রবিবার, ৩১ মার্চ ২০১৯, (নোঙরনিউজ) : আগামীকাল ১ এপ্রিল ২০১৯, সোমবার সন্ধ্যা ৬:৪৫ মিনিটে বিটিভি ও বিটিভি ওর্য়াল্ড নদী নিরাপত্তার ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্র ‘নোঙর-৭২তম পর্ব একযোগে সম্প্রচার করবে। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তুরাগ নদী পর্যন্ত নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান পর্বে তুলে ধরা হয়েছে নদীর বর্তমান দৃশ্যচিত্র।
রাজধানীর গাবতলী থেকে মিরপুর বেড়িবাঁধ ধরে আশুলিয়া পর্যন্ত তুরাগ নামের নদটি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। বইয়ে লেখা ইতিহাসে, ওই অংশে নদী আছে; ম্যাপেও জানান দিচ্ছে তুরাগের অবস্থানের প্রকৃত চিত্র। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে ইতিহাসের মিল নেই। মিরপুর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটারের মাঝেমধ্যে তুরাগের বুকে পানির দেখা মিললেও বেশিরভাগ অংশে বালু জমে নদীর পিঠ বেরিয়ে এসেছে। দখল-ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ।
বেড়িবাঁধ ধরে উত্তর দিকে কিছুদূর এগিয়ে চটবাড়ি এলাকায় পেঁৌছলেই দেখা যায় নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে নেবারল্যান্ড পার্ক। বেশ বড় একটি এলাকা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে; ভেতরে লাগানো হয়েছে গাছপালা। দুটি অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। নদীর সীমানা পিলারও পড়েছে ওই পার্কের ভেতরে। এরই পাশ দিয়ে কোনো রকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগ। স্থানীয়রা জানান,
যেখানে পার্কটি গড়ে তোলা হচ্ছে, তা ছিল জলাশয়। গত কয়েক বছরের মধ্যে বালু ফেলে ভরাট করে পার্কটি করা হয়েছে, এখনও ভরাট চলছে। পার্কের ভেতরে নদীর জায়গাও পড়েছে। বনভোজনের জন্য পার্কটি ভাড়া দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই স্থানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয়। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে পার্কের মালিকদের একজন কৌশিক আহমেদ দাবি করেন, জলাশয় হলেও এটা ছিল ধানি জমি। তারা ছয়জন মিলে মোট ১৩ বিঘা জমি কিনে পার্কটি করেছেন। নদী দখল বা ভরাট তারা করেননি। পার্কের ভেতরে নদীর সীমানা পিলার থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বর্ষা মৌসুমে নদীতে অনেক পানি থাকায় আমরা প্রকৃত সীমানা পিলার পুঁততে পারিনি। এখন তা নদীর সীমানায় পোঁতা হবে। তবে ম্যাপে দেখা যায়, ওই পয়েন্টে বেড়িবাঁধের পাড় দিয়েই নদীর অবস্থান। পাড় থেকে প্রায় ১০০ গজ রাস্তা নদীর ভেতরে চলে গেছে। সেখানেই গড়ে উঠেছে নেবারল্যান্ড পার্ক। এরপাশে একইভাবে গড়ে উঠেছে তামান্না ফ্যামিলি ওয়ার্ল্ড নামের আরেকটি পার্ক। নকশা অনুযায়ী সেটারও পুরোটাই নদীর ভেতরে পড়েছে। এর পাশেই রয়েছে রফিকের ভাত-ভর্তা হোটেল। এগুলোও মূল সড়ক থেকে নদীর দিকে এগিয়ে করা হয়েছে।
তুরাগ নদী বাংলাদেশের ঢাকা ও গাজীপুর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৮২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক তুরাগ নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ২৫।
এটি ঢাকা শহরের সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া ৪টি নদীর মধ্যে ১টি। এই নদীর গভীরতা ১৩.৫ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ১ হাজার ২১ বর্গ কিমি। সারা বছরই এর প্রবাহ থাকে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পানিপ্রবাহ কম থাকে। তখন মিরপুরে পরিমাপ ১২৪ ঘনমিটার/সেকেন্ড এবং গভীরতা হয় ৪.৫ মিটার। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে আগষ্টে এই প্রবাহ বেড়ে ১১৩৬ ঘনমিটার/সেকেন্ডে দাঁড়ায়। তুরাগ নদের নিম্নাংশে জোয়ার-ভাটার প্রভাব রয়েছে।
তুরাগ নামের নদীটি গাজীপুর জেলাধীন কালিয়াকৈর উপজেলার প্রবহমান বংশী নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় বিভাজিত হয়েছে। এর একটি শাখা সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নে বংশী নদীতে এবং মূল শাখাটি আমিনবাজার ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পতিত হয়েছে।
অর্থাৎ এটি বংশী নদীর শাখা। সে হিসেবে এটি কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর, মির্জাপুর, গাজীপুর, সাভার, মিরপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় বুড়িগঙ্গায় মিলিত হয়েছে। তুরাগ নদ সর্পিলভাবে প্রবেশ করে প্রথমে কিছুটা পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে তারপর বুড়িগঙ্গায় পড়েছে। টঙ্গীখাল তুরাগ নদে মিলিত হয়েছে মিরপুরের উত্তরে। তুরাগের ছোট একটি শাখা কালিয়াকৈরের কাছ থেকে উৎপন্ন হয়ে কড্ডা এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে টঙ্গী খালে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে এই শাখাকেও তুরাগ নদ বলে। সারা বছরই নদটি নৌকা চলাচলের উপযোগী। গ্রীষ্মে ক্ষীণকায় হয়ে পড়লেও তুরাগ একটি সক্রিয় নদ। যমুনা নদীর অবক্ষেপ প্রায় সুদূর টঙ্গী খাল পর্যন্ত তুরাগের উপত্যকা জুড়ে রয়েছে। ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের পর এমন ঘটেছে। এই নদীতীরে মির্জাপুর, কাশিমপুর, ধীতপুর, বিরুলিয়া, উয়ালিয়া, বনগাঁ প্রভৃতি স্থান অবস্থিত।
ঢাকার নদীমাতৃক বৈশিষ্ট্য দেখে বলা যায়, তুরাগে প্রচুর মাছ ছিল কিন্তু বর্তমানে তীব্র পানি দূষণে ভুগছে। যখন নদীকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অধিকাংশ কারখানা পরিবেশ আইনের খুব সামান্য অংশই মেনে চলতে চেষ্টা করেছে এবং পানির দৃশ্যমান রং পাল্টে গিয়ে নোংরা হয়েছে।
অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করতে ‘নদী নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙর’ দেশের সকল নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার দাবিতে যে আন্দোলন করে ছিল সেই আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পারসন’ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট, যা দেশের সব নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আদালতের এই আদেশের মধ্যে দিয়ে জীবন্ত সত্তা হিসেবে মানুষ যেমন সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে, নদীর ক্ষেত্রেও তেমন কিছু অধিকার স্বীকৃত হল।
তুরাগ নদী রক্ষায় একটি মামলার রায় ঘোষণার মধ্যে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে ঐতিহাসিক এ ঘোষণা আসে। বৃহস্পতিবার নদী রক্ষায় বিষয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা’ দিয়ে অবশিষ্ট রায় ঘোষণা করবে এ আদালত।
আইনের চোখে ব্যক্তি দুই ধরনের- নেচারাল পারসন ও লিগ্যাল পারসন। একজন মানুষ ‘নেচারাল পারসন’ হিসেবে যেসব আইনি সুবিধা ভোগ করেন, ‘লিগ্যাল পারসন’ এর ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনি অধিকার প্রযোজ্য হয়।
হাই কোর্ট রায়ে বলেছে, অবৈধ দখলদারদের দ্বারা প্রতিনিয়তই কম-বেশি নদী দখল হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদীকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হল।
আদালত বলেছে, নাব্যতা ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তুরাগ নদীর অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাই কোর্টে দাখিল করেছিল বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি। ওই তালিকায় আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হন। উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট মঙ্গলবার নদী রক্ষায় রায় ঘোষণা শুরু করে।
নোঙর-৭২তম এ পর্বে তুরাগ নদের এ পর্বে কথা বলেছেন বিআইডব্লিউটিএর জ্যাজিষ্ট্রেট জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক জনাব এ এক এম আরিফ উদ্দিন, খোলামোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আরো অনেকে। নাসির উদ্দিনের প্রযোজনা এবং সুমন শামস এর পরিকল্পণা, গ্রন্থনা, গবেষণা ও উপস্থাপনায় আগামীকাল ১ এপ্রিল ২০১৯, সোমবার সন্ধ্যা ৬:৪৫ মিনিটে বিটিভি ও বিটিভি ওর্য়াল্ড একযোগে সম্প্রচার করবে।
আপনার নদীর কথা জানিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। ই-মেইল : nongorbd@gmail.com