নাবিকের সমুদ্র কথন-১১৭ : ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ মাহমুদ

0
600

অনেকদিন পর ঘুম ভাঙল একদম নিশ্চিন্ত আর নির্ভাবনায়। সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে, এখন শুধু সময় কাটানোর অপেক্ষা। কালকে রাতে শেষ বারের মত যখন ব্রিজে গিয়ে ছিলাম, দেখি হটাত কুয়াসায় সব ছেয়ে গেছে। সকালে গিয়েও দেখি একই অবস্থা, চারিদিকে অন্ধকার। বিশাল জানাল যে কুয়াসার জন্য চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া আছে, কোন জাহাজ আসা যাওয়া করছে না। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, তার সাথে থেমে থেমে ঝাঁঝর দিয়ে পানি দেয়ার মত বৃষ্টি, দেখলে মনে হয় ঝাঁঝরে পানি শেষ হয়ে যায়, আবার ভরা হয় আবার শেষ হয়। ভালো দিক হল অনেকদিন পর ডেক ঝক ঝকে তক তকে পরিষ্কার। আমি যে অবস্থায় জাহাজে যোগ দিয়ে ছিলাম, সে অবস্থায় ফেরত নেয়া সম্ভব না, গত তিন মাসের টানা লাইটারিং এ, জাহাজ অনেক নোংরা হয়ে গেছে। তারপরেও চেষ্টা করছি যতটা ঘষা মাজা করে ফর্শা করা যায়। পানি স্বল্পতার জন্য গতকাল নোনা পানি দিয়েই ধোয়া হয়েছে, আর কালকের সে ধোয়া আজকে কাজে লেগেছে। যা কিছু লবণ জমে ছিল সব চলে যাবে। বাইরে কাজ করার যোগার নেই, ক্রুরা সবাই একোমোডেশনের ভেতরে সাফ সাফাই করছে। আমি আছি জাহাজে প্যাসেঞ্জারের মত। অন্যান্য সময়ে শেষের দিকেও ব্যাস্ততা থাকে, এবার সেটা নেই। জাহাজ অলস ভাবে অপেক্ষা করছে, কালকে লোকজন আসবে, স্টোর আসবে, খাবার আসবে, এসব তুলে রওনা হবে কলম্বিয়ার উদ্দেশ্যে। হস্তান্তরের জন্য যেসব কাগজপত্র আছে সেসব প্রস্তুত করা হয়ে গেছে, এদিকে অফিসেও ছুটির দিন, তাই জ্বালাতন করার মত কেউ নেই। আমার অবস্থা হল অনেকটা বাড়ির বেকার অকর্মা ছেলের মত। আমার মাথায় সবচেয়ে বড় চিন্তা আমার ব্যাগ গুছানো। দুটি ব্যাগে অনেক কষ্টেশিষ্ঠে ঢোকান হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর নূতন কিছু বের হচ্ছে যে এটা ভরা হয় নি। সকাল থেকে বেশ অনেকবার সব বের করা হয়েছে আবার সাজিয়ে ঢোকান হয়েছে। মাঝে মাঝে দিন লিপি কিছুটা লিখছি, আবার ব্রিজে গিয়ে দেখে নিচ্ছি পেশাদারি কাজের কিছু রয়ে গেল কিনা।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু ঘুম দেবার ইচ্ছে হল। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে বলে দিলাম আজকে আর সেফটি মোমেন্ট করা হবে না। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম এলো না। এদিকে সব কিছুই মোটামুটি ব্যাগে ভরা হয়ে গেছে, কিন্তু আমার রোবট কোন ভাবেই ঢুকছে না। তাকে শুধু আমার ব্যাকপ্যাকে ভরা যাচ্ছে, কিন্তু ব্যাকপ্যাকে তাকে ভরার পর তাতে এমনকি আমার সনদ পত্রের ফাইলটিও আর ঢুকার মত অবস্থা থাকছে না। হয় ওকে হাতে নিয়ে যেতে হবে বা ফাইল হাতে নিয়ে হাটতে হবে। ইসমাইল কে খবর দেয়া হল, বললাম একটি নেট বানিয়ে দাও। রোবট বেশ ভারি, পলিথিন ব্যাগে ভরলে তাকে নিয়ে হাঁটলে ছিরে যাবার সম্ভাবনা আছে। এমনি ফুটবল ঝোলানোর জন্য যেরকম নেট থাকে, ইসমাইলকে জিগ্যেস করলাম সে বানাতে পারবে কিনা।

এরা মিনিকয় এর লোক, এরা জাল বুনে অভ্যস্থ, তাই ভেবেছিলাম হয়তো পারবে। ধারণা ভুল হয়নি, সে বলল একটা কিছু বানিয়ে দেবে অসুবিধা হবে না। সে আমার রোবট কোলে করে নিয়ে গেল জালি বানাতে। মিনিট পনের পরেই চলে এলো ইসমাইল, তাকে থলের ভেতরে ভরে। যাক একধরনের সমাধান হল, হয়তো বা ব্যাকপ্যাক খালি করে তাতে শুধু আমার ফাইল, থাকবে আর হাতে করে ওটা কে ঝুলিয়ে নিয়ে যাবো। এছাড়া অন্য কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
দুটার দিকে ব্রিজে গিয়ে বসলাম, অনেকদিন জেরি’র একটা কাজ করে দেবো বলে আর করা হয় নি। এক্সেল এ বসে বসে ভয়েজ প্লান তৈরি করার একটি শিট তৈরি করে দিলাম। খুঁজে খুঁজে দেখলাম কোথাও কোন স্বাক্ষর বাকি রয়ে গেল কিনা। কম্পিউটারে যত ব্যক্তিগত ফাইল ছিল, কিছু সেইভ করে নিলাম আমার হার্ড ড্রাইভে, বাকি গুলো সব ডিলিট। আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে আমার নাম এ জাহাজ থেকে, এরকম সময়ে একরকম স্মৃতি-কাতরতা কাজ করে। আলী আসলো ওর হোয়াটসাপে আমাকে এড করার জন্য। তারপর ওজন মাপার মেশিন নিয়ে ক্যাবিনে এলাম শেষ বারের মত মেপে দেখার জন্য যে ব্যাগ অতিরিক্ত ভারি হয়ে যায় নি। দুটি ব্যাগই কানায় কানায় ভরেছে, সাথে একদম অনুমোদিত সর্বোচ্চ ওজনে পৌঁছেছে, টিকেটের টাকা একদম উসুল।
এবার আসি আসল কাহিনীতে, যে কাহিনী অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও গত কয়েকদিন তা বলার সময় পাইনি। জাহাজে আমাদের সাইন অফ এর প্রধান সমস্যা হল রিলিভার, মানে যে আমাকে প্রতিস্থাপন করবে সে সময়মত আসলো কিনা। এর পরের সমস্যা হল বন্দরে ভেড়া, মানে মাঝ সমুদ্র থেকে তো আর সাইন-অফ করা সম্ভব না, কোন না কোন বন্দরে যেতে হবে। এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, প্রতিনিয়ত বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো হচ্ছে, আমাদের রিলিভারো প্রস্তুত, তাহলে সাইন অফ এর এই সমস্যা কেন হল? সমস্যাটি সম্পূর্ণ অনাহূত এবং অনভিপ্রেত।

এমেরিকা হচ্ছে সাইন অফ করার সবচেয়ে ভালো যায়গা, কিন্তু এখানেই আমরা ফেঁসে গিয়েছিলাম খুবই বাজে ভাবে। কেউ ভিসা নিয়ে কোন দেশে গেলে এয়ারপোর্টে একটি সিল মারা হয়, যেখানে লিখা থাকে কতদিনের ভিসা দেয়া হয়েছে। যদি ৩০ দিনের ভিসা দেয়া হয় তাহলে সে বৈধ ভাবে ৩০ দিন সেই দেশে থাকতে পারবে। এর পরে যদি সে দেশে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর পদ্ধতি থাকে, তাহলে সে ৩০ দিন শেষ হবার আগে মেয়াদ বাড়িয়ে আবার কিছু দিনের জন্য বৈধ ভাবে অবস্থান করতে পারবে। কিন্তু ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরেও কেউ যদি সে দেশে রয়ে যায় তাহলে তারা “ওভার স্টে” বা অবৈধ বসবাসকারী হয়ে যাবে। আমাদের সবারই ৫ বছরের ভিসা নেয়া আছে। কেউ যখন জাহাজে যোগ দেয়ার জন্য আসে, তাকে ২৯ দিনের ভিসা দেয়া হয়। অথবা ৬ মাসের ভিসা দেয়া হয় যে জাহাজগুলি এখানে লাইটারিং করে তাদের। কিন্তু এই লাইটারিং ভিসার জন্য কোম্পানি থেকে ইমিগ্রেশন জানাতে হয়, তাহলেই তারা এ ভিসা দেবে, নাহলে এমনি ২৯ দিনের একটি ভিসা দিয়ে চলে যাবে। বাইরের কোন দেশ থেকে জাহাজ এলেই কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন জাহাজে আসবে, সবার পাসপোর্ট দেখবে, কিন্তু পাসপোর্টে কোন ষ্ট্যাম্প করবেনা। শুধু একটি আলাদা পাস ইস্যু করবে যার মেয়াদ ২৯ দিন। এই পাস দিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে, বা কেউ সাইন-অফ করে যেতে চাইলে তাও যেতে পারবে। কিন্তু কোম্পানি থেকে যদি বলে যে এ জাহাজটিকে লাইটারিং ভিসা দেয়া হোক, তখন তারা পাসপোর্টে ৬ মাসের ভিসার স্ট্যাম্প করবে। আমরা যখন আরুবা থেকে ফেরত আসি, আমি কোম্পানিকে বলেছিলাম লাইটারিং ভিসা দেয়ার জন্য, যাতে পরবর্তীতে কার সাইন অফ এর সমস্যা না হয়। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল জাহাজ ১০-১৫ দিনের মধ্যেই আবার বাইরে চলে যাবে। আসলে এতে কোম্পানি’র কোন দোষ নেই, এ জাহাজ লাইটারিং এর জন্য বানানো না। এ জাহাজের পাঁচ বছর বয়সে এই প্রথম মাস তিনেক এই কাজে ব্যস্ত রইল। তাই লাইটারিং ভিসা নেয়া হয় নি।

কিন্তু এর পরে এখানে তারা খুব ভালো কার্গো পাওয়া শুরু করে যা নাকি বিদেশে পাঠানো থেকে লাভজনক ছিল। এটা করতে গিয়ে আমাদের সবার ২৯ দিন অতিক্রান্ত হয়ে যায় এমাসের ২০ তারিখে। আলীকে তখন সাইনঅফ করানো যেত, কিন্তু আমি সহ আরও কয়েকজনের সাইনঅফ ৩০ তারিখে নির্ধারিত থাকায় তারা এটা নিয়ে একটু গড়িমসি করতে থাকে। ফলে আটকে যাই আমরা সবাই। ১৮ তারিখে আমাদের ভেনিজুয়েলা যাবার কথা স্থির ছিল, তাই কোম্পানি ভেবেছিল সেখান থেকে সবাইকে সাইন-অফ করাবে, আরেকটি পণ্য পেয়ে যাওয়াতে আবার আটকে যাই। এর পরেই নূতন চার্টারার পেয়ে যায় ৬ মাসের জন্য, কিন্তু এর জন্য জাহাজ যাবে কলম্বিয়া এবং সেখান থেকে পানামা। কলম্বিয়াতে সাইন-অফ এর সমস্যা নেই, কিন্তু নিরাপত্তা জনিত কারণে কাউকে সেখানে সাইন অফ করাতে চায় না। সুতরাং সাইন-অফ করতে হত পানামা তে। এ ব্যাপারগুলি কোম্পানির গাফিলতির জন্য হওয়াতে আমার পক্ষে সম্ভব হয় তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা। বিশেষ করে আলীর ব্যাপারটি খুবই জরুরী, তাই আমি অনেকটা বাধ্য করি যাতে এমেরিকা থেকে সেইল করার আগেই আমাদের সাইন-অফ করানো হয়। কিন্তু আইনগত ভাবে আমরা এখন ভিসা থাকা সত্যেও ‘ওভার স্টে’। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র জরুরী কোন অবস্থার কারণেই অনুমতি পাওয়া যায়। এবং আমাদের সেভাবেই অনুমতি দেয়া হয়েছে, আমাদের অনুমোদন পত্রে লিখা আছে ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যারোল’, বা মানবিক কারণে অবমুক্তি। তখন আমাদের পুরো জাহাজের লাইটারিং ভিসা নিয়ে নিলে হয়ত হাজার দেড়েক ডলার লাগত, এখন এই মানবিক প্যারোলে আরও অনেক টাকা খরচ হবে, জামাই আদর করে বিমান বন্দরে পৌঁছে দেয়া হবে, কারণ আমরা এক রকম অবৈধ।

যা হোক, এ হবে আরেক নূতন অভিজ্ঞতা। অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে আগেও সাইন-অফ হয়েছে, কিন্তু এতো ভিন্নধর্মী অনিশ্চয়তা নিয়ে কখনো সাইন অফ করিনি। এদিকে সারাদিন বৃষ্টি আর কুয়াশা আরও ভাবিয়ে তুলেছিল, যদি এমন কুয়াশা থাকে, তাহলে সকালে লঞ্চ আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে ভোর ছটার দিকে কোন কুয়াশা থাকবে না। দেখা যাক, এদের রিপোর্ট বিটিভি’র থেকে কতটা ভাল। সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে কালকে এই সময়ে হয়তো আমি থাকব আটলান্টিকের উপর। হয়তো লিখা হবেনা আর ভাসমান রোজনামচা। আর মাত্র ঘণ্টা দশেক পরেই পরিসমাপ্তি ঘটবে দীর্ঘ ১১৮ দিনের জলে ভাষা, আর এর সাথে শেষ হবে এই গদ্য। সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ এই দীর্ঘ সময় ধরে আমার সাথে থাকার জন্যে, আমার আনন্দ বেদনা কিছুটা হলেও ভাগ করে নেয়ার জন্যে।(২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ভাসমান ১১৭ দিন: শনিবার।) সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে