দারিদ্র্য বিমোচনে আগের মতো ভূমিকা রাখতে পারছে না প্রবৃদ্ধি : বিশ্বব্যাংক

0
505

ঢাকা, ৯ এপ্রিল, ২০১৮ (নোঙরনিউজ) : বাংলাদেশে দরিদ্র হার কমছে, কিন্তু যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সে হারে কমছে না। এর জন্য সমাজে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান না হওয়াসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দরিদ্র মানুষের অংশ কমে যাওয়াকে দায়ী করেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। সরকারি হিসাবে চলতি অর্থবছর ৭ দশমিক ৬৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক হিসাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। অর্থনীতি যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগে নেমে আসতে পারে পারে বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

‘বাংলাদেশ ডেভপলমেন্ট আপডেট’ শিরোনামে এই প্রতিদেনটি সোমবার বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করা হয়। এসময় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বক্তব্য দেন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা কার্যালয়ের মূখ্য অর্থনীতিবিদন ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি উল্লেখ করেন, সরকারিভাবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭ দশমকি ৬৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির সাময়িক প্রাক্কলন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এই প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমকি ৫ থেকে ৬ দশমিক ৬ ভাগ। এর কারণ ব্যখ্যা করে জাহিদ হোসেন বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব করেছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের হিসাবে এবছর শিল্পখাতে ১৩ দশমিক ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধির অনুমান করা হয়েছে। কিন্তু সে হারে বিনিয়োগ হয়নি। তাছাড় ভোগ ব্যয় বাড়বে বলেও উল্লেখ করেছে। কিন্তু অর্থনীতির গতি প্রকৃতিতে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যার ভিত্তিতে সমাজের ভোগ ব্যয় আগের সময়ের চেয়ে বাড়তে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ৭ দশমিক ৬৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির জন্য মাথাপিছু ভোগব্যয় ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে বাড়বে বলে হিসাব করা হয়েছে। কিন্তুু গত আট বছরে এটি গড়ে বেড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ১ ভাগ হারে। ২০১৭ সালের হিসাবে দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২ দশমিক ২ ভাগ। কিন্তু শ্রমের আয় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭ ভাগ।

বিবিএস এর তথ্যা বিশ্লেষণ করে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও উত্তরবঙ্গে দারিদ্র্য হার কমেনি। রংপুরে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। রাজশাহী, খুলনা বিভাগে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা না বাড়লেও কমেনি। দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা মূলত রাজধানীতে কমেছে। তাছাড়া বিবিএস এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের শহরাঞ্চলে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ বেড়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গড়ে ১ দশমিক ৭ ভাগ হারে দরিদ্র্য কমেছে। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গড়ে বছরে ১ দশমিক ২ ভাগ হারে দারিদ্র্য কমেছে। অথচ এসময়ে দেশে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এবছর রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও সেটি ২০১৬ সালের অবস্থানে যেতে পারেনি। চলতি হিসাব ভারসাম্যে ঘাটতির আকারও অনেক বেড়েছে। সেইসাথে মূল্যস্ফীতির চাপও বাড়ছে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অর্থবছরের আট মাসে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্র থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্বের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে রাজস্ব আদায়ের যে তথ্য আসে তাতে বড় ফারাক থাকে।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে তিনি বলেন, নীতির অনিশ্চয়তা ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল করছে। এখন আর সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার নেই। ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত যে তারল্য ছিল সেটি আর নেই। ব্যাংকিং খাতে সে সমস্যা ছিল তার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এর ফলে খেলাপি বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়ানোর জন্য সিআরআর কমানো হয়েছে। এর ফলে মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমূলক হয়ে পড়বে। ফলে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে একটি অনিশ্চয়তা থেকে যায়।

কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, বাংলাদেশের কর আদায়ের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। সরকারের ভর্তূকি বাড়ছে মূলত সঞ্চয় পত্রের কারণে। এর উচ্চ সুদ হার আর্থিক খাতের অন্য উপাদানে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর সুদ হার বড়ছে। তাছাড়া আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ২০১১ সালের পর বাণিজ্য ঘাটতির আকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে ডলারের দাম ঠিক করতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ এখন উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ হবার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য ব্যবসায়ীক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। সেইসাথে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করতে হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক ও সতর্ক মুদ্রানীতি বজায় রাখতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়াতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমূলক হয়ে পরেছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো স্বাধীন ভাবে কাজ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। স্বল্প মেয়াদে পূর্বাভাস প্রতিবেদন অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ ভাগ হতে পারে। পরের বছর ২০১৮-১৯ সালে এটি ৬ দশমিক ৭ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হতে পারে।

পরিকল্পনামন্ত্রীর দ্বিমত:
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন নিয়ে সোমবার নিজ কার্যালয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বব্যাংক সাড়ে ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধির যে হিসাব করেছে সেটি অনুমান নির্ভর। চূড়ান্ত হিসাব শুধু বিবিএস করতে পারে। বিবিএস এর প্রাথমিক হিসাব না মানলেও চূড়ান্ত হিসাবকে সবাই মেনে নেয়। তাছাড়া বিশ্বব্যাংক তাদের আগের প্রতিবেদনেও প্রবৃদ্ধি কম হবার অনুমান করেছিলে যা পরবর্তীতে সঠিক হয়নি। এসময় তিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের কিছু কর্মকর্তার সমালোচনা করে বলেন, তারা ঢাকায় বসে রিপোর্ট তৈরি করে। সারাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটি তারা দেখে না। বিশ্বব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার কাজে আন্তরিকতা নেই বলে মনে করেন তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে