল রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্থায়ী আবাসন বা বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়াও সরকারি অপরিকল্পিত স্থাপনার মাধ্যমেও নদ-নদী দখলের শিকার হচ্ছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা বলতে সাধারণত পরিকল্পনাহীন ও অবৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত আড়াআড়ি সড়ক, বাঁধ ও স্লুইসগেটকে বোঝানো হয়ে থাকে। এমন দখলের শিকার বৃহত্তর রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদী। আশির দশকে এই নদীর সঙ্গে গঙ্গার সংযোগস্থলসহ ভাটিতে তিনটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে পাবনার কাবিখা ও কাবিটার অর্থে নির্মিত হয় আড়াআড়ি সড়ক। এর ফলে নদীটি বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং নাটোরের বনগ্রাম এলাকায় একটি ধারা দখলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

সর্বশেষ করতোয়া নদী নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফলে সম্প্রতি একনেকে ওই নদীসহ নাগর ও বাঙালি নদী পুনরুদ্ধারে একটি প্রকল্প পাশ হয়েছে। কিন্তু এতে স্লুইসগেট উচ্ছেদ না করে নতুন করে স্লুইসগেট নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।

গবেষকদের মতে, নগর সংলগ্ন নদ-নদীর দূষণ ও দখল নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু দখল-দূষণের থাবা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে। দখল উচ্ছেদ বা দূষণবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হয় মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীকে কেন্দ্র করে।

বিশিষ্ট নদী গবেষক শেখ রোকনের মতে, ৯০-এর দশক থেকে নদ-নদীতে দখল ও দূষণ বেড়েছে। একই সময়ে পরিবেশ ও নদী সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা প্রণয়ন ও নতুন নতুন সংস্থা গঠন হলেও দখল বা দূষণ হ্রাসে দৃশ্যত কোনো প্রভাব পড়েনি। তার মতে, দখল ও দূষণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মিহির চন্দ্র বিশ্বাস এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রায় প্রতি বছরই নদীতে দখল উচ্ছেদ অভিযান চলে। তার মতে, এসব অভিযান অনেকটা ‘লোক দেখানো’। উচ্ছেদের পর আবার বেদখল হয়ে যায় নদী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে