অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন ও নৌযান চলাচল: মাছের প্রাচুর্য হারাচ্ছে সুন্দরবন

0
699

সুন্দরবনের এক-তৃতীয়াংশই নদী-খাল আবৃত। মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে এ নদী-খাল ঘিরেই একসময় গড়ে ওঠে বিশাল জেলে সম্প্রদায়। দেশ ভাগের আগেও সুন্দরবনকেন্দ্রিক পেশাদার মৎস্যজীবী ছিল প্রায় ২০ হাজার। শুধু সুন্দরবন থেকেই তাদের জালে উঠত বছরে ৩৫ হাজার টনের বেশি মাছ। বিভাগোত্তর জেলেদের অনেকে অভিবাসন করলে এ অঞ্চলে মৎস্য সম্পদ আহরণে শূন্যতা তৈরি হয়। তবে এ শূন্যতা পূরণে সময় লাগেনি। ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকেও সুন্দরবনের নদী-খাল থেকে মাছ পাওয়া যেত ২০ হাজার টনের কাছাকাছি।

পরিস্থিতি বদলাতে থাকে সুন্দরবনকেন্দ্রিক শিল্প কার্যক্রমের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তৃতির পর। বাড়তে থাকে সুন্দরবনের ভেতর নৌযান চলাচল। নৌযান দুর্ঘটনাও অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে। এসবেরই প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের জলজ সম্পদের ওপর। এক সময়ের মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ সুন্দরবন এখন সেই প্রাচুর্য হারাচ্ছে।

২০১৪ সালের শেষদিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শ্যালা নদীতে ডুবে যায় তেলবাহী ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭। ট্যাংকারটির সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের পুরোটাই সুন্দরবন এলাকার নদীগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এ দুর্ঘটনার মারাত্মক প্রভাব পড়ে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যে।

মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন এলাকায় মাছের উৎপাদন লক্ষণীয় মাত্রায় কমে গেছে। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ট্যাংকারডুবির আগের অর্থবছর (২০১৩-১৪) সুন্দরবন এলাকা থেকে মাছ আহরণ হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৬৬ টন। ট্যাংকারডুবির পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৫৮০ টনে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সুন্দরবন এলাকায় মাছের আহরণ আরো কমেছে। অর্থবছরটিতে সুন্দরবন থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ১৬ হাজার ৮৭০ টন মাছ।

সুন্দরবন থেকে মাছ আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জ্বালানি তেল ও কয়লাবাহী ট্যাংকারডুবির পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত নৌযান চলাচলকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তারা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ২০১৪ সালে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর ওই তেল মাছের প্রজননক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, যা পুরোপুরি তোলা সম্ভব হয়নি। সেই তেল মাটির সঙ্গে মিশে মাছের খাবার ও বংশবিস্তারে বাধা সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, ওইসব এলাকায় মাছের উৎপাদন আগের মতো হচ্ছে না।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন খুলনার পাইকগাছার কমলাপুর গ্রামের মো. হাসেম আলী গায়েন। চার বছর আগেও প্রতি ট্রিপে ১০ হাজার পিস মাছ ধরা পড়ত তার জালে। ২০১৪ সালে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর পাঁচ-সাত হাজারের বেশি মাছ পাচ্ছেন না তিনি।

মৎস্যজীবী হাসেম আলী বলেন, আগে মাছ ধরতে গেলে কী পরিমাণ পেতে পারি, সে ব্যাপারে মোটামুটি একটা ধারণা করা যেত। কিন্তু এখন মাছ ধরতে হচ্ছে কোনো ধারণা ছাড়াই।
মাছ আহরণ কমার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতায়ও পিছিয়ে পড়ছে সুন্দরবন। দেশে মাছ ধরার ১০টি উেস হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ১ হাজার ৩৬৯ কেজি। সেখানে সুন্দরবনে হেক্টরপ্রতি মাছ উৎপাদন হচ্ছে গড়ে মাত্র ১০২ কেজি। উৎসগুলোর মধ্যে এটাই হেক্টরপ্রতি মাছের সর্বনিম্ন উৎপাদন; দেশের অন্যান্য নদী থেকে আহরিত মাছের এক-তৃতীয়াংশেরও কম।

নৌযান চলাচল বৃদ্ধির পাশাপাশি সুন্দরবনকেন্দ্রিক অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নকে এর বড় কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মোংলায় সুন্দরবনের আশপাশে গড়ে তোলা শিল্প-কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য পশুর নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে সুন্দরবনের মাছের যে খাদ্যকণা, তা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবেই সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় রয়েছে অন্তত ১৮৬টি শিল্প-কারখানা ও প্রকল্প। এর মধ্যে সিমেন্ট কারখানা রয়েছে ছয়টি, এলপিজি বোতলজাত কারখানা আটটি, ওয়েল্ডিং ও লবণপানি শোধন প্রকল্প রয়েছে সাতটি করে, পাঁচটি করে বরফকল এবং কাঁকড়া চাষ ও হ্যাচারি, তিনটি করে তেল পরিশোধন ও ইটভাটা এবং দুটি করে জাহাজ নির্মাণ ও ব্যাগ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাইস মিল, স’ মিল ও মৎস্য খামার। এছাড়া সুন্দরবন এলাকায় নতুন করে দেড়শটির বেশি শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে।

সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় যেকোনো ধরনের শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ বনের ইকোসিস্টেমের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন অ্যাকশনএইডের প্রধান কার্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের গ্লোবাল লিড হারজিত সিং। তিনি বলেন, শিল্পায়ন ও জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করলে মৎস্য সম্পদসহ সুন্দরবনের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই এখনই সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে।

উৎপাদনশীলতা ও পরিমাণের পাশাপাশি সুন্দরবন এলাকায় কমে এসেছে মাছের প্রজাতির সংখ্যাও। মোংলার জয়মনি গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার জানান, আগে তার কাছে জেলেরা ২০-২৫ ধরনের মাছ নিয়ে আসত। এখন পাঁচ-সাত ধরনের বেশি মাছ আসছে না। শুধু মাছ ধরার ওপর নির্ভর না করে তাই চিংড়ি ঘেরের ব্যবসায় ঝুঁকছেন এ মৎস্যজীবী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবন এলাকায় পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। এটিও মাছের প্রজননে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতাও মাছের উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।

সুন্দরবনে মাছ আহরণ কমে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে বলে জানান খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: শামীম হায়দার। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের নদীগুলোয় মাছের প্রাচুর্য কোথাও কমেছে, কোথাও বেড়েছে। যদিও কমেছে এমন অঞ্চলই বেশি। তাছাড়া মাছের চলাচলের পথও পরিবর্তন হচ্ছে। মাছ আহরণের অনুমতি ও নিয়ন্ত্রণের পুরো বিষয়টি বন অধিদপ্তর করে থাকে।
সুন্দরবনের সঠিক ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান খুলনার বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়াও জেলেদের মাছ ধরার বিষয়ে আরো সহযোগিতা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তদারকিও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। ফলে আশা করা যায়, সুন্দরবনে মাছ আহরণ চলতি অর্থবছর বাড়বে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে